প্রতিদিন একবার মৃত্যুর কথা ভাবি: ববিতা

কথা ছিল, এবারও ৩০ জুলাই ববিতার জন্মদিন কাটবে কানাডায় একমাত্র ছেলের কাছে। কয়েক বছর ধরে দিনটিতে এমনটাই হচ্ছে। কিন্তু করোনায় আক্রান্ত হয়ে কয়েক দিন হাসপাতালে থাকার কারণে এবার আর তা হচ্ছে না। জন্মদিন উপলক্ষে গতকাল সোমবার দুপুরে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা হয় তাঁর। জানালেন আরও কিছু ভাবনাচিন্তা। তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন মনজুর কাদের

প্রথম আলো:

কানাডায় যাওয়ার নতুন তারিখ ঠিক করেছেন?

ববিতা: করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় ফ্লাইট পিছিয়ে দিয়েছি। আশা করছি, দিন দশেকের মধ্যে আবার উড়াল দিতে পারব। সবাই বলছেন, ‘তুমি শারীরিকভাবে এখনো দুর্বল। এর মধ্যে এত লম্বা সময়ের ভ্রমণ করা ঠিক হবে না। ছেলে ওখানে একা থাকে, চাকরি করে। গিয়ে আবার যদি অসুস্থ হয়ে পড়ো, তাহলে কে দেখবে?’ একেবারে সুস্থ হয়ে তারপর যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সবাই।

প্রথম আলো:

এবারের জন্মদিনে তো তাহলে আপনার ছেলে মায়ের সঙ্গটা মিস করবেন...

ববিতা: একদম তা–ই। ওর খুব ইচ্ছা ছিল, মাকে নিয়ে সারপ্রাইজ দেবে, কত কী করবে! মাকে নিয়ে এখানে যাবে, ওখানে যাবে, ঘুরবে, খাবে। যাক, এবার হলো না আরকি। ভালো–মন্দ মিলেই তো মানুষের জীবন। কী আর করা! যা হওয়ার হয়েছে। সবকিছু যে ভালোই হবে, তা-ও নয়।

প্রথম আলো :

আপনাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা। জীবনের এই সময়ে এসে জীবনটা নিয়ে কী উপলব্ধি হয়?

ববিতা: ধন্যবাদ। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত। গেল বেশ কিছুদিন দেশ ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। আত্মীয়স্বজন সবই তো দেশের বাইরে। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়, খোঁজখবর নিতে হয়। কিন্তু পারিনি। এখনো সেভাবে পারছি না। তাই মনটা খারাপ আরকি। এই সময়ে এসে ইন্টারনেট বন্ধ করাটা তো মোটেও যৌক্তিক নয়।

ফরিদা আক্তার ববিতা
ছবি প্রথম আলো

প্রথম আলো :

এই সময় জন্মদিনে কেমন উদ্‌যাপন হয়?

ববিতা: আয়োজন করে জন্মদিন কখনোই উদ্‌যাপন করিনি। আমি মনে করি, এ নিয়ে এত হইচই করার কিছু নেই। মনে হয়, জীবন একটাই, এখনো অনেক কিছু করার আছে। কী করতে পারলাম না, এসব নিয়ে ভাবি। কয়েক বছর ধরে জন্মদিনে ঢাকায় থাকলে সুবিধাবঞ্চিত অনেক শিশু আমার বাসায় আসে। গান শোনায়, আড্ডা দেয়, ওদের সঙ্গে দুপুরের খাবার খাই। ছোট বোন চম্পা ও বড় বোন আসেন, এ-ই যা!

প্রথম আলো :

এই যে উদ্‌যাপন কমে যাওয়া, এতে কি চিন্তা বা ভয় হয়?

ববিতা: ভয় লাগার কিছু নেই। নিয়মিত ইবাদত করি, প্রতিদিন একবার মৃত্যুর কথা ভাবি। আমার খুব ইচ্ছা, আমাকে যেন বাবার কবরে সমাহিত করা হয়। আমার আব্বা বনানী কবরস্থানে ঘুমিয়ে আছেন।

প্রথম আলো:

জীবন নিয়ে আপনার উপলব্ধি কী?

