উদয় শঙ্করের নাচকে কেউ সেভাবে বোঝেইনি
কিংবদন্তি নৃত্যশিল্পী উদয়-অমলা শঙ্করের মেয়ে মমতা শঙ্কর সম্প্রতি এক নৃত্য কর্মশালায় যোগ দিতে ঢাকায় এসেছিলেন। কর্মশালাটি আয়োজন করে সাধনা। ৬ আগস্ট দুপুরে সাধনার কার্যালয়ে তিনি প্রথম আলোর আলাপচারিতায় মাতেন। তাঁর স্বামী চন্দ্রোদয় ঘোষও ছিলেন সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন প্রণব ভৌমিক। আনন্দ পাতায় সাক্ষাৎকারের সংক্ষেপিত রূপটি প্রকাশিত হয়েছে। এখানে তিন পর্বে সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হলো। আজ রইল দ্বিতীয় পর্ব।
প্রথম আলো: আপনার বাবা উদয় শঙ্করকে বলা হয় ভারতীয় আধুনিক নৃত্যের পথিকৃৎ। তাঁর সময় থেকে এখনকার ভারতের নৃত্য—এ সময় পর্যন্ত বিবর্তনকে আপনি কীভাবে দেখেন?
মমতা শঙ্কর: আমার কাছে খুব কষ্টের। কারণ, বাবার নাচের যে আধুনিকতা, সত্যিই তো ইন্ডিয়ান কনটেমপোরারি ড্যান্সের হি ইজ দ্য ফাদার। উনি পিতা। এখন সেটার মানেটা কেউ সেইভাবে বোঝেনি। তাঁরা ভেবেছে যে আধুনিক মানেই ইস্টার্ন ও ওয়েস্টার্ন নাচের ফিউশন। এটা যে কত ভুল! সেটা লোককে বোঝাতে ভীষণ কষ্ট। এখন চন্দ্রোদয় আর আমার দুজনেরই একটাই ব্রত যে ওইটাকে বোঝাতে হবে মানুষকে। আমরা সারা পৃথিবীর ভালো জিনিসটাকে নেব। কিন্তু নিয়ে সেটাকে নিজের মতো করে একটা নতুন জিনিস করে প্রেজেন্ট করব। এখন যেটা খুব দুঃখের দেখলাম, যেটা আমাদের কলকাতায়ও হচ্ছে, সারা ভারতবর্ষে হচ্ছে এবং বাংলাদেশেও এসে দেখলাম যে কনটেমপোরারি মানেই বিদেশি কনটেমপোরারি যে ড্যান্স দেখি তার একটা ছাপ। এবং সেটা এমনভাবে বসে গেছে, এমন গভীরভাবে ঢুকে গেছে যে এত ভালো ভালো ড্যান্সার, তাঁরা তার থেকে আর বেরোতে পারছে না। সবকিছুর মধ্যে সেটার ছাপ এসে যাচ্ছে। তাদের বোঝানো হচ্ছে না যে আমাদের দেশের ফোক ড্যান্স, আমাদের দেশের শাস্ত্রীয় নৃত্যের কথা বাদই দিলাম, সেটা তো আছেই, কিন্তু ফোক ফরমগুলো কত রকম! মানে একটা জায়গা থেকে আরেকটু এগিয়ে গেলেই আরেক রকম পোশাক, আরেক রকম ফোক ড্যান্স। সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে আছে। সেখান থেকে তার নির্যাসগুলোকে নিয়ে আমরা যদি একটা নতুন নাচ সৃষ্টি করতে পারি, তার মধ্যে ওয়েস্টার্নের যে ভালোটুকু সেটুকু নেব, কিন্তু অন্ধভাবে একেবারে সেইটাকেই... চন্দ্রোদয় সব সময় বলে রাবার স্ট্যাম্পের মতো...
চন্দ্রোদয় ঘোষ: আমাদের দেশের নাচেও, যাঁরা শাস্ত্রীয় নৃত্য নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন, তারা কিন্তু সেই শাস্ত্রীয় নৃত্য সম্বন্ধে, তার গভীরতা সম্বন্ধে, তার ইতিহাস সম্বন্ধে কতটা জানেন আমার সন্দেহ জাগে। যখন দেখি তারা ঠিক যেটুকু শিখেছেন, সেটুকুই করছেন এবং তার পুনরাবৃত্তি চলছে। কিন্তু রাস্তা খুঁজছেন, সেটা বোঝা যায়। কিন্তু সেটা করতে গেলে তো নিজের মধ্যে একটা উপলব্ধি দরকার, একটু পড়াশোনা দরকার, একটু জানা দরকার। একটা জিনিস না জানলে আমি সেটা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করব কী করে? তখন আমার রাবার স্ট্যাম্প হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। ওর বাবা সেই রাস্তাটা আমাদের দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, এই রাস্তার তো শেষ নেই! কিন্তু সর্বাগ্রে তুমি একজন বিশ্বের নাগরিক, সেটা মনে রাখবে। এবং তোমার কাজের মধ্যে সমকালীন ছাপটা যেন থাকে। এখনকার সময়। এটা ইতিহাস তো, সংস্কৃতি যেকোনো দেশের ইতিহাসে একটা বিশেষ মূল্য নিয়ে থাকে। যেকোনো দেশকে আমরা মনে রাখি দেখবেন, মানে কে কত দেশ রাজত্ব করেছিল, কে রাজা ছিল, রানি ছিল, সেটা আমাদের মনে থাকে না। সাংস্কৃতিক দিকটা অনেক বেশি মনে থাকে। সাহিত্য, সংস্কৃতি, সংগীত, ভাস্কর্য, এটাই তো পড়ে থাকে। সেটা তো জানতে হবে। তবে তো আমি রেখে যাব কিছু। আর যদি আমি রাবার স্ট্যাম্প হই, আমি এখানটাও জানলাম না, বিদেশটাও জানলাম না। যেটুকু পেলাম, সেটুকু নিয়ে একটা যেটা করলাম, সেটাকে বললাম কনটেমপোরারি। ওরা একটা ওয়ার্ড ইউজ করেন ফিউশন, তার আগে আমার মনে হয় সি, ও, এন-টা দেওয়া উচিত অডিয়েন্সের জন্য। মস্ত বড় একটা কনফিউশন হয়ে যায়, এটা কী দেখলাম, এটাকে আমি কী বলব!
মমতা শঙ্কর: আর কী হয়, এখন যেটা হয়, আমার ভীষণ দুঃখ লাগে যে বিদেশিরা আসছে আমাদের দেশ থেকে আরও কী করে ওদের জিনিসকে সমৃদ্ধ করবে সেই জন্যে, সেখানে আমরা গিয়ে ওদের জিনিস নিয়ে দেখাচ্ছি। এবং আরও কষ্টটা হয় যখন ওদের জিনিস ওদেরকে দেখাই, সেটা সব সময় আমাদের রুচির সঙ্গেও মেলে না। ওদের সবকিছুর সঙ্গে সেটা মেলে। আমার কোথাও একটা কষ্ট হয় তখন। এটা ঠিক উদয় শঙ্করের নৃত্যধারার একেবারে অপজিট, মানে বিপরীত দিকে চলে। আর উদয় শংকরের ড্যান্স ফরমটা, অত্যন্ত ফ্রিডম আছে তার, সাংঘাতিক ফ্রিডম, কিন্তু তার একটা নিজস্ব নিয়ম আছে। এই চোখটাই আমার মা খুলে দিয়েছেন যে কোনটা হলে সেটা উদয় শঙ্কর স্টাইল হবে, আর