'কাস্টিং কাউচ ছিল এবং আছে'
>চলচ্চিত্রে বর্ণাঢ্য জীবন বরেণ্য অভিনয়শিল্পী ববিতার। চলচ্চিত্রের অনেক দিক গভীরভাবে দেখেছেন তিনি। নারী দিবস সামনে রেখে শনিবার সকালে ববিতা মুখোমুখি হন প্রথম আলোর। অকপটে জানান অনেক কথা। এ–ও বললেন, ভালো মানের গল্প পেলে আবারও চলচ্চিত্রে অভিনয়ে দেখা যেতে পারে তাঁকে।
আপনাকে নারী দিবসের শুভেচ্ছা। আপনার কাছে নারী দিবস কতটা গুরুত্বপূর্ণ? কেন?
ধন্যবাদ। প্রথম আলোর মাধ্যমে বাংলাদেশ ও বিশ্বের সব নারীকে নারী দিবসের শুভেচ্ছা। আমি মনে করি, নারী দিবসের অবশ্যই গুরুত্ব আছে। বছরে একটা দিন নারী দিবস হিসেবে পালন করলেই নারীরা এগিয়ে যাবে, তা নয়। তবে সমাজে নারীদের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে সচেতনতা তৈরির জন্য এমন একটি দিনের দরকার আছে। নারী দিবস একটা স্লোগান, যে স্লোগান নারীদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে ও এগিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা জোগায়। প্রতিবছর নারী দিবসে নারীদের বছরের পর বছর চলতে থাকা বঞ্চনার ইতিহাসও সামনে আসে। এভাবে নারী ও পুরুষ উভয়কেই নারীরও যে পুরুষের সমান অধিকার পাওয়া উচিত, সেই গুরুত্ব তুলে ধরে। নারী দিবসেই এক বছরে নারীর সম–অধিকার অর্জনে সবার ভূমিকা ও পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা পর্যালোচনা করা যায়। প্রতিবছর ভিন্ন ভিন্ন বিষয় নিয়ে নারী দিবস পালিত হলেও বিশ্বজুড়ে নারীর অবস্থানে খুব একটা তারতম্য চোখে পড়ে না। কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ ও সহিংসতা এখনো আছে। এ দেশে এখনো একটা মেয়েকে নিজের স্বপ্ন পূরণের চেয়ে সমাজের চাহিদা আগে মাথায় রাখতে হয়। বিয়ে এবং সন্তানধারণের জন্য ক্যারিয়ার এবং পড়াশোনায়ও পিছিয়ে যেতে হয় অনেককেই। এখনো একটা মেয়ে রাতে একা চলাফেরা করলে অনেক নেতিবাচক মনোভাবের মুখোমুখি হয়। এসব নিয়ে কথা বলার জন্য এমন একটা দিবস বড় ধরনের ভূমিকা রাখে।
এবার নারী দিবস ঘিরে বিশেষ কোনো পরিকল্পনা আছে কি?
নিজে থেকে কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে এই দিনে সফল ও অনুপ্রেরণাদায়ী নারী হিসেবে একাধিক সংগঠন থেকে আমাকে সম্মাননা দেওয়ার কথা শুনেছি।
পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। এই ইন্ডাস্ট্রিতে নারীর কাজ করা আগের চেয়ে নিরাপদ হয়েছে কী?
নিরাপদ না হওয়ার কিছু নেই। তবে চলচ্চিত্রে নারীদের শক্ত অবস্থান নেই। চলচ্চিত্রে নারীদের আরও শক্ত অবস্থান যদি তৈরি করা যেত, তাহলে আরও ভালো লাগত। নারীরা আরও এগিয়ে যেতে পারত। নানা কারণে তা হচ্ছে না। এখন তো ছবিও ঠিকমতো হচ্ছে না। আমি অবশ্য একটা কথা বলি, যতই আমরা সম–অধিকারের কথা বলি না কেন, পুরুষশাসিত ব্যাপারটা এখনো সমাজে রয়ে গেছে। মুখে বললেও মনের ভেতর পুরুষশাসিত ব্যাপারটা রয়ে গেছে। যাঁরা ভালো লেখাপড়া করেছেন, রুচি, মূল্যবোধ ও মনুষ্যত্বের শিক্ষা নিয়েছেন—তাঁরা অবশ্য ভিন্ন রকম ভাবছেন, সেটা অন্য জিনিস। তবে চলচ্চিত্রে আরও আস্থার জায়গা তৈরি করতে পারলে পর্দার পেছনের কাজেও নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ত। একটা সময় যখন সোভিয়েত ইউনিয়নে যেতাম, দেখতাম চলচ্চিত্র সম্পাদনার মতো কাজও করছেন নারীরা। নারীরা কিন্তু সূক্ষ্মভাবে কাজ করেন। আমাদের দেশে পর্দার পেছনের ব্যাপারটায়ও এগিয়ে আসা উচিত।
চলচ্চিত্রে কাজ করতে গেলে কাস্টিং কাউচের শিকার হওয়ার খবর শোনা যায়। আপনার ক্ষেত্রে কি এমনটা কখনো ঘটেছে?
আমি হইনি, তবে কাস্টিং কাউচ বিষয়টা ছিল এবং আছে। শুধু আমাদের দেশে নয়, পৃথিবীব্যাপী শোবিজে এমনটা হয়, যা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত। তবে আমি আমার বুদ্ধি দিয়ে সবকিছু অতিক্রম করেছি। আমি সব সময় বলতাম, অভিনয় করতে জানি কি না, আমাকে দিয়ে চরিত্রটির সার্থক রূপায়ণ সম্ভব হয় কি না দেখেন—তাহলে কাস্টিং করেন। আমি যদি কোনো চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে না পারি, তাহলে জোর করে কাস্টিং করার দরকার নেই।
আপনার কি মনে হয় যে চলচ্চিত্র পরিবারের অংশ হওয়ায় এই ইন্ডাস্ট্রিতে পথচলা সহজ হয়েছে?
