‘তারা বন্দুক উঁচিয়ে বলছিল, সজলকে দেখামাত্র গুলি করা হবে’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে মামলা হয় রিয়েলিটি শো ‘পাওয়ার ভয়েস’খ্যাত গায়ক সজলের বিরুদ্ধে। মামলার পর দুই সপ্তাহের বেশি পালিয়ে থাকতে হয় তাঁকে। এর মধ্যে তাঁর মহাখালীর আরজতপাড়ার বাসায় একাধিকবার ব্লক রেইড দেওয়া হয়। আন্দোলনের সময়ের গল্পগুলো গতকাল সোমবার দুপুরে প্রথম আলোকে জানালেন সজল। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনজুর কাদের

প্রথম আলো:

মামলার এজাহারে দেখলাম আপনার রাজনৈতিক পরিচয় দেওয়া হয়েছে বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মী।

সজল: আন্দোলনের ওই মুহূর্তে বাংলাদেশের যে পরিস্থিতি ছিল, সরকারের মতের ভিন্নমতে যাঁরাই ছিলেন, তাঁরাই বিএনপি-জামায়াত ও দুষ্কৃতকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। গালি খেয়েছেন। সাধারণ জনগণ, আমার ৫ বছরের মেয়ে, আমার মা—তাঁরাও আন্দোলনকারীদের পানি খাওয়াইছেন, তাহলে তাঁরাও দুষ্কৃতকারী, দুর্বৃত্ত এবং বিএনপি-জামায়াত! আমার বোন চিকিৎসক, সে আন্দোলনরত সাউথ ইস্ট, আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটির এবং আমার আশপাশের শত শত আন্দোলনকারী যারা ছররা গুলি খেয়েছে, তাদের চিকিৎসা করেছে, তার মানে আমার বোনও বিএনপি-জামায়াত আর দুষ্কৃতকারী। এই হচ্ছে অবস্থা। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার, সরকার জুলুম-নিপীড়ন এমনভাবে করেছে, মামলার তালিকায় আমার নাম ৩০ নম্বরে, ৩১ নম্বরে আমার মামাতো ভাই। তবে এখানে এক নম্বর আসামি যে, তিনি বিএনপির অনুসারী, তাঁকে আমরা চিনি। তাঁদের তো নাম দেবেই। আর আমাদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই, আমরা শিল্পী, পপুলার—এ কারণে নাম দিয়েছে। ব্লক রেইড পড়ছে এক নম্বর আসামি আর আমার বাড়িতে, এর বাইরে আর কারও বাড়িতে ব্লক রেইড পড়েনি। ওই তালিকায় আরও কয়েকজন মানুষের নাম দিয়েছে, যাঁদের বয়স অনেক, বৃদ্ধা—একসময় বিএনপি সমর্থন করলেও এখন আর সক্রিয় না।

সজল
ছবি : শিল্পীর সৌজন্যে
প্রথম আলো:

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে কবে থেকে যুক্ত হয়েছেন?

সজল: আমি প্রথম দিন থেকে যুক্ত ছিলাম। যেদিন থেকে রাজপথে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের হামলা হয়, সেদিন থেকে। আমার কিন্তু কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই। আমি একজন শিল্পী। শিল্পীদের কোনো সংগঠন নেই। আমি শুধু আন্দোলনে যুক্ত হয়েছি, সরকারের স্বৈরাচারী মনোভাব, জুলুম এবং নির্যাতনের বিরুদ্ধে। তবে এই লড়াই দলের বিরুদ্ধে না হলেও নির্যাতনকারীরা অবশ্যই দলীয়। কারণ, আমাদের বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে নির্যাতনকারীরা চিহ্নিত ছিল। আমাদের এলাকার কথা নির্দিষ্ট করে যদি বলি—এই এলাকার রাজত্ব, জুলুম, চাঁদাবাজি, প্রহসনটা একমাত্র সরকারি দলে যাঁরাই ছিলেন, তাঁরাই করেছেন। শুধু সরকারি দলের লোকজন করেছেন।

প্রথম আলো:

আন্দোলন ঘিরে কবে থেকে আপনার ওপর চাপ বাড়তে থাকে?

