‘কারাগার’: প্রত্যাশার চেয়েও বেশি
১৮ আগস্ট ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হইচইয়ে মুক্তি পায় ওয়েব সিরিজ ‘কারাগার’-এর প্রথম পর্ব। মুক্তির পর থেকেই অন্তর্জাল অনেকটা ‘কারাগার’ময়। ফেসবুকে চলচ্চিত্র, সিরিয়াল নিয়ে বিভিন্ন গ্রুপে চলছে সাত পর্বের ওয়েব সিরিজটির প্রশংসা। বাংলাদেশি দর্শকেরা তো বটেই, কলকাতার দর্শকদের মধ্যেও সাড়া ফেলেছে সিরিজটি। নির্মাতা বলেন, এটা তাঁর প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। তাঁর মতে, সম্প্রতি বাংলাদেশি কনটেন্টের বিদেশে প্রশংসিত হওয়ার অন্যতম কারণ নিজস্ব গল্প, যেখানে দেশ ও দেশের মানুষের কথা উঠে আসছে। ২০২০ সালে একই প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পায় পরিচালক সৈয়দ আহমেদ শাওকীর তাকদীর। ব্যাপক প্রশংসিত সেই সিরিজের সিকুয়েল বা স্পিন অফ নির্মাণের দাবি ছিল অনেক ভক্তের। শুরুতে পরিকল্পনা না থাকলেও জনপ্রিয়তার পর সিরিজের পরের কিস্তি নিয়ে আসার অনেক দৃষ্টান্ত আছে। কিন্তু শাওকী সেই পথ কেন বাছলেন না? পরিচালক বলেন, ‘প্রথম দিন থেকেই “তাকদীর”-এর সিকুয়েল করার কোনো নিয়ত ছিল না। হলে স্রেফ গণদাবির জন্যই করা হতো। “তাকদীর”-এর সহলেখক নেয়ামত উল্লাহ আমাকে ‘কারাগার’-এর আইডিয়া দেয়। সেটা দাঁড় করতে তিন–চার মাস লেগে যায়। এরপর প্রায় এক বছর লেগে যায় লেখা শেষ করতে।’
পরিচালক জানান, লেখার পর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল লোকেশন। দেশে পুরোপুরিভাবে জেলখানা নিয়ে সেভাবে গল্প বলা হয়নি। তাঁর কাছে তাই চ্যালেঞ্জ ‘কারাগারজগৎ’কে দর্শকের সামনে হাজির করা। সে কাজে যে তিনি ভালোভাবেই সফল হয়েছেন, সেটা মুক্তির পর দর্শকের প্রতিক্রিয়া দেখেই বোঝা যাচ্ছে। অমিত পাল নামের এক ভারতীয় দর্শক লিখেছেন, ‘এটাকেই বলে বিশ্বমানের কাজ। বাংলাদেশ সৃজনশীলতার পাওয়ার হাউস।’ হইচইয়ে কলকাতার সিরিজগুলোর সঙ্গে তুলনা করে অভিজিৎ রায় চৌধুরী নামের আরেকজন লিখেছেন, ‘কারাগার কাল এক সিটিংয়ে পুরোটা শেষ করে ফেললাম। অথচ সিনেমার কালচার কলকাতায় অনেক পুরোনো। এই যে অবনমন, এর দায় কার?’ ইউটিউবে ‘কারাগার’–এর ট্রেলার বা ফেসবুকে ঢুঁ মারলে এমন অনেক মন্তব্যই পাওয়া যাবে। বাংলাদেশেও দর্শকেরা পিছিয়ে নেই। শাহরুখ বর্ষণ নামের একজন নিজের রিভিউয়ে লিখেছেন, ‘বারবার বিশ্বমানের শব্দটি উল্লেখ করছি যে কারণে যে সিরিজটির সব কটি দিক দশে দশ পাওয়ার মতো। স্ক্রিনপ্লে, সিনেমাটোগ্রাফি, কালার গ্রেডিং, ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর, অভিনয়, গল্প বলার ধরন—সব ফাটাফাটি।’ মুক্তির পর দর্শকের এমন প্রশংসা কেমন উপভোগ করছেন? শাওকী বলেন, ‘এমন প্রতিক্রিয়ায় আমরা আপ্লুত, পুরো টিম খুশি। তবে আমার কাজটা মাত্র অর্ধেক হয়েছে, আরও অর্ধেক বাকি।’
রহস্য ঘরানার কোনো সিরিজের প্রথম কিস্তি শেষ হওয়ার পর দ্বিতীয় কিস্তিতে কী হবে, তা নিয়ে দর্শক নানা রকম তত্ত্ব দাঁড় করান। ‘কারাগার’-এর ক্ষেত্রেও সেটা হয়েছে। শাওকী তার অনেকগুলোই দেখেছেন। জানান, অনেকের তত্ত্বই দ্বিতীয় পর্বে সত্যি সত্যি কী হবে, সেটার সঙ্গে পুরোপুরি মিলে গেছে। কারও কারও অর্ধেক মিলেছে। পরিচালক আরও জানান, দুই পর্ব দেখার পর দর্শক বুঝতে পারবেন, শেষে কী হবে, সেটা ইঙ্গিত প্রথম পর্বেই ছিল। গত জুলাই মাসে মুক্তির পর হাওয়ায় চান মাঝি চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসায় ভাসছিলেন চঞ্চল চৌধুরী। সেই সাফল্যের রেশ কাটতে না কাটতেই তিনি হাজির ‘কারাগার’-এ। কোনো সংলাপ ছাড়াই তিনি সাত পর্বজুড়ে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করেছেন দর্শককে।
