মানুষের অবহেলাই সেন্টুর শক্তি, সে–ই এখন তারকা
‘আমার মা একটি সেলাই মেশিন দিয়ে দরজির কাজ করে আমাকে এই পর্যন্ত নিয়ে আসেন...।’ কথাগুলো কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন তরুণ অভিনেতা আবদুল্লাহ আল সেন্টু। ২০২৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। সেদিন চ্যানেল আই ডিজিটাল মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড ২০২২-এর বেস্ট রাইজিং স্টার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন এই অভিনেতা। চ্যানেল আইয়ের চেতনা চত্বরে আয়োজিত আইসিটি ডিভিশন প্রেজেন্টস অনুষ্ঠানে তাঁর হাতে এ পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। পুরস্কার গ্রহণ করে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। আজ ৫ মার্চ তরুণ এই অভিনেতার জন্মদিন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন এই অভিনেতাকে। গ্ল্যামার নয়, শুধু অভিনয় দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। বিনোদন জগতে সেন্টুর আলাদা পরিচিতি। জন্মদিনে আবার জানব সেন্টুর উঠে আসার গল্প; কষ্টের সেই দিনগুলোর কথা।
সেই শনিবার সন্ধ্যার কথা মনে পড়ছে। সেন্টুর জীবনের গল্প শুনে অনেকে আপ্লুত হয়েছিলেন। পুরস্কার গ্রহণ করতে গিয়ে মা ও মামিকে নিয়ে মঞ্চে উঠেছিলেন সেন্টু।
অভিনয় করে প্রথম পুরস্কার পাওয়ার অনুভূতি জানতে চাইলে আবদুল্লাহ আল সেন্টু বলেন, ‘আমি গর্বিত এমন একজন মা পেয়ে। বাবা মারা যাওয়ার পর আমার মা একটি সেলাই মেশিন দিয়ে আমাকে এ পর্যন্ত এনেছেন। গ্রামের অনেকেই অনেক কথা বলেছেন। কিন্তু মা আমার এগিয়ে চলায় সহযোগিতা করেছেন। আমাকে ঘৃণা করা ও ভালোবাসা দুই পক্ষের কাছেই চিরকৃতজ্ঞ। ভালো কাজ করে যেতে চাই, ভালো মানুষ হতে চাই।’
সেন্টুকে এখন সবাই চেনে। বিশেষ করে দেশের ওটিটি অঙ্গনে তাঁর আলাদা পরিচিতি ও চাহিদা রয়েছে। কিছু চরিত্রের জন্য সেন্টুর কথা আলাদা করে ভাবেন নির্মাতারা। নিজেও নির্মাণের সঙ্গে জড়িত। এই সেন্টু একদিন অভিনয় না জেনেই শৈশবে নাট্য প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পুরস্কার জিতেছিলেন। সেন্টুদের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে। ২০০৯ সালের ঘটনা। স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে সেন্টু জানিয়েছেন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় একটি নাট্য উৎসবের আয়োজন করা হয়। সেখানে তাঁরা ১২ জনের দল অংশ নেয়। তখনো অভিনয়ের কিছুই জানতেন না। ছেলেদের মেয়ে সাজিয়ে, দাড়ি-গোঁফ লাগিয়ে অভিনয় করেন তাঁরা। সেন্টুই নির্দেশনা দেন। তখন বড়রা সেন্টুদের চেষ্টার প্রশংসা করেছিলেন। অনেকেই পরামর্শ দেন থিয়েটারে অভিনয় শেখার। ঘটনাচক্রে ১৫৩ জনের মধ্য থেকে চন্দ্রবতী থিয়েটারে অভিনয় শেখার সুযোগ পান।
