থ্রিলারের ভক্ত হলে সিরিজটি আপনাকে দেখতেই হবে
সোনালি চুলের এক ইংরেজ। ক্ষুরধার চাহনি, নির্ভুল নিশানা। দূরপাল্লার স্নাইপার শটে তার দক্ষতা বিশেষজ্ঞদেরও বিস্মিত করে। পেশায় ভাড়াটে খুনি; নিজের কাজে বিশ্বসেরা। কেউ তার আসল নাম জানে না। পরিবারের সদস্য বা খোদ নিয়োগকর্তাও না। পৃথিবীর বড় বড় সিক্রেট সার্ভিসের কাছেও সে অজ্ঞাত।
একনজরে
সিরিজ: ‘দ্য ডে অব দ্য জ্যাকেল’
অভিনয়ে: এডি রেডমেইন, লাশানা লিঞ্চ, উরসুলা কর্বাতু
ধরন: স্পাই-থ্রিলার
নির্মাণ: রোনান বেনেট
পর্ব সংখ্যা: ১০
স্ট্রিমিং: জিও সিনেমা
সে একা কাজ করে। বড় অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে প্রভাবশালীদের খুন করতে তার জুড়ি নেই। নিরাপত্তা যত নিশ্ছিদ্র হোক, রহস্যময় এই আততায়ীর কাছে কিছুই অসম্ভব নয়। নিজের ছদ্মনাম সে নিজেই বেছে নিয়েছে—‘জ্যাকেল’। অন্যদিকে আছেন ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিস এমআই৬-এর গোয়েন্দা বিয়াঙ্কা।
জ্যাকেলকে ধরতে মরিয়া সে, বারবার কাছে পেয়েও ফসকে যায়। শেষ পর্যন্ত জ্যাকেল কি ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে? এই ইঁদুর-দৌড় খেলায় শেষ পর্যন্ত জিতবে কে? এমন গল্প নিয়ে টান টান স্পাই থ্রিলার সিরিজ ‘দ্য ডে অব দ্য জ্যাকেল’।
থ্রিলার–ভক্তরা ফ্রেডরিক ফরসাইথের নাম শুনে থাকবেন। এই ব্রিটিশ ভদ্রলোক থ্রিলার উপন্যাসে বরাবরই নিজের মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। গত এক দশকে তাঁর বেশ কয়েকটি উপন্যাস বাংলায় অনুবাদও হয়েছে। তবে ফ্রেডরিক ফরসাইথের নাম শুনলে প্রথমেই মনে হয় ‘দ্য ডে অব দ্য জ্যাকেল’-এর কথা। এই উপন্যাস অবলম্বনে ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের একটা বইও লেখা হয়েছে, ‘সেই উ সেন’। ১৯৭১ সালে মূল উপন্যাসটি প্রকাশের পর রীতিমতো শোরগোল ফেলে দিয়েছিল। দুই বছর পরেই উপন্যাসটি অবলম্বনে নির্মিত হয় একই নামের সিনেমা। সে সিনেমাটি পুরোপুরি তৈরি হয়েছিল মূল উপন্যাসকে অনুসরণ করে। প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন এডওয়ার্ড ফক্স।
১৯৯৭ সালে ব্রস উইলিস অভিনীত‘ দ্য জ্যাকেল’ও তৈরি হয়েছিল এ উপন্যাস থেকে। এ সিনেমাতে অবশ্য বেশ কিছু বদল করেছিলেন নির্মাতা মাইকেল কেটন-জোন্স। এর মাঝে ১৯৮৮ সালে মামুত্তি অভিনীত মালয়ালম সিনেমা ‘আগস্ট ১’–ও তৈরি হয় একই উপন্যাসের প্রেরণায়। সর্বশেষ এল নতুন এ সিরিজ।