কোনটা হলে সেটা উদয় শঙ্কর স্টাইলের বাইরে চলে যাচ্ছে। আর আমার বাবা একটা কথাই ছোটবেলা থেকে বলে গেছেন যে আমি যেটা করছি, আমি যা করে গেছি, সেটাই রিপিট করে যেও না। নতুন কিছু করো। আরও নতুন ভাবো। নতুন চিন্তাধারা, নতুন মুভমেন্টস, সবকিছু করো, কিন্তু তোমার শেকড়টা ভুলে যেও না। একদিকে গর্ব বোধ কর যে তুমি এই দেশে জন্মেছ, আবার তুমি একজন বিশ্বনাগরিক, সেটাও মনে রেখো। সুতরাং সে জিনিসটা যেন সবার ভালো লাগে। সবার রুচিতে যেন সেই জিনিসটা যায়। মানে সৌন্দর্যবোধ, রুচিবোধ। বাবা বিদেশ থেকে যেটা এনেছিলেন, তার নাচের মধ্যে যেটা ভীষণভাবে দেখা যায় সেটা হলো শোম্যানশিপ—কেমন আলো হবে, কোথায়। কারণ তিনি একজন পেইন্টার ছিলেন। তাঁর কাছে স্টেজটাই ছিল একটা ক্যানভাসের মতো। কী রকম আলো হবে, কী পোশাক হবে, কোথায় কাকে দাঁড় করানো হবে, কোনো একটা ক্যারেক্টার যখন ইন্ট্রোডিউসড করা হবে তখন অন্যরা কী করবে, যাতে হাইলাইটেড হয় সেই ক্যারেক্টারটা, এই জিনিসগুলো উনি শিখেছিলেন বিদেশ থেকে। সবচেয়ে বড় কথা সবকিছু ছোট রাখো। ডিউরেশন ছোট করো। ভালো জিনিসও, যদি একটা ভালো খাবারও ঠেসে ঠেসে খাওয়ানো হয়, তারপরে লোকের অরুচি এসে যায়। সেটা আর তখন ভালো লাগে না। সুতরাং বাবা সব সময় বলতেন, ‘খিদেটাকে বাড়িয়ে রাখো। মানুষের খিদে থাকতে থাকতে বন্ধ করে দাও।’ যাতে মানুষ বলে যে, ইস যদি আরেকটু দেখতে পারতাম! কিন্তু এ নয়—‘বাবা, খুব ভালো কিন্তু বাবা, আর পারছি না’—এটা যেন না বলে।
চন্দ্রোদয় ঘোষ: আরেকটা কথা বলতে হয় ওর বাবা সম্পর্কে, তিনি মনেপ্রাণে কতটা ভারতীয় ছিলেন! যখন প্রথমদিকে করতেন তখন লাইভ মিউজিশিয়ানস, তারা থাকতেন মঞ্চে, তো প্রত্যেকটা পিসের সঙ্গে মিউজিসিয়ানদেরও ড্রেস চেঞ্জ করতে হতো। শুড বি কম্পাটিবল উইথ আমি যেটা দেখাচ্ছি তোমায়। ওই যে যেহেতু পেইন্টার ছিলেন পুরো ছবিটা চোখে যেরকম ছিল সেভাবেই...
মমতা শঙ্কর: পুরো স্টেজটাই ওইরকম দেখতে হবে।
চন্দ্রোদয় ঘোষ: যে জন্য ওইসময় ওর এত চাহিদা হয়েছিল, লোকে ভালোবাসত—এটার জন্য যে আমরা ভারতবর্ষকে নতুন করে পেলাম। ইনি এসে আমাদের দেখালেন। সে পৌরাণিক জিনিসই দেখানো হচ্ছে, কিন্তু তার উপস্থাপনাটা নতুন। সেই ভারতীয়ত্বের থেকে কোনো দিন সরে আসেননি, ইস্ট-ওয়েস্ট ফিউশন বলতে কিন্তু এটা বোঝায় না। উনি ওয়েস্টের যেটা নিয়েছিলেন, প্রেজেন্টেশন। এবং যেটা মম বললেন যে সময়, কতটুকু হবে, কিন্তু টোটালিটিতে ইট শুড বি ইন্ডিয়ান।
আগামীকাল থাকছে…
সত্যজিৎ রায় শেষ ছবিতে আমাকেই চেয়েছিলেন