ববিতা: যে জীবন মানুষের কোনো উপকারে আসে না, সে জীবন সার্থক নয়। মরে গেলে আমার ছেলে অনিক আমাকে অনেক মিস করবে। একমাত্র ছেলে তো, ওর কথা খুব ভাবি। ভক্তরা আমাকে কতটুকু মনে রাখবেন, জানি না। তবে এই জীবনে একটা জিনিস খুব ভালো লেগেছে। অনেক শিল্পীকে তা দেওয়া হয়নি, হোক তা ভারতে কিংবা বাংলাদেশ। গত বছর আমাকে যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসের মেয়র আজীবন সম্মাননা দিয়েছেন। সেদিন আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ সম্মান দিয়েছেন, ৬ আগস্টকে ‘ববিতা ডে’ ঘোষণা করেছেন। তার মানে আমি বেঁচে না থাকলেও দিনটা উদ্‌যাপিত হবে। এটা আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। তবে কবরে একা থাকার কথা ভাবলে হঠাৎ কেমন যেন লাগে। আরেকটা বিষয়, আমি অনেক দিন বেঁচে থাকতে চাই না। অসুখ–বিসুখে কষ্ট পেয়ে, বিছানায় পড়ে বাঁচতে চাই না। আমি কারও বোঝা হয়ে বাঁচতে চাই না।

‘গোলাপী এখন ট্রেনে’র একটি দৃশ্যে ববিতা
ছবি : ববিতার সৌজন্যে

প্রথম আলো :

এমন উপলব্ধি কেন?

ববিতা: চারপাশে অনেক আত্মীয়স্বজনকে দেখেছি, দিনের পর দিন বিছানায় অসুস্থ হয়ে কষ্ট পেয়েছেন। যাঁরা একা থাকেন, তাঁদের জন্য এই কষ্ট যেন আরও বেশি। তাই সব সময় এটা ভাবি, কখনোই যেন অন্যের বোঝা না হই।

প্রথম আলো :

একসময় চলচ্চিত্রে ব্যস্ত সময় কেটেছে। এখন তা নেই। সময় কাটান কীভাবে?

ববিতা: বেশ কয়েক বছর ধরে তো বছরের অর্ধেক সময় কাটে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে। ছেলে থাকে কানাডায় আর ভাইয়েরা যুক্তরাষ্ট্রে। দুই দেশে যাই। ওদের সঙ্গে ঘুরিফিরি। আড্ডা হয়। মেডিকেল চেকআপ করি। চার-পাঁচ-ছয় মাস কেটে যায়। দেশে ফিরে এলে যা কাজ থাকে, সেগুলোও করতে হয়। এখন তো বাসায় প্রয়োজনীয় সব কাজের বাইরে সময় কাটাই; গাছপালা, পাখি এসব নিয়ে।

প্রথম আলো:

কত রকম পাখি আছে আপনার সংগ্রহে?

ববিতা: আমার একটা ময়না পাখি ছিল। সেটা মারা গেছে বছর তিনেক হলো। যখন কানাডায় ছিলাম, তখন বাসার সহকারী জানান খবরটি। এটা শুনে আমার মন ভীষণ খারাপ হয়েছিল। ওই ময়না আমার হাসি নকল করত। অনিকের কথা জিজ্ঞস করত। ঘরে অতিথি এলেই বলত, ‘ওকে পানি দাও।’ ঢোকার সময় ওয়েলকাম করত। একদম মানুষের মতো করে কথা বলত। ময়না পাখিটা ৯ বছর আমার সঙ্গে ছিল। সাধারণত ময়না অনেক বছর বাঁচে। এর বাইরে লাভ বার্ড, বাজরিগর, কাকাতুয়া আর অস্ট্রেলিয়ান ও দেশি ঘুঘু আছে। এর মধ্যে আমার সবচেয়ে বেশি প্রিয় দেশি ঘুঘু। সকালবেলায় যখন ঘুঘু ডাকে, মনটা ভরে যায়। মনে হয়, গ্রামের কোনো বাড়িতে আছি। ছোটবেলায় যখন গ্রামে বেড়াতে যেতাম, ঘুঘুর ডাক অদ্ভুত লাগত। আমার এই বাড়ি শহরে হলেও গ্রামের আবহটা পাই। আমার বাড়িতে বাঁশঝাড় আছে, তার মাথার ওপর চাঁদ ওঠে, দেখতে দারুণ লাগে। আমার বাসায় যেটা সুবিধা, চারদিকে পানি। মনে হয় যেন বাড়িটা পানির ওপরই। ছোট জলাশয়, ভার্টিক্যাল গার্ডেন মিলিয়ে সবুজের সমারোহ।

প্রথম আলো :

গুলশানের মতো জায়গায় এ রকম বাড়ি বানানোর ক্ষেত্রে কোন ব্যাপারটা ভেবেছিলেন?

