মানুষের প্রকৃত জীবনসত্য বুঝতে চাই: তানভীর মোকাম্মেল

তানভীর মোকাম্মেল
ছবি : সংগৃহীত

দেশের সিনেমার তখন রমরমা বাজার। একের পর এক সিনেমা হচ্ছে। সেগুলো মুক্তি পাচ্ছে, দর্শক সিনেমা দেখতে ভিড় করছেন। নানা ধরনের গল্প থেকে নির্মিত চলচ্চিত্র দর্শকের মনে দাগ কেটেছে। এর মধ্যেই পর্দায় জীবনের বাস্তবতাকে তুলে ধরার জন্য ভিন্ন পথে হাঁটেন পরিচালক তানভীর মোকাম্মেল। তিনি বেছে নেন তথ্যচিত্র। তখন হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগোচ্ছিল তথ্যচিত্র। সিনেমার পাশাপাশি সেই তথ্যচিত্রকে নতুনভাবে দেশের দর্শকের সঙ্গে পরিচিত করেছেন, নতুন ভাষা দিয়েছেন তিনি। তানভীর মোকাম্মেলের সেই তথ্যচিত্র নির্মাণের ক্যারিয়ার দেখতে দেখতে তিন দশকে পৌঁছে গেল। ক্যারিয়ারের বিশেষ এই সময়কে স্মরণ করে রাখতে নানা আয়োজন করছে বাংলাদেশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন।

তথ্যচিত্র নিয়ে বলতে গিয়ে ৯০ দশকের শুরুর সময়ে ফিরে গেলেন তানভীর মোকাম্মেল। বললেন, তথ্যচিত্র নির্মাণের জন্য সময়টা চ্যালেঞ্জিং ছিল। কারণ, তখন তথ্যচিত্র সেভাবে নির্মিত হতো না। নানা বাধায় অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একেকটি তথ্যচিত্র আলোর মুখ দেখত।

বিশ্বের সেরা সব টিভি চ্যানেল বিবিসি, ডিসকভারি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি এরা নিয়মিত প্রামাণ্যচিত্র দেখায় এবং এ দেশের দর্শকেরাও সেসব আনন্দের সঙ্গেই দেখে থাকেন। আসলে বাংলাদেশের টিভি আমলারা বাক্সের বাইরে চিন্তা করতে পারেন না

বাংলাদেশে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করাটা কঠিন। প্রদর্শনের তেমন সুযোগ নেই, লগ্নিকারক পাওয়া কঠিন, সেখানে দীর্ঘ তিন দশক কাজ করে যাওয়াটা কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল? এমন প্রশ্নে তানভীর মোকাম্মেল বলেন, ‘প্রধান সমস্যা ছিল অর্থের। যে কারণে আমার কিছু কিছু প্রামাণ্যচিত্র খুবই স্বল্প বাজেটে তৈরি। তবে ওইটুকু অর্থ সংগ্রহ করাও ছিল বেশ কঠিন কাজ। কিছু ছবির ক্ষেত্রে তো খুবই সমস্যা ছিল। যেমন সাতচল্লিশের দেশভাগের ওপর সীমান্তরেখা বা মুক্তিযুদ্ধের ওপর মেগাপ্রামাণ্যচিত্র ১৯৭১ তথ্যচিত্রগুলো নির্মাণের জন্য অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে।’

আরও পড়ুন

সেই সময় যখন অর্থের জন্য বিনিয়োগকারীদের কাছে গিয়েছিলেন, তাঁরা কী বলতেন? এ প্রসঙ্গে তানভীর মোকাম্মেল বলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল বলেই এ দেশের কোনো কোনো মানুষ হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ওপর কোনো ছবির ব্যাপারে আমি যখন তাদের কাছে কিছু অর্থ চেয়েছি, তাঁরা বলেছেন, এখন ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না।’