আমি খুবই ভাগ্যবান, জহির রায়হানের মতো একজন নির্মাতার হাত ধরে চলচ্চিত্রে এসেছি। আমার বড় বোনও তখন চলচ্চিত্রে দাপটের সঙ্গে কাজ করছেন। তাই আমাকে বিব্রতকর কিছুর মুখোমুখি হতে হয়নি।
এখন তো অভিনয় করেন না। সিনেমা কি দেখা হয়?
সময় কাটানোর জন্য ইদানীং ল্যাপটপ নিয়ে সিনেমা দেখতে বসে পড়ি। আমি যখন বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে কাজ করেছি, তখন অনেক ছোট ছিলাম। তাঁর সম্পর্কে কিছুই জানতাম না, বুঝতামও না। কিছুদিন হয় ভাবছি, তাঁর সবগুলো ছবিই আমার দেখা উচিত। ছবিগুলো কেমন বানিয়েছেন, তা জানার আগ্রহ থেকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া। পাশাপাশি অনেকগুলো ভালো ও বিশ্ববরেণ্য পরিচালকের ছবি দেখা হচ্ছে। আগে তো উৎসবে আমন্ত্রিত হতাম, তখন অনেক দেশের অনেক ধরনের ছবি দেখা হতো।
ইদানীং কোন ছবিগুলো দেখে মুগ্ধ হয়েছেন?
পথের পাঁচালী তো এককথায় অসাধারণ। এ ছাড়া ‘চারুলতা’ এবং ‘হীরক রাজার দেশে’ দেখে ভালো লেগেছে। সোফিয়া লরেনের ‘টু উইমেন’ ও ‘সানফ্লাওয়ার’ ছবিটিও আবার দেখেছি।
বর্তমান নারী অভিনয়শিল্পীদের ভেতর কাদের অভিনয় ভালো লাগে?
সবাইকে আমার ভীষণ ভালো লাগে। আমার অনুজ সবাইকে ভীষণ ভালোবাসিও। চলচ্চিত্রে যেমন নারী অভিনয়শিল্পীরা ভালো করছেন, টেলিভিশনেও অনেকে ভালো করছেন। সবার জন্য আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। নাটকে অপি করিম, তারিন, তিশাকে দারুণ লাগে। সিনেমার মধ্যে আমাদের পরে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা সবাই ভীষণ মেধাবী। প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান পরিচালকেরা তাঁদের সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারছেন কি না, সেটাই দেখার বিষয়। সুবর্ণা মুস্তাফা, শাবনূর, মৌসুমী, পপি ও পূর্ণিমা—আমার ভীষণ প্রিয়। আর এখন তো জয়া আহসান বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতেও সুনাম কুড়াচ্ছেন।
একদম নতুনদের মধ্যে কারও নাম বললেন না।
সত্যি কথা বলতে, নতুন ছবি সেভাবে দেখা হয় না। তারপর যে কয়টা ছবি দেখা হয়েছে, তার মধ্যে মিম, মাহী, বুবলী, পূজা চেরিকে ভীষণ সম্ভাবনাময় মনে হয়েছে।
আর নায়কদের মধ্যে কার কথা বলবেন?
প্রথমেই শাকিবের কথা বলব। তাঁর কথা বলতেই হয় এভাবে, শাকিব ইজ শাকিব। ইদানীং শাকিব নিজেকে অনেক ডেভেলপ করেছেন। অভিনয়ের ম্যাচিরউরিটিও এসেছে। ভারতেও তাঁর আলাদা অবস্থান তৈরি হয়েছে। এর বাইরে রিয়াজ, ফেরদৌস, আরিফিন শুভ, ইমন, নিরব, সিয়ামেরা ভালো করছেন। তবে আমার বিশ্বাস, তাঁরা আরও ভালো করতেন, যদি আরও ভালো ভালো সুযোগ পেতেন। আমাদের ভালো পরিচালকের ভীষণ অভাব বোধ করছি। আমরা যে মানের পরিচালক পেয়েছি, এখনকার অভিনয়শিল্পীরা সেভাবে ভালো পরিচালক পাচ্ছেন না।
ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে আপনি নেই। কোনো কারণ আছে কী?
ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম আমি মোটেও পছন্দ করি না। শুনেছি, এখনকার সমাজে এগোতে গেলে এসবের প্রয়োজন আছে—তবে আমি তা বিশ্বাস করি না। একজন শিল্পীর ব্যক্তিগত বিষয় তাঁর ব্যক্তিগতই থাকবে। শিল্পীর সবকিছু সবাইকে জানাতে হয় না। আমি না থাকলে আমার নাম ভাঙিয়ে অনেকে ফেসবুক চালাচ্ছে, এটা মোটেও পছন্দ নয়।
আর অভিনয়ে ফিরবেন না?
ফিল্মকে আমি গুডবাই বলেছি, তা কিন্তু নয়। একজন শিল্পী কখনোই অভিনয়কে গুডবাই বলতে পারেন না। শিল্পী যত দিন বেঁচে থাকবেন, অভিনয়ের তাড়না থাকবেই। কিন্তু কিছু করার নেই বলে দূরে সরে আছি। ভালো গল্প পেলে অবশ্যই অভিনয় করব। আমার কাছে কিছুদিন আগেও চারটা ছবির প্রস্তাব এসেছিল, গল্প শুনেছি কিন্তু ভালো লাগেনি। ভেবেছি, আমি যা অর্জন করেছি, তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকি, সেই ভালো।