২০১৬ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে সেন্টু চলে এলেন ঢাকায়। ঢাকার কবি নজরুল কলেজে ভর্তি হয়ে শুরু হলো অভিনেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার দৌড়। কিশোরগঞ্জের এক থিয়েটারকর্মী পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন মেকআপ আর্টিস্ট রতন সরকারের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন ‘সাদা কাগজে সাজানো অনুভূতি’ নাটকের সেটে । রতন সরকার সেন্টুকে যথাসম্ভব সাহায্য করেছিলেন। সেদিন বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য হাতে গুজে দিয়েছিলেন ২০০ টাকা।
প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন দেখে ভর্তি হন আরণ্যকের ওয়ার্কশপে। সেন্টু তখন শিল্পকলা একাডেমি কোথায়, সেটাও চিনতেন না। ওয়ার্কশপের মধ্যেই চিকনগুনিয়ায় আক্রান্ত হলেন। তবু একটা দিন এক সেকেন্ডও দেরি করেননি, ক্লাস মিস করেননি। এরপর সৈয়দ জামিল আহমেদের নির্দেশনায় কাজ করলেন ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’র ব্যাকস্টেজে । এরপর একে একে মাসুদ আহমেদের একটা স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা, শামসুদ্দীন আহমেদের সিনেমা ‘বিয়ন্ড ইকুয়েশন’, খন্দকার সুমনের গণ–অর্থায়নের ছবি ‘সাঁতাও’ এ অভিনয় করেন । চলতে থাকে টুকটাক সিনেমা, স্বল্পদৈর্ঘ্যের সিনেমায় অভিনয়।
এভাবে সবার প্রেরণায় একসময় অভিনয় শুরু করেন আবদুল্লাহ আল সেন্টু। কিন্তু বারবার হোঁচট খেতে থাকেন। এর মধ্যেই সাফল্য হয়ে ধরা দেয় ‘বাংকার বয়’, ‘শুক্লপক্ষ’, ‘কারাগার’সহ একাধিক কাজ। এবারই প্রথম তিনি নিজের কাজের জন্য সম্মানিত হলেন। বাংলাদেশের প্রথম স্পিন-অফ সিরিজ ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’-এর প্রধান চরিত্র অ্যালেন স্বপনের ছেলে জাদু চরিত্রে অভিনয় করে সাড়া ফেলেছেন সেন্টু। পর্দায় উপস্থিতির সময় কম হলেও এতেই দর্শকদের মুগ্ধ করেছে জাদু চরিত্রটি।
প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেন্টু বলেছেন, ‘প্রথম দিকে পরিবার থেকে বলত, আমি বড় ছেলে। বাবা মারা গিয়েছেন। ছোট বোন আছে। মা দরজির কাজ করে যা পেতেন, তা-ই দিয়ে আমাদের সংসার চলত। মা চাইতেন সংসারে একটু সাহায্য করি। তখন গ্রামের মানুষও মাকে নানা রকম উল্টাপাল্টা বোঝাত। আমিও মাকে বোঝাতাম—তোমার দরজির কাজ আর আমার অভিনয়ের টুকটাক আয়ের টাকা দিয়ে ডালভাত খেয়ে চলতে পারব। আমি তো চুরি, বাটপারি, মানুষ ঠকানো, দুই নম্বরি করে আয় করছি না। তখন মা সায় দিতেন। আমাদের কাছে মনে হয় সুখে থাকার জন্য বেশি কিছু দরকার নেই। গ্রামের কেউ কেউ মাকে উল্টাপাল্টা বোঝানোর চেষ্টা করতেন। তাঁরা বলতেন, সেন্টু কালো, খাটো। ও মিডিয়ায় কিছু করতে পারবে না। খামাখা জীবনটা নষ্ট করবে। এসব কথা শুনে অনেক কষ্ট লাগত। মানুষের অবহেলাই আমাকে সাহস ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। আমার মধ্যে জেদ কাজ করত, আমি কেন পারব না!’
সেন্টুকে সবশেষ দেখা গেছে নুহাশ হুমায়ূনের ‘২ষ’ সিরিজে। চরকির এই সিরিজের প্রথম পর্ব ‘ওয়াক্ত’–এও দারুণ অভিনয় করেন তিনি। বিশেষ করে মায়ের সঙ্গে খাবারের একটি দৃশ্য নিয়ে ব্যাপকভাবে চর্চা হয়। চলতি বছরও ওটিটির বেশ কয়েকটি প্রকল্পকে দেখা যাবে এই তরুণ অভিনেতাকে।