২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

‘সিনেমাটি মুক্তির পরে সবাই আমাকে হাইকোর্ট বলে ডাকতে শুরু করে’

‘অশ্রু দিয়ে লেখা’ সিনেমাটি আজ মুক্তির ৫০ বছর পার করছে। সিনেমায় গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন কোহিনূর আখতার সুচন্দা। দীর্ঘ আলাপচারিতায় এই অভিনেত্রী ফিরে গেলেন ৫০ বছর আগের নানা ঘটনায়। বর্তমান চলচ্চিত্রসহ নানা বিষয়ে কথা বললেন

প্রশ্ন :

কেমন আছেন?

এই ভালো, এই মন্দ মিলিয়েই। এখন তো বৃষ্টিবাদল, যে কারণে ঠান্ডা ও সর্দি–কাশি কমছে–বাড়ছে। সব মিলিয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করি।

সুচন্দা অভিনীত ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’ সিনেমাটি আজ মুক্তির ৫০ বছর পার করছে
ছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন :

‘অশ্রু দিয়ে লেখা’ সিনেমাটি মুক্তির ৫০ বছর?

ওয়াও, তাই নাকি। কী সুন্দর সিনেমাটি ছিল। এখনো মনে আছে, সব গান সুপারডুপার হিট হয়েছিল। ছবিটি সিনেমা হলে ভালো চলেছিল।

প্রশ্ন :

সিনেমার চরিত্রটির কথা মনে আছে?

হ্যাঁ। আমরা দুই নায়িকা ছিলাম। আমি আর সুজাতা। নরমালি এক নায়িকা থাকলে আরেক নায়িকা কাজ করতে চান না। আবার দুই হিরো থাকলেও কার চরিত্রে ডায়ালগ কমবেশি—এসব নিয়ে মনোমালিন্য, কথা হয়, কাজ করতে চান না। কিন্তু দুই নায়িকা থাকার পরেও সিনেমাটির পরিচালক কামাল আহমেদ প্রস্তাব দেওয়ার পরেই রাজি হয়ে যাই।

প্রশ্ন :

তখন আপনি খুব জনপ্রিয়, প্রচুর ব্যস্ততা, এরপরও আরেক নায়িকা থাকার পরে কেন রাজি হয়েছিলেন?

তখন আমার কোনো শিডিউল খালি নেই। কিন্তু গল্প ও নির্মাতা পছন্দ হওয়ায় রাজি হই। দুই নায়িকা মানেই যে কাজ করব না—এমন মনোভাব কখনোই আমার মধ্যে ছিল না। শিল্পী মানেই সবকিছুর ঊর্ধ্বে। এ জন্য কবরী, সুজাতাসহ অনেক নায়িকার সঙ্গে অভিনয় করেছি।

‘অশ্রু দিয়ে লেখা’ সিনেমায় নায়ক রাজ্জাক ও সুচন্দা
ছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন :

ব্যতিক্রম পাননি?

হয়েছে, তবে নায়িকার নাম বলব না। এক নায়িকার সঙ্গে কাজ করছিলাম। দৃশ্যে আমি তাঁর পাশাপাশি থাকব। সেই নায়িকা বললেন, আমার সঙ্গে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে শর্ট দেবেন না। কী আর করার, পরে আমাদের অংশগুলো আলাদা করে শুটিং হয়েছে।

প্রশ্ন :

শুটিংয়ের সবার সামনে বলেছেন আপনার সঙ্গে অভিনয় করবেন না, তখন কী মনে হয়েছে?

আমি এগুলোকে কখনোই কিছু মনে করিনি। আলাদা করেই আমাদের শুটিং হয়েছে, তাতে কি। আমি মনে করি, শিল্পীরা মুক্তমনা হয়, শিল্পীর বড় মন হয়। তবে এটা মনে রাখা উচিত, একজন শিল্পী তৈরি হয় অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে। তাঁকে সম্মান করা দরকার। এখানে একজন শিল্পী আরেকজন শিল্পীর পাশে দাঁড়িয়ে অভিনয় করলে অস্তিত্ব থাকবে না, লোকে পছন্দ করবে না—এগুলো শিল্পী হিসেবে বিশ্বাস করি না। চরিত্র পছন্দ হয়েছে কাজ করেছি।

প্রশ্ন :

‘অশ্রু দিয়ে লেখা’ সিনেমার শুটিংয়ের কোনো মজার ঘটনা আছে?

হুম...একটা ঘটনা বলতে পারি। সিনেমায় আমার চরিত্রকে স্যাক্রিফাইস করতে হয়। গল্পে আমি প্রেম করার পর জানতে পারি নায়কের ছোটবেলার সঙ্গী ফিরে এসেছে। যাকে সে বিয়ে করেছিল। নায়ক ছিলেন রাজ্জাক। তখন আমি আর বাধা হয়ে দাঁড়াইনি। আমি বিবেকের মুখোমুখি হই। নিজেই হাইকোর্ট হয়ে বিচার করি, ছোটবেলার সঙ্গীর সঙ্গেই নায়কের থাকা উচিত। আর সিনেমা শেষে আমার সংলাপ ছিল, ‘‘সত্যকে সত্য বলে মেনে নিতে পারি বলেই আমার নাম হাইকোর্ট।’’ তো সিনেমাটি মুক্তির পরে সবাই আমাকে হাইকোর্ট বলে ডাকতে শুরু করেন। (হাসি)

‘অশ্রু দিয়ে লেখা’ সিনেমার একটি দৃশ্য সুজাতা ও সুচন্দা
ছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন :

৪০–৫০ বছর আগের দিনগুলোর দিকে তাকালে কী মনে হয়?