প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের পরও সমস্যার শেষ নেই। সেই ৯০ দশক থেকেই প্রামাণ্যচিত্রের প্রদর্শনীর জন্য নানা সমস্যায় পড়তে হয়েছে। সেসব সমস্যা এখনো রয়েছে। দর্শকদের দেখানোর জন্য সংগ্রাম করতে হয়। এ প্রসঙ্গে তানভীর মোকাম্মেল বলেন, ‘বড় একটা সমস্যা প্রামাণ্যচিত্র দেখানো। দেশে ৩৬টা টেলিভিশন চ্যানেল থাকলেও একটা চ্যানেলও প্রামাণ্যচিত্র তেমন দেখায় না। আমার মনে আছে, একবার এক প্রাইভেট টিভি চ্যানেলের কর্তাব্যক্তিকে আমি বলেছিলাম, “ডকুমেন্টারি ফিল্ম দেখান না কেন?” তিনি এমনভাবে বলেছিলেন যেন ডকুমেন্টারি ফিল্ম এটা অচ্ছুত নিম্নবর্গের কিছু। তখন আমি তাঁকে বলেছিলাম, বিশ্বের সেরা সব টিভি চ্যানেল বিবিসি, ডিসকভারি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি এরা নিয়মিত প্রামাণ্যচিত্র দেখায় এবং এ দেশের দর্শকেরাও সেসব আনন্দের সঙ্গেই দেখে থাকেন। আসলে বাংলাদেশের টিভি আমলারা বাক্সের বাইরে চিন্তা করতে পারেন না।’

আপনি যখন একটা প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেন, তখন আবার এ দেশের বস্তি, দারিদ্র্য, মাস্তান, পুলিশ, আমলাতন্ত্র, দুর্নীতি, ট্রাফিক জ্যাম, বাংলাদেশের প্রকৃত বাস্তবতায় ফিরে আসতে বাধ্য হন। নিজের দেশের বাস্তব জমিনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারাটা একজন শিল্পীর জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বদেশ ও স্বকালের মাটিতে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারা। সে কারণেই আমি চেষ্টা করি, একটা কাহিনিচিত্রের পর একটা প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করার

গত ৩০ বছরে কাহিনিচিত্রের পাশাপাশি ১৫টি মতো প্রামাণ্যচিত্র বানিয়েছেন তানভীর মোকাম্মেল। সেসব কাজে কখনো উঠে এসেছে দেশভাগের গল্প, কখনো মুক্তিযুদ্ধের কথা, কখনো দেশের হারিয়ে যাওয়া নদীর গতি ও প্রকৃতির কথা। শুধু প্রান্তিক মানুষই নয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থেকে তাজউদ্দীন আহমদসহ গুণী ব্যক্তিদের জীবনের নানা কর্মকাণ্ড জায়গা পেয়েছে এসব প্রামাণ্যচিত্রে।

তানভীর মোকাম্মেল বলেন, ‘একজন শিল্পী হিসেবে আমার লক্ষ্য থাকে মানুষের জীবনের প্রকৃত জীবনসত্যকে তুলে ধরা। এখন সত্যকে আপনি সিনেমায় দুইভাবে তুলে ধরতে পারেন। ভালো গল্প, ভালো চিত্রনাট্য, দক্ষ অভিনেতা-অভিনেত্রী, সঠিক লোকেশন ও যথার্থ মিজ-অঁ-সিনের মাধ্যমে কাহিনিচিত্রে আপনি বাস্তবতাকে অনেকখানিই ফুটিয়ে তুলতে পারেন। কেউই বলবে না যে পথের পাঁচালী বা চিত্রা নদীর পারে বাস্তব ছবি নয়। তবে প্রামাণ্যচিত্রে বাস্তবতাকে তুলে ধরা যায় আরও সরাসরি ও জীবন্তভাবে।’

আরও পড়ুন

দর্শকমনে প্রামাণ্যচিত্র কতটা গুরুত্ব বহন করে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমার নির্মিত অচিন পাখী, ১৯৭১, তাজউদ্দীন আহমদ: নিঃসঙ্গ সারথি, কর্ণফুলীর কান্না, স্বপ্নভূমি বা সীমান্তরেখা—এসব প্রামাণ্যচিত্রের ঐতিহাসিক ও সামাজিক তাৎপর্য ভবিষ্যতেও রয়ে যাবে। এখন মনে হয় একজন প্রামাণ্যচিত্রকার হিসেবে কাজগুলো হয়তো অসফল নয়।’

