এসব দেখে আনন্দে চোখের কোণে পানি চলে আসে: শাবানা

সেকালের শাবানা ও একালের শাবানাছবি: ফেসবুক
মাত্র আট বছর বয়সে সিনেমায় অভিনয়ে নাম লেখান শাবানা। এহতেশাম পরিচালিত ‘নতুন সুর’ নামের ছবিতে তিনি শিশুশিল্পী হিসেবে কাজ করেন। এরপর ‘চকোরী’ ছবিতে নায়িকা চরিত্রে অভিনয় শুরু। ১৭ বছর ধরে অভিনয় থেকে দূরে সরে আছেন চলচ্চিত্রের গুণী এই অভিনয়শিল্পী। অভিনয়জীবনে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা অবস্থায় হুট করেই যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান তিনি। ২৩ বছর ধরে সেখানে আছেন। স্বামী, সন্তান, নাতি-নাতনি নিয়ে তিনি নিউ জার্সিতে স্থায়ীভাবে থাকছেন। একটা নির্দিষ্ট সময় পর বাংলাদেশে এলেও তিন বছর ধরে আসা হয়নি। ইচ্ছে আছে আগামী বছরের কোনো একদিন ঢাকায় আসার। ১৫ জুন দেশের বরেণ্য এই অভিনয়শিল্পীর জন্মদিন। গতকাল বাংলাদেশ স্থানীয় সময় বুধবার দিবাগত রাত দুইটায় প্রথম আলোর সঙ্গে কথা হয় এই অভিনয়শিল্পীর।

প্রশ্ন :

শাবানা আপা, শুভ জন্মদিন।

ধন্যবাদ। এত দূর থেকে মনে করে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোয় অনেক খুশি হয়েছি। এক দিন আগেই তো জানিয়ে দিলে। ওহ হো, বাংলাদেশে তো আজ ১৫ জুন।

প্রশ্ন :

কেমন আছেন?

আলহামদুলিল্লাহ। আমি ভালো আছি। সুস্থ আছি। স্বামী, সন্তান, নাতি-নাতনি নিয়ে ভালোই আছি।

প্রশ্ন :

তা এবার কত বছর হলো?

১৯৫২ সালে জন্মগ্রহণ করেছি। সে হিসাবে যত বছর হয় আরকি। বয়সের হিসাব আমি এতটা অবশ্য করি না। বয়স চলে বয়সের মতো, আমি আমার মতো।

চার বছর আগে ঢাকার বারিধারায় বাসায় প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপ শেষে শাবানা ও তাঁর স্বামী ওয়াহিদ সাদিক
ছবি : প্রথম আলো

প্রশ্ন :

তারকা, মহাতারকা সবার জন্মদিন আয়োজন একটু জমকালো হয়। এদিনটায় আপনার কেমন লাগে?

(হাসি) এই বয়সে আর জন্মদিন। এখন নাতি-নাতনিদের জন্মদিন উদ্‌যাপন করি। নিজের জন্মদিনের কথা তো মনেও থাকে না। তোমরা যখন বলো, তখন মনে হয়।

প্রশ্ন :

আপনাকে নিয়ে রাত ১২টা থেকে পরিচিত, অপরিচিত সবাই ফেসবুকে নানা কিছু লিখছেন। পুরোনো দিনের অনেক স্থিরচিত্রও পোস্ট করছে। কয়েক বছর ধরেই এমনটা লক্ষ করা যাচ্ছে। এসব কি আপনার নজরে আসে?

আমার তো ফেসবুকে কোনো আইডি নেই। তবে ফেসবুকে যে লেখালেখি হয়, এসব আমার ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি সবই জানায়। তারা দেখায়ও, কোথায় কী লেখা হয়েছে। কে কী ভিডিও ক্লিপ আপলোড করেছে, আমি ওসব দেখি। বেশ উপভোগ করি। নস্টালজিক হই। ছেলে-মেয়ে যখন বলে, আম্মু দেখো দেখো তোমাকে নিয়ে কীসব লিখেছে। তখন অনেক ভালো লাগে। আনন্দ লাগে। মনে হয়, মানুষ  আমাকে এখনো ভোলেনি, আগের মতোই ভালোবাসে। আগের চেয়ে বেশিও ভালোবাসে। সবার এই নিঃস্বার্থ ভালোবাসায়—সেই দিনগুলোতে ফিরে যাই। খুশির স্মৃতিগুলো মনে পড়ে। আবেগাক্রান্ত হই। এসব দেখে আনন্দে চোখের কোণে পানি চলে আসে।

প্রশ্ন :

অভিনয়ের চূড়ান্ত ব্যস্ত সময়ে আপনি চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। এ জীবনে আরও কখনো চলচ্চিত্রের পর্দায় দেখা যাবে কি?