শিল্পী–কলাকুশলীরা তখন একে অন্যের প্রতি আন্তরিক ছিলেন। তখন নায়ক–নায়িকা ও পরিচালকেরা উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। তাঁদের চিন্তাভাবনা চরিত্রসহ সবকিছু নিয়েই থাকত। সবাই শুটিংয়ে অনেক বেশি অ্যানগেজ থাকতেন। এমন হতো যে কারও মন খারাপ হলেও অন্যরা বুঝতে পারতেন।

প্রশ্ন :

কখনো আপনার মন খারাপ হয়েছিল?

খুব একটা না। তবে একবার ‘নয়নতারা’ সিনেমার সময় নায়ক আজিম পাঞ্জাবি পরে একটি শর্ট বেশ কয়েকবার এনজি করে। প্রচণ্ড রোদ। ঘেমে পাঞ্জাবি ভিজে যায়। সেটা শুকিয়ে আবার শুটিং শুরু হয়। বারবার এনজি করায় আমি অন্যমনস্ক হয়ে পাশে এসে বসেছিলাম। কিছু সময় পরে পরিচালক দেখলেন আমার মন খারাপ। তাঁকে বারবার বললাম কিছু হয়নি। তিনি মনে করলেন অভিমান করেছি। সঙ্গে সঙ্গে অভিমান ভাঙানোর জন্য বরই–তেঁতুলের আচার আনতে লোক পাঠালেন। দিনগুলো অনেক মজার ছিল। তখন শিল্পীদের প্রতি ভালোবাসা ও আন্তরিকতা ছিল অনেক বেশি।

প্রশ্ন :

মাঝেমধ্যেই দেখা যায় আপনারা আগের সহকর্মীরা একত্র হন, তখন কেমন আড্ডা জমে?

শুনলে অবাক হবেন, এখনো দেখা হলে গলা জড়িয়ে ধরে কী যে করি। গালে চুমু দিই, কপালে চুমু দিই, চিমটি কাটি। কোনো কিছু ভাগাভাগি করে খাই। আগের দিনে ফিরে যাই। মনে হয়, সেই শৈশবের বান্ধবী। আমরা সব শিল্পী ছিলাম একান্নবর্তী পরিবারের মতো। কিন্তু এখনকার শিল্পীদের মধ্যে পরিবারকেন্দ্রিক মনোভাবের অভাব। শুটিংয়ে সেই পরিবেশ থাকতে হবে। কিন্তু এখন তো শুটিং শেষ করেই নায়ক–নায়িকারা এসি গাড়িতে গিয়ে বসে শুনি। এভাবে বন্ডিং হয় না। সবার মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং থাকতে হবে। কারণ, ছবি শুধু নায়ক–নায়িকা দিয়ে হয় না।

‘অশ্রু দিয়ে লেখা’ সিনেমায় গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সুচন্দা সুচন্দা
ছবি : প্রথম আলো

প্রশ্ন :

অনেক সময় এমনও শুনি, গল্প ও একজন হিরো আছেন—সিনেমা হয়ে যাবে?

একজন হিরো থাকলেই সিনেমা হয়ে যাবে, এটা ভাবা উচিত নয়। অন্যান্য শিল্পী, পরিচালক, গান, সম্পাদনা—সবই শতভাগ দরকার। আর সমালোচনাটাও মেনে নিতে হবে। এখন ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েই মনে করছি সাংঘাতিক কিছু, এমন ভাবা ঠিক না।

প্রশ্ন :

এখন তো কোনো অভিনয়শিল্পী সমালোচনা তেমন একটা পছন্দ করেন না?

সবাই শুধু ভালোই শুনতে চান। এ জন্য একাধিক সিনেমায় দুই নায়ক বা নায়িকা কম থাকে। এখন মারমার কাট কাট। দুই দিন পরে হারিয়ে যাচ্ছে। নতুন ছবি আসছে। এমন ভালো লাগে না। আগে রুচিসম্মত দর্শক পরিবার নিয়ে সিনেমা দেখতেন। এখন নাচ–গান, ধুমধাম ফাইট, গল্পের হাতা নেই মাথা নেই—মনে করে, এটাই একটা বিরাট কিছু। আসলে তো এখন ভালো চলচ্চিত্র নেই। চলচ্চিত্রে এখন একটা শূন্যতা বিরাজ করছে। এখন কোন জায়গায় হাউসফুল সাইনবোর্ড ঝোলে? এখন এই সপ্তাহ ওই সপ্তাহ চলল—শেষ। অথচ সমালোচনা করলে আমরা খুশি হয়ে পরের ছবি ভালো করার চেষ্টা করতাম।

প্রশ্ন :

অভিনয়শিল্পী হিসেবে কোন সংকটগুলোর কথা বলবেন?

ভালো শিল্পী–কলাকুশলী কিন্তু আছে। তাদের দিয়ে কাজ বের করিয়ে নেওয়া সম্ভব। ভালোর সেই চেষ্টাটা কজন করে।

প্রশ্ন :

একটু কাজের প্রসঙ্গে আসি। নতুন কোনো কাজে দেখা যাবে?

কাজে ফেরার সম্ভাবনা আছে। কিছু কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছি। কিন্তু এই মুহূর্তে বলব না। আমি পরে জানাব। কারণ, আমি সারপ্রাইজ দিতে পছন্দ করি।

সুচন্দা আবার কাজে ফিরেছেন
ছবি: সংগৃহীত