ববিতা: গ্রামীণ ব্যাপারটা সব সময় আমাকে অনেক বেশি টানে। গ্রামের রাস্তা ধরে হাঁটতে, বিস্তীর্ণ মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে। নদী আর নদীর ধার ধরে হাঁটতে ভালো লাগে। শীতের দিনে খেজুরগাছ থেকে রস খাওয়া—এসব ছোটবেলা থেকেই ভালো লাগত।

ববিতা ও তাঁর একমাত্র ছেলে অনিক
ছবি : ববিতার সৌজন্যে

প্রথম আলো :

শেষ কবে গ্রামে গিয়েছিলেন?

ববিতা: গত বছর আমার দাদাবাড়ি যশোরের বিজয়নগরে গিয়েছিলাম। এখন তো সব আত্মীয়স্বজন মারা গেছেন। শুধু ছোট চাচা আছেন। চাচাতো ভাইবোনেরা কানাডা, আমেরিকা, মালয়েশিয়া—এখানে–সেখানে ছড়িয়ে আছেন। এবার গিয়ে মনে একটা ইচ্ছা হয়েছে। একদিন তো মরেই যাব, গ্রামের বাড়িতে একটা মসজিদ, এতিমখানা বানাই। আমরা চলে গেলেও এটার কারণে সবাই মনে রাখবে।

রঙিন ববিতা
ছবি : ববিতার সৌজন্যে
প্রথম আলো:

এর বাইরে আর কোনো অপূর্ণ ইচ্ছা আছে যেটা সুযোগ পেলে পূরণ করতে চান?

ববিতা: এটাও তো ঠিক যে একটা জীবনে মানুষ পুরোপুরি তৃপ্ত হতে পারে না। সব চাওয়া পূরণ হয় না। তারপরও মনে হয়, ইশ্ জীবনে যদি এ রকম কিংবা ও রকম একটা গল্পের ছবিতে অভিনয় করতে পারতাম! তবে এখন আর ছবিতে অভিনয় করছি না। তারপরও আমি বোধ হয় বলতে পারি, শিল্পী হিসেবে ভালো ভালো পরিচালকের বেশ কয়েকটি ছবির অংশ হতে পেরেছি। ভালো পরিচালকদের মধ্যে যাঁরা আমাকে পারিশ্রমিক দিতে পারবেন না বলে মনে হতো, তাঁদের বিনা পয়সায়ও কাজ করে দিয়েছি। যদিও আমার পেশা ছিল অভিনয়, তারপরও আমি জানতাম, যে পারিশ্রমিক তখন পেতাম, তা তিনি বা তাঁরা আমাকে দিতে পারবেন না। সে সময় শেখ নেয়ামত আলী ছবি বানাচ্ছিলেন, নাম দহন। আমাকে জানালেন যে সামাজিক দায়বদ্ধতার গল্প নিয়ে ছবিটা। ওই ছবি বানাতে গেলে আমি অন্য ছবিতে যা পেয়ে থাকি, তা দিতে পারবেন না। সুভাস দত্তর গলির ধারের ছেলেটি, বসুন্ধরা, ২৩ নম্বর তৈলচিত্র—এসব সুন্দর সুন্দর ছবির ক্ষেত্রে মনে হতো যে আমি পারিশ্রমিক নেব না। তবে যেটা হয়েছে যে এসব ছবির বদৌলতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎসবে অংশ নিতে পেরেছি, পুরস্কৃত হয়েছি, নিজের দেশে হাততালিও পেয়েছি। এটা স্বীকার করছি, আমরা তো সবাই চলে যাব। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় ছোট্ট করে হলেও কোনো না কোনো একদিন আমার নাম ছোট্ট করে হলেও উচ্চারিত হবে।

ববিতা-রাজ্জাক
ছবি: সংগৃহীত

প্রথম আলো :

শেষে জানতে চাই, এখন যেহেতু আগের মতো ব্যস্ত নন, নিজের অভিনীত ছবিগুলো নিশ্চয়ই দেখা হয়। কেমন লাগে?

ববিতা: এর মধ্যে নিজের ম্যাকবুকে সার্চ করে ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ দেখলাম। ‘অশনী সংকেত’ও দেখলাম। দেখে ভালোই লেগেছে। মনে হয়েছে, আমি তো খারাপ অভিনয় করি না। (হাসি) এসব ছবির জন্য পুরস্কারও পেয়েছিলাম। আবার এর মধ্যে দুটি ছবি দেখে মনে হয়েছে, এই জায়গায় আরেকটু সুন্দর করে করা উচিত ছিল। চাইলে পারতামও।