২০২২ সালে স্কাই আটলান্টিক ও পিকক নেটওয়ার্ক সিরিজটির ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই শুরু হয় আলোচনা। মুক্তির আগে গত কয়েক মাসে তো রীতিমতো ঝড় তুলেছিল ‘দ্য ডে অব দি জ্যাকেল’। দুনিয়ার নানা প্রান্তের ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো সিরিজটির স্বত্ব নিয়ে রীতিমতো অলিখিত লড়াইয়ে নেমেছিল। মুক্তির পর বোঝা গেল কেন এই কাড়াকাড়ি। টান টান চিত্রনাট্য, দুর্দান্ত অভিনয়, অ্যাকশন আর রোমাঞ্চের মিশেলে এটি হয়ে উঠেছে বছরের অন্যতম সেরা থ্রিলার সিরিজ।
উপন্যাস প্রকাশের পাঁচ দশকের বেশি সময় পরে তৈরি হয়েছে সিরিজটি। অনুমিতভাবেই প্রচুর বদল করেছেন নির্মাতা। তবে এই বদলের বেশির ভাগই প্রযুক্তিগত, সেটা আরোপিত মনে হয় না বরং মূল উপন্যাসের পাঁড়ভক্তও বলবেন, এটাই হওয়ার ছিল।
গল্পের শুরু জার্মানিতে। রহস্যময় আততায়ী জ্যাকেলের মিশন এক প্রভাবশালী রাজনীতিবিদকে হত্যা। মিশন সফল, মোটা অঙ্কের পারিশ্রমিক পায় সে। জ্যাকেলের স্ত্রী স্প্যানিশ। এক কন্যা, মা আর ভাইকে নিয়ে সে থাকে স্পেনের সেভিয়ায়। জ্যাকেলকে চার্লস নামে চেনে স্ত্রী। চার্লসকে অবশ্য তার স্ত্রী-কন্যারা কাছে পায়ই না বলতে গেলে। কী এমন কাজ তার বাড়িতে থাকা হয় না? ধীরে ধীরে স্ত্রীও সন্দেহ করে জ্যাকেলকে।
এদিকে জ্যাকেলের খোঁজে মরিয়া ব্রিটিশ গোয়েন্দা কর্মকর্তা বিয়াঙ্কা। কোনোভাবেই তিনি তার পাত্তা পান না। এত দূর থেকে এমন নির্ভুল নিশানা কার, ধন্দে পড়ে যান বিশেষজ্ঞরা। অবশেষে একটু আলোর রেখা খুঁজে পান বিয়াঙ্কা। অন্যদিকে জ্যাকেল পায় এক নতুন মিশন। বহুল আলোচিত এক উদ্যোক্তাকে খুন করতে হবে। সে কি সফল হবে নাকি তাকে ধরে ফেলবেন বিয়াঙ্কা?
প্রতি সপ্তাহেই ওটিটিতে এন্তার থ্রিলার কনটেন্ট মুক্তি পায়, এর মধ্যে ‘দ্য ডে অব দ্য জ্যাকেল’ কেন আলাদা? চিত্রনাট্য, অভিনয় আর প্রায় নিখুঁত নির্মাণই এটিকে অন্য থ্রিলারের চেয়ে আলাদা করেছে। অন্য থ্রিলারের মধ্যে এখানে চোর-পুলিশের ইঁদুর–দৌড়, দুর্দান্ত অ্যাকশন, ধাওয়ার দৃশ্য, চমক, পরতে পরতে রোমাঞ্চ সবই আছে, তবে গোয়েন্দা আর আততায়ীর ব্যক্তি জীবনের গল্প দেখিয়ে এগিয়ে গেছে দ্য ডে অব দ্য জ্যাকেল। অনেক থ্রিলার কেবল চমক আর রোমাঞ্চের দিকে মনোযোগ দেয় কিন্তু এখানে নির্মাতারা পারিবারিক ড্র্রামার ওপরও সমান জোর দিয়েছেন। জ্যাকেল আর বিয়াঙ্কার পরিবার, টানাপোড়েন, মানসিক দ্বন্দ্ব সমানভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। মূলত থ্রিলার সিরিজ হলেও ‘দ্য ডে অব দ্য জ্যাকেল’-এ তাই ড্রামার প্রাধান্য আছে ভালোভাবেই। প্রতিটি পর্বের দৈর্ঘ্য গড়ে ৫০ মিনিট, দুর্দান্ত চিত্রনাট্যের জন্যই দেখতে বিরক্ত লাগে না।