তানভীর মোকাম্মেল
ছবি : সংগৃহীত

সবশেষে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া, এত বাধা পেরিয়ে কেন তথ্যচিত্র নির্মাণ করে গিয়েছেন? এই পরিচালক বলেন, ‘প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করতে আমার ভালো লাগে। বিভিন্ন পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে মানুষ কীভাবে আচরণ করে, সেটা দেখানোই আমার লক্ষ্য থাকে। এর মধ্য দিয়ে হিউম্যানিটি ইন ডিফারেন্ট কন্ডিশনস তুলে ধরা যায়। এ ছাড়া আমাকে আকর্ষণ করে সত্য। মানুষের প্রকৃত জীবনসত্য আমি বুঝতে চাই। প্রামাণ্যচিত্র তৈরির অবশ্য একটা শৈল্পিক কারণও আছে।’

সেই শৈল্পিক কারণ কী, সেটিও ব্যাখ্যা করলেন তানভীর মোকাম্মেল, ‘লোকে আমার কাহিনিচিত্র চিত্রা নদীর পারে বা লালসালুকে হয়তো বাস্তব ছবিই বলবেন। কিন্তু আমি তো জানি, আমি একটা চিত্রনাট্য লিখেছি, সে চিত্রনাট্য অনুযায়ী কেউ সংলাপ বলেছেন, ড্রেস, প্রপস ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে কৃত্রিমতার একটা ছোঁয়া কোথায় যেন লেগেই থাকে এবং একটার পর একটা কাহিনিচিত্র তৈরি করতে থাকলে আপনি শিল্পের এক কৃত্রিম বায়বীয় জগতে চলে যেতে পারেন। কিন্তু আপনি যখন একটা প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেন, তখন আবার এ দেশের বস্তি, দারিদ্র্য, মাস্তান, পুলিশ, আমলাতন্ত্র, দুর্নীতি, ট্রাফিক জ্যাম, বাংলাদেশের প্রকৃত বাস্তবতায় ফিরে আসতে বাধ্য হন। নিজের দেশের বাস্তব জমিনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারাটা একজন শিল্পীর জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বদেশ ও স্বকালের মাটিতে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারা। সে কারণেই আমি চেষ্টা করি, একটা কাহিনিচিত্রের পর একটা প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করার।’

তথ্যচিত্র দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু হলেও গত ৩০ বছরে নদীর নাম মধুমতী, চিত্রা নদীর পারে, লালসালু, লালন, রাবেয়া, জীবনঢুলী ও রূপসা নদীর বাঁকের মতো সিনেমা উপহার দিয়েছেন। উল্লেখযোগ্য তথ্যচিত্রের মধ্যে স্মৃতি একাত্তর, একটি গলির আত্মকাহিনী, অচিন পাখী, কর্ণফুলীর কান্না, স্বপ্নার স্কুল, তাজউদ্দীন আহমদ: নিঃসঙ্গ সারথি, জাপানী বধূ, ১৯৭১, সীমান্তরেখা, মধুমতী পারের মানুষটি: শেখ মুজিবুর রহমান ইত্যাদি।

বৈচিত্র্যময় এসব কাজের জন্য একুশে পদক ও ১০ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। নির্মাতার ক্যারিয়ারের তিন দশক উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে সোমবার থেকে বুধবার প্রতিদিন বিকেল ৫টা থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত উন্মুক্ত তথ্যচিত্র প্রদর্শনী ও পরিচালকের নির্মাণসহ ক্যারিয়ারের নানা প্রসঙ্গে আলোচনা হবে। প্রসঙ্গত, গত বছর ক্যারিয়ারের তিন দশক পেরোলেও করোনার কারণে সে সময় কোনো অনুষ্ঠান করা হয়নি। এবার ৮ মার্চ তানভীর মোকাম্মেলের ৬৪তম জন্মদিন। বিশেষ দিনটিকে ধরে তিন দশকপূর্তির আয়োজন করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন