৯৪তম অস্কার পুরস্কার: সবকিছু ছাপিয়ে চড়
অস্কারের ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো বধির অভিনেতার পুরস্কার, আবার একজন নারীর সেরা পরিচালক হওয়া, বহুদিন পরে তিনজনের উপস্থাপনা, দুই বোন সেরেনা ও ভেনাস উইলিয়ামসের রেড কার্পেটে হাঁটা—কত কিছুই না ছিল আলোচিত হওয়ার। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে সপাটে একটি চড়।
ইউরোপে যুদ্ধ। সকালেও সিএনএনের সাংবাদিকেরা ইউক্রেনের কিয়েভে জোরালো বোমাবর্ষণের শব্দ শুনেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসের ডলবি থিয়েটারে ৯৪তম অস্কার পুরস্কার অনুষ্ঠান চললেও সিএনএন তখনো ইউক্রেনে বোমার খবর দিচ্ছিল ব্রেকিং নিউজ হিসেবে। কে জানত কিছু পরে অস্কার মঞ্চে যা হলো, তা যেন ঠিক বোমাবর্ষণের মতোই। অভিনেতা উইল স্মিথ বড় বড় পদক্ষেপে হেঁটে গিয়ে সপাটে চড় মারলেন মঞ্চে উপস্থিত মার্কিন কমেডিয়ান ক্রিস রককে।
অথচ এবারের অস্কার নিয়ে আলোচনায় ওঠার মতো অনেক কিছুই ছিল। চড় মারার কয়েক মিনিট পরেই একই মঞ্চে আবার উঠেছিলেন উইল স্মিথ। তাঁর চোখের পানি, আবেগপ্রবণ বক্তব্য, প্রথম অস্কার জয়—এ নিয়েও আলোচনার অনেক কিছু ছিল। কিংবা অস্কারের ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো বধির অভিনেতার পুরস্কার, আবার একজন নারীর সেরা পরিচালক হওয়া, বহুদিন পরে তিনজনের উপস্থাপনা, দুই বোন সেরেনা ও ভেনাস উইলিয়ামসের রেড কার্পেটে হাঁটা—কত কিছুই না ছিল আলোচিত হওয়ার। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে সপাটে একটি চড়।
স্ত্রীর অপমানের প্রতিশোধ নিতে উইল স্মিথের চড় মারাকে আপনি কি সমর্থন করেন—এ নিয়ে তর্কবিতর্ক এক দফা শেষ। এক দল স্মিথের পক্ষে, অন্য দল যেকোনো ধরনের সহিংসতার বিপক্ষে। রসিকতার উত্তর চড় হলে অনেকেরই টিকে থাকা মুশকিল হবে। চড় মারা প্রশ্নে তারকারাও দুই ভাগ হয়ে আছেন। প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন সিনেমাজগতের বাইরের লোকজনও।
ক্রিস রক চড় খেয়েও হয়তো অনুষ্ঠানের স্বার্থেই বিষয়টি সামাল দিতে চেয়েছিলেন। সপক্ষে বলছিলেন কিছু কথা। এর প্রতি–উত্তরে স্মিথ মুদ্রণযোগ্য নয় এমন চার অক্ষরের একটি কথা উচ্চারণ করেন। এমনিতেই অনুষ্ঠান ছিল প্রায় শেষ পর্যায়ে। ফলে আনন্দমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠান শেষ হলেও চড় মারার রেশ রয়ে গেছে।
চড় মারার সেই ঘটনা