গত দুই দশকের অন্যতম সেরা ব্রিটিশ অভিনেতার একজন এডি রেডমেইন। মঞ্চ, টিভি বা চলচ্চিত্র—বৈচিত্র্যময় চরিত্রে হাজির হয়ে চমকে দিয়েছেন বারবার। অস্কারজয়ী এই তারকা ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছেন কয়েকটি বায়োপিকে অভিনয় করে। এই সিরিজে ঠান্ডা মাথার আততায়ীর চরিত্রেও তিনি দুর্দান্ত। তাঁর চাহনি, কথা বলা, অ্যাকশন আর অভিব্যক্তি দেখে মনে হয়েছে তাঁর কথা ভেবেই জ্যাকেল চরিত্রটি লেখা হয়েছে।
গোয়েন্দা চরিত্রে লাশানা লিঞ্চও অনবদ্য। অ্যাকশন দৃশ্য ছাড়াও পারিবারিক আবেগের মুহূর্তগুলোয় তাঁর অভিব্যক্তি ছিল দেখার মতো। কিছু দৃশ্যে কোনো সংলাপ ছিল না। পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে প্রবল ধন্দে ছিল বিয়াঙ্কা। এ দৃশ্যগুলোতেও নিজের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা দারুণভাবে তুলে ধরেছেন লাশানা। আগে ‘জেমস বন্ড’ সিনেমায় অভিনয় করেছেন, এই সিরিজে নিশ্চিতভাবেই সেই সিনেমার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছেন।
অভিনয় নিয়ে বলতে গেলে উরসুলা কর্বাতুর কথাই বা বাদ যাবে কেন। ‘মানি হেইস্ট’ দিয়ে দুনিয়াজুড়ে পরিচিতি পেয়েছেন এই স্প্যানিশ অভিনেত্রী। এই সিরিজে তাঁকে দেখা গেছে সাধারণ এক গৃহবধূর চরিত্রে। সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী চরিত্রে তাঁর পারফরম্যান্স ছিল দারুণ।
আলাদা করে বলতে হবে সিরিজের সিনেমাটোগ্রাফি আর অ্যাকশন নিয়ে। ইউরোপের নানা প্রান্তে শুটিং হয়েছে। প্রতিটি শহর, সেই শহরের মানুষ এখানে যেন হাজির হয়েছে আলাদা চরিত্রে হিসেবে। অ্যাকশন দৃশ্যগুলোর কোরিওগ্রাফি করা হয়েছে খুবই বুদ্ধিদীপ্তভাবে।
চিত্রনাট্যকার, নির্মাতা, প্রযোজকসহ নানা ভূমিকায় ‘টপ বয়’, ‘ফেস’, ‘পাবলিক এনিমিজ’, ‘গানপাউডার’সহ আলোচিত সব সিনেমা-সিরিজে কাজ করেছেন রোনান বেনেট। এই সিরিজও তাঁর ক্যারিয়ারের উল্লেখযোগ্য কাজ হয়ে রইল। বহুল পঠিত উপন্যাস অবলম্বনে সিরিজ বানিয়েও ঠিকই নিজের ছাপ রাখতে পেরেছেন তিনি।
মোটাদাগে বেশ ভালো হলেও টুকটাক কিছু দুর্বলতাও আছে। পঞ্চম ও ষষ্ঠ পর্বে কিছুটা মন্থর হয়ে শেষ দিকে আবার গতি পেয়েছে।
গত ৭ নভেম্বর মুক্তি পেয়েছিল ‘দ্য ডে অব দ্য জ্যাকেল’-এর প্রথম পর্ব, শেষ পর্ব এসেছে ১২ ডিসেম্বর। এর মধ্যেই সিরিজটির দ্বিতীয় মৌসুমের ঘোষণা এসেছে। শীত শীত আবহাওয়ায় জ্যাকেলের সঙ্গে রোমাঞ্চযাত্রায় চাইলে সঙ্গী হতে পারেন আপনিও।