‘ধ্বংসযজ্ঞ দেখে মনে হচ্ছে, এই আন্দোলন শেষ হতে অনেক দেরি’

অগ্নিসংযোগ ও সাম্প্রদায়িক হামলার খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন শিল্পীরাকোলাজ

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদে ইস্তফা দিয়ে দেশ ছেড়েছেন শেখ হাসিনা। সোমবার হাসিনার পতনের পর দেশজুড়ে বিজয়ের উল্লাসে মেতেছেন নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ। এর মধ্যে সরকারি স্থাপনা ভাঙচুর, আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ ও সাম্প্রদায়িক হামলার খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন শিল্পীরা। ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বেরিয়ে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা।
ঢাকাই সিনেমার অভিনেতা মঙ্গলবার এক ফেসবুক পোস্টে শাকিব খান লিখেছেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সবার চাওয়া পূরণ হয়েছে। এখন এই জয়ের আন্দোলন যেন আমাদের দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা আর দায়বদ্ধতা ম্লান করে না দেয়। সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।’
শাকিব খান আরও লিখেছেন, ‘মনে রাখতে হবে, সবার আগে দেশ, দেশের মানুষ ও দেশের ভাবমূর্তি এবং দেশের সম্পদ। জাতি–ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে দেশের সব মানুষ যেন নিরাপদে থাকে এবং দেশের সম্পদ সুরক্ষিত থাকে, সেই চেষ্টা চালিয়ে যাই। এটি আমাদের নৈতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছোট পর্দার অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরীরও সমর্থন ছিল। সোমবার বাংলাদেশের পতাকা হাতে বিজয়ের মিছিলে নেমেছিলেন তিনি। মেহজাবীন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছাত্রদের এই আন্দোলন ছিল যৌক্তিক, সঠিক। এ কারণেই সঙ্গে ছিলাম। এত ত্যাগের বিনিময়ে ৫ আগস্ট বিজয় হয়েছে ছাত্র-জনতার। সেই বিজয়ের আনন্দ-উৎসবে আমিও মাঠে ছিলাম।’

বিজয়ের কিছু সময় না যেতেই কিছু চিত্র দেখে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলে দেয়, মন খারাপ করে দেয় এই অভিনেত্রীর। তিনি বলেন, ‘৫ আগস্ট দুপুরের পর থেকে দেখলাম, গণভবন থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় ভাঙচুর লুট চলছে। নিজে চোখে একটা জায়গায় দেখলাম, একটা ছোট টংদোকান লুট করা হলো, এরপর আগুন দেওয়া হলো। দেখে ব্যথিত হয়েছি। এই যুদ্ধের জার্নি তো এমন ঘটনার জন্য ছিল না।’

মেহজাবীন চৌধুরী
কোলাজ

ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিজয় এনেছেন ছাত্র–জনতা। বিজয়ের পর সাম্প্রদায়িক হামলার খবরে স্তব্ধ হয়েছেন তিনি।
‘এটি তো হতে পারে না। নতুনভাবে দেশ স্বাধীন হলো, এটি একটি ঐতিহাসিক ব্যাপার আমাদের জন্য; কিন্তু এখন যা হচ্ছে তা আমরা চাইনি, এটি বিজয়ের ফসল নয়। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশের এসব খবর দেখে মনে হচ্ছে, বাইরে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। রাস্তায় কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নেই। নিজের নিরাপত্তা নিয়েও এখন শঙ্কা লাগছে। এমন বাংলাদেশ চাইনি আমরা। ছাত্র-তরুণদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার দিকে এখনই ফিরতে হবে সবার, তা না হলে স্বপ্ন ব্যর্থ হবে।’ বলেন মেহজাবীন চৌধুরী।

ব্যান্ডতারকা জোহাদ রেজা চৌধুরী

ব্যান্ডতারকা জোহাদ রেজা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছাত্ররা সবাইকে দেখিয়েছে, সাহস কী এবং এটি আপনাকে কতদূর নিয়ে যেতে পারে। আমি চাই, সেনাবাহিনী এবং যাঁরা জড়িত আছেন, তারা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিন এবং সারা দেশে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনুক। এই বাংলাদেশ সবার। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান প্রত্যেকের। নতুন করে শুরু করতে হবে। আসুন, আমরা একে অপরকে নিরাপদ রাখি এবং আমাদের দেশের সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে।’
অভিনেত্রী রাফিয়াত রশিদ মিথিলা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘স্বাধীনতা মানে দায়িত্বশীলতা। নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার প্রত্যয়। ন্যায়বিচার ও সাম্যের দেশ গড়া। আমাদের সন্তানদের, ছাত্রদের ত্যাগের কথা যেন ভুলে না যাই।’
আরেক পোস্টে মিথিলা লিখেছেন, ‘সকল ধর্মীয় উপাসনালয়, রাষ্ট্রীয় সম্পদ আমাদের রক্ষা করতে হবে। এতদিনের আন্দোলন আর রক্তের বিনিময়ে আমরা ধ্বংসযজ্ঞ, সহিংসতা চাই না। ভুলে যাবেন না, ছাত্রদের এই আন্দোলনের নাম ‘বৈষম্যবিরোধী’ আন্দোলন। সব বৈষম্য দূর করে গণতান্ত্রিক ও সাম্যের রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরির আন্দোলন। আজকে বিজয়ের নামে ধ্বংসযজ্ঞ দেখে মনে হচ্ছে, এই আন্দোলনের শেষ হতে অনেক দেরি। যারা নাগরিকদের সম্পদ ও শিল্প ধ্বংস করছে, যারা মানুষের (সে যেকোনো ধর্ম, বর্ণ, পেশার মানুষই হোক না কেন) ওপর সহিংসতা করছে, তাদের বিচারের আওতায় আনা হোক, তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন অব্যাহত থাকুক।’

রাফিয়াত রশিদ মিথিলা
খালেদ সরকার

শিক্ষার্থীরা একতাবদ্ধ হয়ে সাহস নিয়ে যেভাবে এগিয়েছেন, এটা সংগীতশিল্পী এলিটা করিমকে অনুপ্রাণিত করেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা বিজয় উদ্‌যাপন করব, কিন্তু গতকাল (সোমবার) সেই বিজয়ের মুহূর্তে যখন দেখলাম, গণভবন থেকে অনেকেই লুটপাট করছিল। কেউ টিভি, কেউ চেয়ার–টেবিল যা পাচ্ছে নিয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হয়, এগুলো সুবিধাবাদী লোক। এটা কোনো শিক্ষার্থীর কাজ হতে পারে না। এরাই আবার সংসদ ভবনে প্রবেশ করে ধূমপান করছিল। ৩২ নম্বরের বাড়িটা দেশের ঐতিহাসিক জায়গা। সেটা নষ্ট করায় আমি মর্মাহত হয়েছি। কারণ আপনি যা–ই করেন না কেন, যে পক্ষেই থাকেন না কেন, আপনি ইতিহাসকে অস্বীকার করতে পারবেন না। যেটা হয়ে গেছে।’
এলিটা করিমের ভাষ্যে, ‘সবার মধ্যেই ক্ষোভ রয়েছে, এটাও বুঝতে পারছি; কিন্তু মনে রাখতে হবে যারা বিজয় এনে দেয়, তাদের স্থান সব সময় অনেক ওপরে থাকে। এখন জাতীয় কোনো সম্পদ পোড়ানো, বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ভেঙে দেওয়া, এর বাইরে আরও অনেকের মূর্তি ভেঙে ফেলা হচ্ছে শুনলাম। আমাদের সংখ্যালঘুদের ওপর আঘাত হানা হচ্ছে, এ ঘটনাগুলো মর্মাহত করেছে। ’
এসব খারাপ খবরের মাঝে কিছু খবরে আশার আলো দেখছেন এলিটা করিম। তিনি বলেন, ‘সকাল থেকে ভালো লাগছে। আমাদের শিক্ষার্থীদের দেখলাম, সংসদ ভবন পরিষ্কারের দায়িত্ব নিয়েছে। রাস্তায় কোনো ট্রাফিক পুলিশ না থাকায় সেই দায়িত্ব কোনো কোনো জায়গায় পালন করছেন শিক্ষার্থীরা। আবার যেসব মানুষ গণভবন থেকে নিয়ে গিয়েছিল সেগুলো কেউ কেউ ফেরত দিয়ে যাচ্ছেন। এগুলো যে জাতীয় সম্পদ সেটা বোঝার উপলব্ধি হয়েছে, এটাও ভালো লেগেছে। একজন সংগীতের মানুষ হিসেবে একটাই প্রত্যাশা—নতুন বাংলাদেশ ভালো দিকে যাবে।’

এলিটা করিম
শিল্পীর সৌজন্যে

অভিনয়শিল্পী ইমতিয়াজ বর্ষণকে এই আন্দোলনে রাজপথে দেখা গেছে। তিনি বলেন, ‘এই বিজয় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফসল। এটা ছাত্রজনতার গণ–অভ্যুত্থান; কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের পর সংসদ ভবন, পিএম অফিস, গণভবনকে এভাবে অরক্ষিত রেখে লুটপাট করতে দেওয়ার কোনো মানে খুঁজে পেলাম না। আমাদের দেশের শতভাগ লোক সুসভ্য আচরণ করবে, তেমন আশা আমি করি না। এটা সেই সময়ে নীতিনির্ধারকদের বোঝা উচিত ছিল। আমি মনে করি, এই আন্দোলনে এক নতুন সৃষ্টিশীল প্রজন্মের জন্ম হয়েছে। যারা সত্যি কথা বলে। নতুন নতুন সংগীতশিল্পীর জন্ম হয়েছে, যারা গানে গানে প্রতিবাদ করে উদ্বুদ্ধ করে। এক অসাধারণ সময়ের মধ্য দিয়ে সময় পার করছি। কিছু নির্বোধের হঠকারিতায় এই আন্দোলন যেন বিফলে না যায়, সেই প্রত্যাশা রাখি। এই আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী সবাইকে আগামী দিনের নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য আগাম শুভেচ্ছা। যে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনায় এগিয়ে যাবে। দল–মতনির্বিশেষে সত্যিকারের জনগণের দেশ হবে।’

ইমতিয়াজ বর্ষণ
ছবি : প্রথম আলো