উইল স্মিথের স্ত্রী জাডা পিংকেট স্মিথ অ্যালোপেশিয়া নামের এক রোগে আক্রান্ত। এ রোগ হলে মাথার চুল পড়ে যায়। এ নিয়েই রসিকতা করেছিলেন ক্রিস রক। জাডাকে ক্রিস বলেছিলেন, ‘জাডা, জিআই জেন টু-এর জন্য তর সইছে না।’ জিআই জেন ১৯৯৭ সালের ছবি, যেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্রের অভিনয়শিল্পী ডেমি মুরের ছিল ন্যাড়া মাথার জর্ডান ও’নিলের চরিত্র। ক্রিস রক চড় খেয়েও হয়তো অনুষ্ঠানের স্বার্থেই বিষয়টি সামাল দিতে চেয়েছিলেন। সপক্ষে বলছিলেন কিছু কথা। এর প্রতি–উত্তরে স্মিথ মুদ্রণযোগ্য নয় এমন চার অক্ষরের একটি কথা উচ্চারণ করেন। এমনিতেই অনুষ্ঠান ছিল প্রায় শেষ পর্যায়ে। ফলে আনন্দমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠান শেষ হলেও চড় মারার রেশ রয়ে গেছে। এমনকি শারীরিক আঘাতের কারণে আইনি ব্যবস্থার প্রসঙ্গেও উঠেছে। তবে লস অ্যাঞ্জেলেস পুলিশ বিভাগ (এলএপিডি) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ক্রিস রক কোনো অভিযোগ করবেন না।
এক বছর আগেই উইল নামে আত্মজীবনী প্রকাশ করেন উইল স্মিথ। সেখানে উল্লেখ আছে পারিবারিক সহিংসতার নানা বিবরণ। ছেলেবেলায় দেখেছেন মাকে মারছেন বাবা। কিশোর বয়সে মায়ের প্রতি সহিংসতার ঘটনায় কোনো কিছু করতে না পারার আক্ষেপের কথা বলেছেন তিনি। ধারণা করা হচ্ছে, সেসব বিষয়ের প্রতিফলন আছে চড় মারার ঘটনায়। যদিও কেউ কেউ বলছেন, আত্মজীবনীতে স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কের নানা টানাপোড়েনের কথা উল্লেখ করেছেন স্মিথ, এমনকি অন্য মানুষের উপস্থিতির কথাও আছে। সব মিলিয়ে বিষয়টি নিয়ে চর্চা থাকবে বহুদিন।
সেরা উইল স্মিথই সন্দেহ নেই এবারের অস্কারের পুরোটা জুড়েই থাকছে উইল স্মিথ। যে মঞ্চে কিছুক্ষণ আগে অনাহূতের মতো ঢুকে পড়েছিলেন, সেই মঞ্চই পরে ডেকে আনল তাঁকে। কিং রিচার্ড ছবির রিচার্ড উইলিয়ামস চরিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি পেলেন সেরা অভিনেতার পুরস্কার। যুক্তরাষ্ট্রের টেনিস তারকা দুই বোন ভেনাস এবং সেরেনা ইউলিয়ামসের বাবার ভূমিকার অভিনয় করে এ পুরস্কার পান স্মিথ।পুরস্কার হাতে ধন্যবাদ জানিয়ে স্মিথ বলেন, ‘যেভাবে ভেনাস-সেরেনার বাবা তাঁদের এবং তাঁদের পরিবারকে আগলে রেখেছিলেন, তা প্রত্যেক মানুষেরই কর্তব্য। আমি এটা শিখেছি।’ ধারণা করা হচ্ছে, এ বক্তব্যের মাধ্যমে স্ত্রীকে ‘আগলে রাখার’ প্রতিই ইঙ্গিত করেছেন স্মিথ।এর আগেও দুবার অস্কারে মনোনয়ন পেয়েছিলেন উইল স্মিথ। এর মধ্যে পারস্যুট অব হ্যাপিনেস সিনেমায়ও তাঁর ভূমিকা ছিল এক বাবার।সেরা যাঁরানেটফ্লিক্স-এর বিভিন্ন সিনেমা এবার ২৭টি মনোনয়ন পেয়েছিল। কিন্তু জুটেছে মাত্র একটি। এর মধ্যে দ্য পাওয়ার অব দ ডগই পেয়েছিল সর্বোচ্চ ১২টি মনোনয়ন। কিন্তু পেয়েছেন কেবল সেরা পরিচালক।
অন্যদিকে অ্যাপল টিভির কোডা সব মিলিয়ে চারটি মনোনয়ন পেলেও ঠিকই সেরা ছবিসহ তিনটি পুরস্কার পেয়েছে। ১৯৩২ সালে গ্র্যান্ড হোটেল সিনেমা মাত্র চারটি মনোনয়ন নিয়ে সেরা হয়েছিল। সেই একই ঘটনা এবার ঘটল কোডার ক্ষেত্রে। সেরা অভিনেত্রীর অস্কার পেয়েছেন জেসিকা চ্যাস্টেন দ্য আইজ অব টেমি ফে ছবির জন্য। তবে অস্কারের আলো এবার চলে গেছে মূলত তিনজনের কাছে। তাঁদের মধ্যে শুরুতেই বলতে হবে নারী নির্মাতা জেন ক্যাম্পিয়নের নাম।