সজল: যেদিন মহাখালী টোল প্লাজায় আগুনের ঘটনা ঘটে, সেদিনই আমার এলাকা আরজতপাড়ায় পুলিশ ও ছাত্রলীগের গুলিতে ছয়জন নিহত হন। আমার চোখের সামনে তিনজন নিহত হন। চোখের সামনে দিয়ে লাশ নিয়ে গেছে। এই মধ্যে তিনজন সাধারণ পথচারী, দুজন অল্পবয়স্ক ছিল। একজন সিভিল এভিয়েশন স্কুলের সামনে ফুল বিক্রি করত, তাকে টার্গেট করে হেডশুট করা হয়। সে আন্দোলনে যুক্তও ছিল না। আমাদের এখানে রেললাইন থাকার কারণে, সর্বস্তরের মানুষ আন্দোলনের ওই সময়টায় রেললাইনের ওপরে ছিল, মহিলারাসহ। যেদিন মহাখালী টোল প্লাজায় আগুনের ঘটনা ঘটে, সেদিন মহাখালীর আন্দোলন দমানো যাচ্ছিল না। তখন আন্দোলন ঠেকাতে হেলিকপ্টার দিয়ে গুলি, টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড আর আমাদের এখানে বুলেট ফায়ার করা হয়। এর আগে প্রথম দিন থেকে ছররা গুলি করছে। আমার সামনে কয়েকজনের গায়ে ছররা গুলি লেগেছে। ১৮ জুলাই আমাদের এলাকায় তো আন্দোলনে থাকা সবাইকে লক্ষ্য করে নির্বিচার গুলি করে। পরদিন সকালে এসবির কাছে ভিডিও ফুটেজসহ আমার নাম গেছে। ফুটেজে কী দেখা গেছে জানেন?

প্রথম আলো:

কী দেখা গেছে?

সজল: পুরো আন্দোলনে আমি একটা ইটও হাতে নিইনি, লাঠিও নিইনি। আমরা ছিলাম ছাত্রদের পক্ষে। ছাত্ররা আমাদের পেয়ে উৎসাহিত আর উজ্জীবিত ছিল। সেখানে আমরা কিছু দিকনির্দেশনায় ছিলাম। যেমন আমরা পানি দিয়েছি। ওদের গায়ে গুলি লাগলে চিকিৎসাসেবা দিয়েছি। ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার মধ্যে আমরা অগ্রসর ভূমিকা পালন করছি—এই আরকি। কিন্তু আমার ফুটেজের কথা বলে যেটা করা হয়েছে, এখানে আওয়ামী লীগের ক্লাবগুলো যখন ভাঙা হয়, তখন আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। এখন আমি তো ৬ ফুট লম্বা, চুলখোলা—দাঁড়ালেই সবাই আমাকে চেনে। ওখানে কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের কোনো নেতৃত্বই ছিল না। সবই শিক্ষার্থী। সবাই মিলে আমাকে নেতা বানায়ে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের ক্লাব ভাঙার সময় আমাকে দাঁড়ায়ে থাকতে দেখা গেছে—এটাই আমার অপরাধ। যাদের ক্লাব ওরাও কিন্তু দাঁড়ায়ে ছিল। পরবর্তী ওরাই পুলিশ পাঠিয়ে আমার বাসায় হয়রানি করেছে। আমার বাসা ভাঙচুর করা হয়। বাসা থেকে ৬০ হাজার টাকা, বিল্ডিংয়ের ভাড়ার টাকা নিয়ে যায়। পরে আধা ঘণ্টা পর পুলিশ এসে সেই সিসিটিভি ফুটেজও ডিলিট করে দিয়ে যায়।

প্রথম আলো:

কোন ধরনের চাপ এসেছে আপনার ও আপনার পরিবারের ওপর?

সজল: আমার এলাকা আরজতপাড়া ইউনিটের আওয়ামী লীগের সমর্থকদের পক্ষ থেকে আমার বাসায় সুনির্দিষ্টভাবে ব্লক রেইড দেওয়া হয়। বাসার কয় তলায় কোন ইউনিটে থাকি, সব চিহ্নিত করে দেওয়া হয়। তারা পুলিশকে পরে গালাগালিও করে বলে জানতে পারি, একটা বাচ্চাও ধরতে পারে নাই, এ কেমন পুলিশ! অথচ আমার কোনো দলীয় পরিচয় নেই। আমার হাতে লাঠিসোঁটাও ছিল না। আমি কোনো ভাঙচুরেও ছিলাম না। কিন্তু আমরা আন্দোলনে ছিলাম। আমরা যে আন্দোলন করেছি, আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে এখন যে স্থিতিশীল পরিস্থিতির আহ্বান জানানো হচ্ছে, এই স্থিতিশীলতার বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার। যেখানে আমরা কোনো প্রতিঘাতেও অংশ নিইনি, আমরা কিন্তু প্রতিবাদে আছি।

মায়ের সঙ্গে সজল
ছবি : প্রথম আলো

প্রথম আলো :

কত দিন পালিয়ে থাকতে হয়েছে?

সজল: আমি পালিয়ে ছিলাম ১৫ দিন। বিজয়ের দিন ফিরে আসছি। এখনো ট্রমায় আছি। পালিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ছিলাম। এরপর আমি আর কোথায়ও আন্দোলনে অংশ নিতে পারিনি। কারণ, শুনেছি আমাকে দেখামাত্রই গুলি করার হুকুম ছিল, এটা আমি জানতে পারি, আমার পুরো এলাকায় এটা বলাবলি হয়েছে। আমি আমার এলাকায় অনেক ফোকাসড ছিলাম। আমার বাসায় যখন পুলিশ হামলা করেছে, তারা বন্দুক উঁচিয়ে ভাঙচুর করার সময় বলছিল, সজলকে দেখামাত্র গুলি করা হবে। আমার অপরাধ, আমি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে, রাজপথে থাকা মানুষ।

সজল
ছবি : শিল্পীর সৌজন্যে
প্রথম আলো:

ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। নতুন সরকার গঠন হয়েছে। আপনার প্রত্যাশা কী?

সজল: ১৯৯০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক সিস্টেম ছিল, তা গণতান্ত্রিক। এই পুরো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে আমরা একটা নতুন প্রক্রিয়ার বাংলাদেশ চাই। অবশ্যই গণতান্ত্রিক এবং সেটা প্রজাতন্ত্রের হতে হবে, রাজতন্ত্র নয়; যে বাংলাদেশের মূল ভিত্তি হচ্ছে, সরকারি সব প্রতিষ্ঠান আমাদের সেবক হবে। যেখানে আমাদের কোনো ঘুষ বা তদবির প্রয়োজন পড়বে না। আমি এটাও বলতে চাই, শহরকেন্দ্রিক আমাদের যে ছোট ছোট এলাকা, এসব এলাকায় যারাই রাজনীতি করত, তারাই ঘুরেফিরে দল পরিবর্তন হওয়ার পরও একই সিস্টেমে একই মানুষেরা রাজনীতি করে। এখন আমরা তারুণ্যের ঝলক দেখতে চাই। সুশৃঙ্খল আর সুনিশ্চিত নিরাপত্তা চাই। আমাদের বাংলাদেশের অর্থনীতি যেন চাঙা হয়। মাঠে-ময়দানে যাতে আবার হাজার হাজার মানুষের সামনে গাইতে পারি।

প্রথম আলো :

এবার গানের প্রসঙ্গ।

সজল: গানবাজনা এখন শূন্য। আল্লাহ জানেন, কবে আবার আয়রোজগার শুরু হবে।