পরিচালকের আগের সিরিজেও ছিলেন চঞ্চল। শাওকী জানান, লেখার সময়ই প্রধান চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরীকে নেবেন ঠিক করে রেখেছিলেন। কেবল চঞ্চলই নন, সিরিজের কোন চরিত্রে কাকে নেবেন, সেটা তিনি লেখার সময়ই ভেবে রেখেছিলেন। পরিচালক, অভিনেতা ছাড়াও ‘তাকদীর’ ও ‘কারাগার’-এর ৯০ শতাংশ কলাকুশলী এক। তবে পরিচালক জানান, ‘কারাগার’ তৈরির সময় আগের কাজের সাফল্য মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছিলেন তাঁরা। মিস্ট্রি ধরনের অনেক কাজেই পরিচালক শেষে কী হবে, সেটা পাত্রপাত্রীদের জানাতে দেন না। তবে ‘কারাগার’-এর ক্ষেত্রে এটা হয়নি। শুরু থেকেই সব অভিনেতা-অভিনেত্রীর কাছে পুরো চিত্রনাট্য ছিল। সবাইকে নিয়ে ‘রিডিং সেশন’ হয়েছে। আলোচনা থেকে পাওয়া পরামর্শ নিয়ে চিত্রনাট্য ঘষামাজা হয়েছে।
অভিনয়, লুক নিয়ে ট্রেলার মুক্তির পর থেকেই প্রশংসা পাচ্ছিলেন চঞ্চল। অভিনেতা বলেন, পুরো টিমওয়ার্কের ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে। ‘চরিত্রটি দেখতে কেমন, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কী, তা জানার পর তাকে ভিজ্যুয়ালাইজ করতে হয়। এরপর পরিচালক, মেকআপশিল্পী, কস্টিউমশিল্পী থাকেন...সবাই মিলে একটি চরিত্র তৈরি করেন। লুক নিয়ে নিজের কিছু ভাবনা শেয়ার করেছি, তবে ‘হাওয়া’ বা ‘কারাগার’-এ যে লুক, সেটা আমার একার কৃতিত্ব নয়। পারফরম্যান্সটা আমার,’ বলেন চঞ্চল। অভিনেতা জানান, ‘কারাগার’-এর চরিত্রটি তাঁর ভীষণ প্রিয়। তাঁর বিচারে পুরো ক্যারিয়ারের সেরা পাঁচ চরিত্রের একটি। ঢাকার পরিত্যক্ত পুরোনো জেলখানায় শুটিং হয়েছে ‘কারাগার’-এর। তিন মাসে কয়েক দফায় প্রায় ৩০ দিন শুটিং করে শেষ হয়েছে দুই কিস্তি। সিরিজের লেখা, পরিচালনা তো বটেই, চিত্রগ্রাহক থেকে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরার—সব ক্ষেত্রেই কাজ করেছেন দেশের কলাকুশলীরা। শাওকী মনে করেন, সিনেমা করতে যা প্রয়োজন, সবই দেশে আছে। কিন্তু তাদের ব্যবহার করা জানতে হবে।
কেবল ‘কারাগার’ই নয়, গত কয়েক বছরে ‘তাকদীর’, ‘মহানগর’, ‘নেটওয়ার্কের বাইরে’, ‘ঊনলৌকিক’, ‘পেট কাটা ষ’, ‘শাটিকাপ’সহ অনেক বাংলাদেশি কনটেন্ট দেশের বাইরে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ দর্শক থেকে অভিনয়শিল্পীরা এ দেশের কাজের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছে। যে তালিকায় আছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, ঋদ্ধি সেনের মতো ভারতের জাতীয় পুরস্কার পাওয়া অভিনেতারা। তবে কি দেশে ওয়েব সিরিজ নিয়ে নবজাগণ চলছে? শাওকী বলেন, ‘এই নিউ ওয়েভ সেই সময়ে বসে বোঝা যায় না। সময় বলে দেবে, এটা নবজাগরণ ছিল কি না। আমাদের কাজগুলো গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার মূল কারণ, গল্পগুলো বাংলাদেশ ও দেশের মানুষকে তুলে ধরছে। দেখার পর মনে হয়, গল্পটা শুধুই বাংলাদেশের।’ শাওকীর কাছে জানতে চাওয়া হয় অন্তর্জালে বহুল চর্চিত প্রশ্নটি, কবে আসবে ‘কারাগার’-এর দ্বিতীয় পর্ব? পরিচালক জানান, তিনি শিগগিরই পোস্টপ্রোডাকশন শেষ করে জমা দেবেন। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে হইচই।