দ্য পাওয়ার অব দ্য ডগ-এর জন্য তিনি সেরা পরিচালক হয়েছেন। ২৮ বছর আগে পিয়ানো সিনেমার চিত্রনাট্য দিয়ে অস্কার পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। এবার অবশ্য অনুমানই ছিল যে ক্যাম্পিয়নই অস্কার পাবেন। এর আগে প্রথমবারের মতো অস্কারে নারী পরিচালক হিসেবে পুরস্কার জয়ের রেকর্ড গড়েন ক্যাথরিন বিগেলো। তিনি ২০০৯ সালে দ্য হার্ট লকার সিনেমার জন্য পুরস্কার পান। তারপর ২০২০ সালে নোম্যাডল্যান্ড সিনেমা জন্য সেরা পরিচালকের পুরস্কার জিতেছিলেন ক্লোয়ি ঝাও।
অ্যাপল টিভির কোডা সব মিলিয়ে চারটি মনোনয়ন পেলেও ঠিকই সেরা ছবিসহ তিনটি পুরস্কার পেয়েছে। ১৯৩২ সালে গ্র্যান্ড হোটেল সিনেমা মাত্র চারটি মনোনয়ন নিয়ে সেরা হয়েছিল। সেই একই ঘটনা এবার ঘটল কোডার ক্ষেত্রে। সেরা অভিনেত্রীর অস্কার পেয়েছেন জেসিকা চ্যাস্টেন দ্য আইজ অব টেমি ফে ছবির জন্য।
আলোচিত দুই বিজয়ী স্টিভেন স্পিলবার্গ পরিচালিত ওয়েস্ট সাইড স্টোরিতে অভিনয়ের জন্য আরিয়ানা ডিবোস পার্শ্বচরিত্রের সেরা অভিনেত্রীর অস্কার পেয়ে নতুন এক রেকর্ড গড়লেন। প্রথমবার মনোনয়নেই পেলেন এ পুরস্কার। একই চরিত্রের জন্য দুই অভিনয়শিল্পীর পুরস্কার পাওয়া অস্কারে এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। স্টিভেন স্পিলবার্গের ওয়েস্ট সাইড স্টোরি সিনেমার গল্প ১৯৬১ সালে নির্মিত একই নামের মিউজিক্যাল সিনেমা থেকে নেওয়া। সেই সময়ও এ চরিত্রে অভিনয় করে অস্কার জিতেছিলেন রিতা মরিনো।
সেরা অভিনেতার অস্কার পাওয়া মার্কিন অভিনেতা ট্রয় খটসর হলেন একাডেমি অ্যাওয়ার্ডসের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো বধির অভিনেতার পুরস্কার জেতা। কোডা সিনেমায় অনবদ্য অভিনয় তাঁকে এনে দিল এ স্বীকৃতি। এর আগে বধির অভিনেত্রী মার্লি ম্যাটলিন ১৯৮৭ সালে চিলড্রেন অব আ লেজার গড ছবিতে অভিনয়ের জন্য জিতেছিলেন অস্কার।
সেই ছবির মূল অভিনেতা উইলিয়াম হার্ট মারা গেলেন কয়েক দিন আগেই। এবার বিদেশি ভাষার সেরা ছবির পুরস্কার গেছে জাপানি সিনেমা ড্রাইভ মাই কার হারুকি মুরাকামির গল্প নিয়ে বানানো এ সিনেমা সেরা ছবি হতে পারে বলেও অনেকের অনুমান ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সিনেমা হিসেবেই সন্তুষ্ট থাকতে হলো। অভিনেতা ও পরিচালক কেনেথ ব্রানার সেরা মৌলিক চিত্রনাট্যের অস্কারও ছিল এবারের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তবে এবার যে যত পুরস্কারই পাক, চর্চায় থাকবেন উইল স্মিথ। এটাই এবারের অস্কার নিয়তি বলা যায়।