সত্যজিৎ রায় শেষ ছবিতে আমাকেই চেয়েছিলেন
কিংবদন্তি নৃত্যশিল্পী উদয়-অমলা শঙ্করের মেয়ে মমতা শঙ্কর সম্প্রতি এক নৃত্য কর্মশালায় যোগ দিতে ঢাকায় এসেছিলেন। কর্মশালাটি আয়োজন করে সাধনা। ৬ আগস্ট দুপুরে সাধনার কার্যালয়ে তিনি প্রথম আলোর আলাপচারিতায় মাতেন। তাঁর স্বামী চন্দ্রোদয় ঘোষও ছিলেন সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন প্রণব ভৌমিক। আনন্দ পাতায় সাক্ষাৎকারের সংক্ষেপিত রূপটি প্রকাশিত হয়েছে। এখানে তিন পর্বে সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হলো। আজ রইল শেষ পর্ব।
প্রথম আলো: নাচ থেকে একটু আপনার অভিনয়ে আসি। আপনি মায়ের কাছে নাচ শিখেছেন। নাচের স্কুলিংটা আপনার মায়ের কাছে। তো অভিনয়ে আসার পেছনে কোনো ঘটনা আছে?
মমতা শঙ্কর: আমরা বলি যে আমরা ভাবি, আমরা করি। আমরা করি না কিছুই। আমার আগের জন্মের কর্মফল অনুযায়ী এবং আমার এই জন্মের কাজের জন্য, যিনি ওপরে বসে সবকিছু চালনা করছেন, তিনি সবকিছু করিয়ে দেন। আমরা শুধু চলছি। আমরা এমনই একটা বাড়িতে থাকতাম যেটার নাম ছিল ফিল্ম সার্ভিস, ফিল্মের যাবতীয় কাজ সেখানে হতো। ওখানে একটা প্রোজেকশন রুম ছিল, সেখানে হেন কেউ নেই যে আসেননি। মৃণাল সেন, সত্যজিৎ রায়, তপন সিনহা, ঋত্বিক ঘটক থেকে আরম্ভ করে বোম্বের যত বড় বড় ডিরেক্টর, প্রোডিউসার—এমনকি হলিউডের রিচার্ড অ্যাটেনবরো থেকে আরম্ভ করে অনেকেই—যখন ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ হচ্ছে, তাঁরা সব ওখানে এসেছেন। তো ছোটবেলা থেকেই ফিল্মের অফার অনেক পেয়েছি, বাবা-মা কোনো দিন চাননি যে অত ছোট বয়সে আমি ফিল্মে যাই। অন্তত পড়াশোনাটা একটু শেষ করে যাই। তো সব অফার নাকচ করে দিয়েছিলেন। আর আমারও অভিনয় নিয়ে সেরকম করে কখনো ভাবিনি। তবে অভিনয়ের পেছনে কিন্তু আমার বাবার হাত আছে। বাবাই আমার মধ্যে অভিনয় ব্যাপারটা ইনজেক্ট করে দিয়েছিলেন, মানে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। আমি ছোটবেলায় খুব ঘ্যানঘ্যানে বাচ্চা ছিলাম। যতক্ষণ ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছি, এই করছি, যেই বাড়িটা ফাঁকা হয়ে গেল, আর কিছু করার নেই, সবাই চলে গেছে, ওই আমার ঘ্যানানো শুরু হতো। ‘ভাল্লাগছে না, বাবা, ভাল্লাগছে না।’ আর নয়তো ‘কী করব? কিছু করার নেই। কী করব? বাবা বলো।’ এই ঘ্যানিয়ে যেতাম। তো বাবা বলতেন, যা, একটা চেয়ার নিয়ে আয়নার সামনে রেখে দিয়ে বলত, ‘এই একটাই কথা কত রকমভাবে বলতে পারিস!’ যেদিন যে কথাটা নিয়ে ঘ্যানাতাম, সেই কথাটা দিয়ে বসিয়ে দিতেন। বসে এইটাকে কত রকম ভাবে বলা যায়। আর বাবা দূরে বসে বসে দেখতেন যে কখন আমি স্বাভাবিকভাবে বলছি, কত রকম ভাবে বলছি, কোনটা রিপিট করলাম, বা কোন সময় আমি একটু কনশাস হয়ে গেলাম, একটু আড়ষ্ট হয়ে গেলাম, এইগুলো বাবা বসে বসে ধরিয়ে দিতেন। তো সেটাই বোধ হয় আমার হাতে খড়ির মতো একটা হয়েছে। তারপরে তো সিনেমায় আসি অনেক পরে, যখন আমি কলেজে উঠলাম। তখন আমার দাদা (আনন্দ শঙ্কর) মৃণাল সেনের তিনটি ছবিতে মিউজিক দিয়েছেন। তারপরে মৃণালদার সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। মৃণালদা এবং তাঁর স্ত্রী, অসম্ভব ভালো অভিনেত্রী গীতা সেনের সঙ্গে। সেই থেকে মৃণালদা আমাকে বারে বারে বলতেন, ‘তুমি সিনেমায় করো না কেন?’ আমার মাকে বলতেন, ‘কেন ওকে ফিল্মে নামাচ্ছেন না?’ তো মা বলতেন, ‘দেখি।’ এই সব করে কাটিয়ে দিতেন। কলেজে যখন উঠেছি আমার পড়াশোনা করতে ভালো লাগত না। মানে আমি সত্যি বলছি, চন্দ্রোদয় ভীষণ পড়াশোনা নিয়ে থাকে। ভীষণ বই পড়তে ভালোবাসে। আমিও বই পড়তে ভালোবাসি। কিন্তু আমি ওইরকম না। ওর যত জ্ঞান আছে, আমার ওরকম জ্ঞান নেই।
চন্দ্রোদয় ঘোষ: আমি নিজে যতটা বোকা, সেই পরিমাণটা কমাতে চাইছি।
মমতা শঙ্কর: না না, আর আমি দিন দিন বোকাই হয়ে যাচ্ছি। ছোটবেলা থেকে আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে দেশ-বিদেশ, গ্রামে-গঞ্জে সব জায়গায় আমাকে নিয়ে নিয়ে তাঁরা ঘুরেছেন। সুতরাং এই মানুষের কাছ থেকে সে বিদেশে হোক, দেশে হোক, গ্রামে হোক, সব জায়গা থেকে আমি নিয়েছি, সেগুলো আমার ভেতরে চলে এসেছে।
চন্দ্রোদয় ঘোষ: আর মা যে বাটাচরের গল্প করেন তোমার কাছে!
মমতা শঙ্কর: হ্যাঁ, মা তো এখানের গল্প খুবই করেন। তো যেটা হয়েছিল, যখন আমার পড়াশোনা করতে একদমই ভালো লাগত না, আমি মৃণালদাকে একদিন ফোন করে বলি, ‘মৃণালদা, এখন আমি একটু খালি আছি। আপনি যদি ছবি করার কথা ভাবেন, আমি নামতে রাজি, মানে আমি ইচ্ছুক।’ তো মৃণালদা তখন মৃগয়া ছবিটা ভেবেছেন। তো মৃণালদা বললেন, ‘ঠিক আছে, কিন্তু একটা সাঁওতালি মেয়ের চরিত্র। তোমাকে কালো রং করা হবে।’ ঠিক আছে। তো ম্যাক আপ নিয়ে এসে কালো রং করা হলো। সে এক কুৎসিত চেহারা হলো। সে কালো কখনোই নরমাল কালো হয় না। চোখের রং, ঠোঁটের রং, হাতের চেটোর রং ম্যাচ করতে পারে না নরমাল কালোর সঙ্গে রং করানো কালোর সঙ্গে। তো আমি আয়নায় দেখে আর ছবিগুলো দেখে, মানে ভয়াবহ! মৃণালদাকে বললাম, ‘মৃণালদা, যদি কিছু মনে না করেন, তো আমি ম্যাক আপ করব না, রোদে পুড়ে কালো হব।’ সেটা বলেছিলেন তিনি এপ্রিল-মে মাসে। সেই সময় থেকে আমি সারাটা ক্ষণ সারা দিন যতক্ষণ সূর্য থাকত আমি নুনজল গায়ে মেখে, গ্লিসারিন গায়ে মেখে রোদে পুড়ে পুড়ে কালো হয়েছিলাম। আর মৃণালদার দুটো সিনেমার জন্য আমি কালো হয়েছি। তারপরে ‘ওকা উরি কথা’ করলেন, যেটা তুলসী প্রেমচাঁদের গল্প নিয়ে। সেই পুড়ে কালো হয়ে, এবং কোনো মেক আপ ছাড়া। শুটিংয়ে যেতাম, একদম টেনে একটা হাতখোঁপা মা করে দিতেন। মা আমার সঙ্গে দুবার শুটিংয়ে গেছেন। এইটাই আমার ছোটবেলার একটা ভীষণ মজার ব্যাপার, আমি ভীষণ স্ট্রিক্টভাবে মানুষ হয়েছি ছোটবেলা থেকে, আমাকে একা বের হতে দেওয়া হতো না, বন্ধুদের সঙ্গে বের হতে দেওয়া হতো না। কিন্তু এই যে শুটিংয়ে গেলাম, প্রথম দুটো শুটিংয়ে মা গিয়েছিলেন। শ্রীলঙ্কাকে শুটিং ছিল একটা অন্য বইয়ের সেটায় মা গিয়েছিলেন কিছুদিনের জন্য, তারপরে মা চলে এসেছিলেন। তারপর থেকে সারা জীবন আমি নিজের মতো করে শুটিং করেছি। সেখানে কিন্তু তাঁরা অবাধে ছেড়ে দিয়েছেন। কারণ যেটা মা-বাবা সব সময় বলতেন যে, প্রথমে যদি রাশটা টেনে রাখা যায়, লাগামটাকে একবার ঠিক কন্ট্রোলে এসে গেলে তারপরে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া যায়। তারপরে সে আর এদিক-ওদিক কোথাও কিছু হবে না। তো সেইটাই বোধ হয়! সেই করে ‘মৃগয়া’ হলো। তারপরে এক এক করে আমার খুবই ভাগ্য যে, এত ভালো ভালো ডিরেক্টরের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি।
প্রথম আলো: সেটাই আমার পরবর্তী প্রশ্ন ছিল। আপনি তো মৃণাল-সত্যজিৎ-বুদ্ধদেব থেকে শুরু করে গৌতম-ঋতুপর্ণ সবার সঙ্গে কাজ করেছেন।
মমতা শঙ্কর: রাজা মিত্র। ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে কাজ করতে করতে হলো না। তারপরে উনি মারা গেলেন। তপন সিনহার সঙ্গেও কাজ করেছি। কিন্তু সেভাবে অ্যাক্টিং না, বাচ্চাদের একটা ড্যান্স সিকোয়েন্স ছিল ‘সফেদ হাতি’ বলে, সেখানে একটা ছোট রোল করেছিলাম। আরও অসংখ্য ভালো ডিরেক্টরের সঙ্গে কাজ করেছি, এখনকার যাঁরা এঁদের সঙ্গে কাজ করেছি। এটা আমার বিরাট ভাগ্য। একটা একটা বইতে না, বারে বারে অনেকগুলো বইতে তাঁদের সঙ্গে কাজ করেছি।
প্রথম আলো: তাঁদের মাপের ডিরেক্টর থেকে এখনকার যাঁরা আছেন, এর মধ্যেও তো একটা বিবর্তন আছে। কীভাবে দেখেন সেটাকে?