আরে নাহ, এ বয়সে আর কীভাবে। এখন তো অনেক বয়স হয়ে গেছে। আল্লাহর নাম নিয়ে পার করে দিচ্ছি সময়। মাঝেমধ্যে সুখময় স্মৃতিগুলো মনে করি। ছেলে-মেয়েরা, নাতি-নাতনিরা মাঝেমধ্যে আমার ছবি সম্পর্কে নানা কিছু জিজ্ঞেস করে। আমিও তখন বলি, ওই ছবিটা দেখো। এখন পরিবারটাই আমার আরেকটা জগৎ। এ জগতে আমার অনেক ব্যস্ততা।

শাবানা
ছবি : প্রথম আলো

প্রশ্ন :

অভিনয় ছেড়ে দিয়ে সংসার ও ধর্মকর্ম নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখছেন। অভিনয় সময়ের জীবন নিয়ে নিজের মধ্যে কোনো ভাবনা কাজ করে কি?

ওসব নিয়ে এখন আর সত্যিই ভাবি না। কারণ, আমি যখন অভিনয় করতাম, মনপ্রাণ দিয়ে তা-ই করতাম। অভিনয়ের সময় আমি সবকিছু ভুলে যেতাম, শুধু অভিনয় নিয়েই থাকতাম। আমি কখনোই আমার কাজে ফাঁকি দিইনি। ভালো-খারাপ যদি কিছু হয়ে থাকে, তা দর্শকেরাই বলবে। একজন অভিনেত্রী, সংগীতশিল্পী, খেলোয়াড়, রন্ধনশিল্পী—সবাই কিন্তু চান তাঁর সেরাটা উপহার দিতে। আমিও তেমনটাই চেয়েছিলাম।

প্রশ্ন :

একটা সময় কিন্তু আপনার বেগম রোকেয়া চরিত্রে অভিনয়ের খুব ইচ্ছা ছিল, ঢাকায় শেষ যখন এসেছিলেন সেটার আক্ষেপও জানিয়েছিলেন।

এটা আমার দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নও বলা যেতে পারে। কিন্তু তা আর হলো কই। বেগম রোকেয়া চরিত্রটি না করার আক্ষেপটা থেকেই যাবে। আমি মনে করি, এখন সেই পরিচালকও নেই। আমার বয়সও কাভার করবে না। শুধু শুধু স্বপ্ন দেখলেও তো হবে না।

প্রশ্ন :

প্রবাসে থাকা আপনার সঙ্গে সমসাময়িক বা কারও সঙ্গে যোগাযোগ হয়?

আমার সঙ্গে কারও কোনো যোগাযোগ নেই। কারও সঙ্গে না।

চিত্রনায়িকা শাবানা
সংগৃহীত

প্রশ্ন :

আপনাদের সময়ে আপনি ছাড়াও ববিতা-কবরী একচেটিয়া কাজ করেছেন। তিনজনের মধ্যে কার সঙ্গে আপনার প্রতিযোগিতা বেশি ছিল বা নিজেদের মধ্যকার সম্পর্কটা কেমন ছিল?

সত্যি কথা বলতে, তাঁদের কারও সঙ্গে আমার কোনো রেষারেষি ছিল না। ডিরেক্টররা যখন আমাকে পছন্দ করত, আমি আমার মতো কাজ করতাম। অন্যদের নিয়ে কখনোই ভাবতাম না। কে আমার প্রতিযোগী বা কে কী। ববিতার সঙ্গে যেমন আমার কয়েকটা ছবিতে অভিনয় করা হয়েছে, তেমনি কবরীর সঙ্গেও একটি ছবিতে অভিনয় করা হয়েছে—‘অবাক পৃথিবী’। অথচ কবরীর সঙ্গেও আমার গলা জড়াজড়ি করা অনেক ছবি আছে। তবে দুজনের মধ্যে ববিতার সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। আমাকে ফোনও করত। আমেরিকা আসার পরও, ফোন করে খবর নিত। জিজ্ঞেস করত, কেমন আছ আপা? সত্যি কথা বলতে, আমার কারও সঙ্গে কোনো ঝামেলা ছিল না। আমিও কাউকে কোনো দিন কম্পিটিটর হিসেবে ভাবতাম না।

প্রশ্ন :

ওই সময়টায় নায়কের মধ্যে কার সঙ্গে আপনার বোঝাপড়া বেশ ভালো ছিল?

আমি তো রাজ্জাক ভাই, আলমগীর ভাই, ওয়াসিম, জসীম, পারভেজ ভাই (সোহেল রানা), উজ্জল ভাই, ফারুক, ইলিয়াস কাঞ্চন—সেই সময় কেউই বাদ ছিল না, যাঁদের সঙ্গে কাজ করেছি। একমাত্র পারভেজ ভাইয়ের ছোট ভাই, কী জানি ওর নাম, রুবেল, ওর সঙ্গে শুধু কাজ হয়নি। সে আমার অনেক জুনিয়রও ছিল। সিনিয়রদের মধ্যে সবার সঙ্গে অভিনয় করেছি। সবার সঙ্গেও আমার চমৎকার আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। সিনিয়রদের মধ্যে একমাত্র রাজ্জাক ভাই আমাকে শাবানা নামেই ডাকত। এর বাইরে আলমগীর ভাই ম্যাডাম, পারভেজ ভাইসহ সবাই ম্যাডাম বলে ডাকত। ফারুক ডাকত বুবু নামে। তবে রাজ্জাক ভাই অলমোস্ট আমাদের সমসাময়িক কারও সঙ্গে আপনি করে কথা বলতেন না, তুমি বলেই ডাকতেন, কারণ আমরা সবাই তাঁর ছোট ছিলাম।

শাবানা ও এহতেশামুর রহমান। মাত্র আট বছর বয়সে সিনেমায় অভিনয়ে নাম লেখান শাবানা। এহতেশাম পরিচালিত ‘নতুন সুর’ নামের ছবিতে তিনি শিশুশিল্পী হিসেবে কাজ করেন

প্রশ্ন :

আপনাকে বুবু ডাকত যে মানুষটা, সেই ফারুক কয়েক দিন আগে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেন। আজীবনের জন্য আপনিও বুবু ডাক থেকে বঞ্চিত হলেন?

আহারে...অনেক ভালো মানুষ ছিল। সরল ছিল। হাসিখুশি ছিল। চারপাশটা জমিয়ে রাখত। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের সময় শেষবার দেখা হয়েছিল। আমাকে দেখেই ডাক দিল, এই বুবু আমি এদিকে। মুখ ঘুরিয়ে দেখি ফারুক ভাই। আমাকে বললেন, চলো, আমার গাড়িতে করেই চলো। তোমাকে আমি নামিয়ে দেব। আরেকটা কথা, ঈদ বা বিশেষ দিনে ফারুক কিন্তু আমাকে শাড়ি উপহার দিত।

প্রশ্ন :

এটা কি প্রায়ই হতো?

আমাদের একসঙ্গে ছবিতে অভিনয়ের পর থেকেই। ছবিতে অভিনয়ের পর থেকেই, আমাকে খুব রেসপেক্ট করত। খুবই রেসপেক্ট করত। প্রায় ঈদে আমাকে শাড়ি উপহার দিত। দেখা গেল, ছবির শুটিং করছি, তার কিছুদিন পর ঈদ, আমাকে বলত, বুবু তোমার জন্য শাড়ি পাঠাই দিছি। পছন্দ না হইলেও পইরো কিন্তু।

প্রশ্ন :

সমসাময়িক নায়কদের মধ্যে কার সঙ্গে আপনার বোঝাপড়া বেশি?

রাজ্জাক ভাই ও আমি সমসাময়িক। আলমগীর ভাই আমাদের পরে এসেছেন। তবে রাজ্জাক ভাইয়ের সঙ্গে আমার ছবিতে অভিনয় কম করা হয়েছে। আলমগীর ভাইয়ের সঙ্গে বেশি করেছি। দুজনের সঙ্গেই বোঝাপড়া বেশি।

প্রশ্ন :

যেই চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির জন্য আপনি রত্না থেকে শাবানা হয়েছেন, দেশের সেই চলচ্চিত্রের খোঁজখবর রাখেন?

এত দূরে আছি, ইউটিউবে যা জানি, তাই-ই। তবে আমি যখন ঢাকায় ছিলাম, তখন শাকিব খানকে চিনতাম। শাকিবের এক্স ওয়াইফ অপু বিশ্বাসের নামটাও জানি। ইউটিউবে ওদের ছবি দেখেছি, গান শুনেছি। একবার সাদিক সাহেব (ওয়াহিদ সাদিক) ছবি বানানোর সিদ্ধান্ত নিলেন, যে কারণে শাকিব খানের সঙ্গে আমাদের বাসায় কথা হয়। সেবারই প্রথম দেখা। তখন তো দেখলাম—শাকিব খুবই সুদর্শন, ভদ্র আর অমায়িক। এরপর আর দেখা হয়নি। সিনেমা বলতে এখনো শাকিবের নাম-সুনামই শুনি। ভালো অভিনয়ও করে। ও যখন আমেরিকায় ছিল একবার ফোনে কথা হয়। শাকিব-অপুর পর এখন কারা কাজ করছে, সেটা অবশ্য জানা নেই।

প্রশ্ন :

নিউ জার্সিতে সময় কাটে কীভাবে?

নামাজ পড়ি, ঘরসংসার করি। রান্নাবান্না করি। নাতি-নাতনিদের সময় দিই।

প্রশ্ন :

আপনার সন্তানদের খবর বলুন। তাঁরা কী করছেন?

বড় মেয়ে সুমী ইকবাল এমবিএ ও সিপিএ করেছে। বিয়ে করে এখন সে পুরোদস্তুর গৃহিণী। ছোট মেয়ে ঊর্মি সাদিক হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি শেষ করে এখন সেখানেই শিক্ষকতা করছে। ছেলে নাহিন সাদিক রটগার্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে এখন চাকরি করছে।