মমতা শঙ্কর: মৃণালদা অনেক সময় বলতেন, বানিয়ে বলো। ইম্প্রোভাইজ করো। সেটা আরেকজনও করতেন—অঞ্জন দত্ত। অঞ্জন দত্তের ফিল্ম যেটা করেছি, ওর টেলিফিল্মেও করেছি, একদম বানানো, সিকোয়েন্স আমরা তৎক্ষণাৎ বানিয়েছি। মৃণালদার যেমন স্ক্রিপ্ট রেডি থাকত, কিন্তু তার বাইরে গিয়েও মৃণালদা অনেক সময় ইম্প্রোভাইজ করতেন। মানে হঠাৎ একটা জায়গা দেখে হয়তো পছন্দ হয়ে গেল। এখন আমি যেরকম বসে থাকি শুটিংয়ে গেলে, কখন ডিরেক্টর প্যাক আপ কথাটা বলবে, অত মধুর কথা বোধ হয় আর নেই পৃথিবীতে। প্যাক আপ বলবে, বাড়ি যাব। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে কাজ করার সময়, প্যাক আপ হয়ে গেছে, তারপর হয়তো অন্যদের শট চলছে, আমি কিন্তু বসে দেখতাম। মানিক কাকার কাজ করা দেখতে ভালো লাগত। মৃণালদার সময় তো শুধু মনে হতো, সেটা তো আমার ফার্স্ট ফিল্ম, আর মৃণালদা ওরকম ইম্প্রোভাইজ করতেন, আমি ভাবতাম মৃণালদার মাথা থেকে যদি আরেকটা সিন বের হয়! কিছু একটা শট উনি নেন! এ জন্য ঘুরে বেড়াতাম ওনার পেছন পেছন। মৃণালদার কাজ করার ধারা এ রকম, অনেক কিছু নতুন নতুন ইম্প্রোভাইজ করেন। মানিক কাকার সব ছক বাঁধা। মানে একেবারে প্রত্যেকটা ফ্রেম বাই ফ্রেম। ডায়ালগ সবকিছু। তবে আমি দেখেছি মানিক কাকার যদি আস্থা আসত কারও ওপর যে, ‘হ্যাঁ, এ সেটা ডেলিভার করতে পারবে’, মানিক কাকাকে অনেক সময় বলেছি, মানিক কাকা, ‘এই কথাটা কি বলতে পারি আমি এই কথার জায়গায়?’ সত্যজিৎ রায়কে মানিক কাকাই বলতাম। তিনি বলতেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, বল।’ উনি সেই লিবার্টিটা আমাকে দিয়েছেন। এত মজার মজার ঘটনা আছে, সে বলে আর শেষ হবে না।
প্রথম আলো: বেছে বেছে ছবি করেছেন। কমার্শিয়াল ফিল্ম করতে ইচ্ছে হয়নি?
মমতা শঙ্কর: কমার্শিয়াল ফিল্ম করেছি। কিন্তু সামহাউ মেলেনি আমার সঙ্গে।
প্রথম আলো: সত্যজিৎ রায়ের সিনেমায় কীভাবে আসলেন?
মমতা শঙ্কর: ওটা ওর জন্যই (চন্দ্রোদয়) হলো। আমি সারা জীবন চন্দ্রোদয়কে ধন্যবাদ দেব যে ও সেভাবে করল। আমি দেরিতে উঠি। কলকাতার সবাই জানে, আমি দেরি করে ঘুম থেকে উঠি। যেদিন সময় পাই। আমি ঘুমাচ্ছি তখনো, ও সকালবেলা উঠে খবরের কাগজ পড়ছে। হঠাৎ বলল যে, ‘মম জানো, সত্যজিৎ রায় আবার ছবি করছেন।’ উনি মাঝে অসুস্থতার জন্য ছবি করেননি। পাঁচ বছর পর আবার ছবি করছেন। আমি না ঘুমের মধ্যেই বলছি, ‘ইস, যদি আমায় নিতেন!’ বলে আবার ঘুমিয়ে পড়েছি। আর ও কোথা থেকে নম্বর জোগাড় করে ফোন করে আমাকে বলে, ‘ওঠো ওঠো ওঠো!’ আমি বলি, ‘কে, কী!’ তো বলছে, ‘ধরো।’ আমি বলি, ‘কে?’ ও বলে, ‘সত্যজিৎ রায়।’ আমি না ঘুমের মধ্যে কে কী কিছুই বুঝতে পারছি না। ফোনটা তখনো বাজছে। আমার না ওর ওপরে কী রাগ হচ্ছে! এই যে, আবার গায়ে কাঁটা উঠল। সেই মুহূর্তটা মনে করে। আমি খুব রেগে আছি তখন। ফোনটা বাজছে। হঠাৎ একটা গুরুগম্ভীর সেই গলা। ‘হ্যালো’ বলে যে কথা বলেছেন, আমার তো ঘুমটুম সব উড়ে গেল! সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গেও খুব পারিবারিক একটা ক্লোজনেস ছিল। কিন্তু কোনো দিন ছবি করা হয়নি। বলে না, ঠিক সময়টা যখন আসে, তখন ঠিক হয়ে যায়। উনি আমাকে বললেন, ‘হ্যালো! আমি মমতা বলছি, মানে মমতা শঙ্কর বলছি।’ ‘হ্যাঁ বলো!’ আরে, বাবারে! আমি বললাম যে, ‘মানিক কাকা, আমি শুনলাম যে আপনি আবার ছবি করছেন। আপনি যদি একটা সুযোগ আমাকে দেন! আমার খুব ইচ্ছে যে আপনার ছবিতে কাজ করব।’ তো বললেন যে, ‘তোমার কথা যে একেবারে ভাবিনি তা নয়! ঠিক আছে, তুমি আমাকে কয়েক দিন পরে ফোন করো।’ এইটা যে শুনেছি, আমার তো ছবি করাই হয়ে গেল! মনে হলো ছবিটা করেই ফেলেছি প্রায়! এতটুকু যে উনি বলেছেন যে, ‘তোমার কথা যে একবারও ভাবিনি তা নয়।’ খুব খুশি আমি। বলে না, মেঘ না চাইতেই জল! সেইরকম একটা। আমার তখন ডাক্তারের কথামতো একটা অপারেশন করার কথা। সেটাই মানিক কাকাকে জিজ্ঞেস করছি, ‘মানিক কাকা আমি কি ছবিটা করছি? যদি না হয় আমি এই সময়ে নার্সিং হোমে ভর্তি হব।’ আগে তুমি বলতেন, এই সময়ে তুই হয়ে গেছি। বললেন, ‘কেন? তুই জানিস না? তোকে কেউ বলেনি? তুই তো আমার ছবিতে আছিস!’ আমি না কী বলব বুঝতে পারছি না! তিনি বলছেন যে, ‘অবশ্য আমার মাথায় দুটো ছবি আছে।’ এটা দুজনের ক্ষেত্রেই হলো, মানিক কাকা, মৃণালদা। বললেন, ‘দুটো ছবির কথা আমার মাথায় আছে। ডাক্তার আমাকে যেটার অনুমতি দেবে সেটা আমি করব। তবে দুটোর যেটাই করি না কেন তুই আছিস।’ আমি মনে মনে বলি, ঠাকুর, আর কী চাই! দুটোর যেটাই করি না কেন আমি আছি। মানে আমার জায়গাটা ফিক্সড। তারপরে তো ‘গণশত্রু’ হলো, তারপরে ‘শাখা প্রশাখা’ হলো, যেটা আরেকটা ভেবে রেখেছিলেন। তো অটোম্যাটিক্যালি আমাকে আবার নিলেন। সেইটা করার পরে আমি আর দীপঙ্কর দে, লাস্ট যেদিন ‘শাখা প্রশাখা’র শুটিং হচ্ছে, একটা সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বলছি যে, ‘ইস বড্ড কষ্ট হচ্ছে! এ দুটো হয়ে গেল, আর দুটোতেই আমরা ছিলাম। আর কী সুযোগ হবে? মনে নয় না! এটাকেই রেখে দেব, চেরিশ করব।’ তারপরে আমি ইউরোপ ট্যুরে গেছি। সেখানে হঠাৎ মানিক কাকার ফোন এল, ‘আমি ছবি করছি, সেখানে উৎপল আছে (উৎপল দত্ত), টিটো আছে (দীপঙ্কর দে), আর আমি তোকে চাইছি।’ আমি বললাম, ‘কবে শুটিং আরম্ভ?’ তিনি যে সময়টা বললেন তখন প্যারিসে আমার শো। লাস্ট শো। বললাম, ‘মানিক কাকা, ওসময় তো আমার শো।’ আমি তো, সারা পৃথিবীর লোক যেখানে তাঁর সঙ্গে কাজ করার জন্য আসবেন, আর আমি সেখানে তাঁকে বলছি! বললাম, ‘মানিক কাকা, আমাকে একদিন সময় দিন। আমি জিজ্ঞেস করে বলি শোটা ক্যানসেল করা যায় কি না।’ প্যারিসে ফোন করা হলো। ওরা বলল, ‘না, সমস্ত টিকেট সোলড আউট, শো ক্যানসেল করা যাবে না।’ আমার বুক ফেটে যাচ্ছে মানিক কাকাকে বলতে যে, ‘মানিক কাকা, হচ্ছে না। কিছুতেই আমি পৌঁছতে পারব না সেই সময়ে।’ মানিক কাকা বললেন, ‘তুই যদি এ ছবিটা না করিস তাহলে আমি ছবিটা করব না।’ আমার তখন মনে হলো কি, আমার জীবনের সবকিছু পাওয়া হয়ে গেছে। যিনি যাকে বলবেন সে-ই করবে, তিনি এতটাই শিওর যে আমাকে ছাড়া তিনি চান না! বললেন, ‘কত তাড়াতাড়ি তুই আসতে পারবি?’ বললাম, ‘আমি এই সময়ে পৌঁছব।’ বললেন, ‘তাহলে বাবু (সন্দ্বীপ রায়) একটা ছবি করবে, আমি সেটা আরম্ভ করে দিচ্ছি। যেদিন পৌঁছাবি তার পরের দিন শুটিং আরম্ভ করতে পারবি?’ আমি জেটল্যাগ-টেটল্যাগ সব ভুলে গিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ পারব।’ যেদিন পৌঁছেছি কলকাতায়, সেদিন স্ক্রিপ্ট শুনেছি। তার পরের দিন শুটিং।
প্রথম আলো: বাংলাদেশ কেমন লাগছে?
মমতা শঙ্কর: বাংলাদেশ আমার সব সময় ভালো লাগে, শুধু এবার দেখলাম, আগেরবার যখন এসেছি, এত ট্র্যাফিক ছিল না। এবারে একমাত্র ট্র্যাফিকটা বাদ দিয়ে আর সব ভালো। বাংলাদেশের মানুষ, দেশটাকে তো তার মানুষই রেপ্রিজেন্ট করে। আপনাদের আতিথেয়তার কাছে সারা পৃথিবী হার মেনে যাবে। খুব ভালো লাগে। ভীষণ আপন করে নিতে পারেন।
প্রথম আলো: মায়ের কাছে তো শুনেছেন এখানকার কথা।
মমতা শঙ্কর: আমার শ্বশুরবাড়ি-বাপের বাড়ি সবই এইদিকে। আমার শ্বশুরমশাই ময়মনসিংহ, বালিগড়; আমার শাশুড়ি মা ঢাকার; আমার বাবা যশোর, কালিয়া; আর মা হচ্ছে খুলনার, বাটাচর। এত গল্প শুনেছি মায়ের কাছে, এখন সাতানব্বই বছর বয়স তাঁর। আসার আগে মা বলছেন, ইস তুই বাংলাদেশ যাচ্ছিস! তুই যদি আমায় একটু বলতি আগে, আমি তোর সঙ্গে যেতাম। গিয়ে আমি একটু বাটাচরটা দেখে আসতাম। সেই গাছগুলো, সেই নদীগুলো দেখে আসতাম। আমি বললাম, মা, তুমি গেলে কষ্ট পাবে। না দেখাই ভালো। তোমার মনের মধ্যে যেটা আছে সেটাই থাক। নিশ্চয়ই সব চেঞ্জ হয়ে গেছে, এর সেরকম নেই।
প্রথম আলো: আপনি তো নৃত্যশিল্পী, অভিনয়শিল্পী। আবার উদয়-অমলা শঙ্করের মেয়ে। কোন পরিচয়টা বড় আপনার কাছে?
মমতা শঙ্কর: আমি আমার বাবা মায়ের মেয়ে। ওর স্ত্রী, দুই ছেলের মা, দুই পুত্রবধূর শাশুড়ি মা। মা-ই। এবং সবার কাছে মম দি বা মম মাসি। এইটাই আমার কাছে আসল ভালো লাগার জায়গা। যেটা থেকে যায় আমার সঙ্গে সব সময়।
প্রথম আলো: ‘আগন্তুক’ সিনেমার পর ‘আগন্তুকের পরে’ নামে কোনো সিনেমা হচ্ছে?
মমতা শঙ্কর: একটা কথা হচ্ছে, তবে বাবুদা যদি পারমিশন দেন। সেটা হলে খুব মজা হবে।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
মমতা শঙ্কর: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।