নতুন বছরে শুটিংয়ের খবর বলুন।
জয়া আহসান : ‘জিম্মি’র শুটিংয়ে আজ (বুধবার) পাবনা যাচ্ছি। আগে দু-তিন লটে শুটিং হয়েছে। এবার পাবনায় তিন-চার দিনের শুটিং আছে।
প্রথম আলো :
নামটা শুনে মনে হচ্ছে অন্য রকম গল্প।
জয়া আহসান : আমি সরকারি চাকরিজীবী একজন নারী। আপাতত এর বেশি বলা যাচ্ছে না। এর বেশি বলতে পারবও না। এই সিরিজের মধ্য দিয়ে আশফাক নিপুনকে পরিচালক হিসেবে প্রথম পেলাম। আমি যখন (মোস্তফা সরয়ার) ফারুকীর ‘সিক্সটি নাইন’ করতাম, তখন তো নিপুন, আদনান—সবাই সহকারী পরিচালক ছিল। বলা যায়, দেড় যুগ পর কাজটা করা হয়েছে। এর মধ্যে তারা পূর্ণ পরিচালক এবং প্রযোজকও হয়েছে কেউ কেউ।
এই দীর্ঘ সময় আপনি দেশে ও দেশের বাইরেও অনেক পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন। এদিকে যাঁরা আপনার প্রোডাকশনে সহকারী ছিলেন, তাঁরাও পরিপূর্ণ পরিচালক...
জয়া আহসান : নিপুণ তো আগে থেকেই পরিপূর্ণ পরিচালক। তবে আমিই প্রথম ওর পরিচালনায় কাজ করলাম। সে যে সুনির্মাতা, এটা অনেক আগেই পরীক্ষিত। তার কাজের স্টাইলও অন্য রকম। এটা ঠিক, একেকজন পরিচালক একেকভাবে তার প্রজেক্ট ডিজাইন করে। ওর প্রজেক্টের ডিজাইন প্রথমে বোঝা যায় না, কিন্তু যখন কাজ করতে যাবেন, দেখা যাবে, ওর মাথার মধ্যে ছোট থেকে ছোট—সবকিছু এত পরিষ্কারভাবে থাকে, যেটা সাধারণত একজন পরিচালকের অন্য সহকারী পরিচালকেরা তা খেয়াল রাখেন। আমি দেখেছি, নিপুনের থ্রি সিক্সটি ডিগ্রি সব মাথার ভেতরে আছে। তা বলতে পারেন পুরো স্ক্রিপ্টের, গল্পের, ডিজাইনের—সবকিছুই।
প্রথম আলো :
‘নকশীকাঁথার জমিন’ যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের কাছ থেকে কোন কথাটা বেশি শুনেছেন?
জয়া আহসান : হল ভিজিটে দর্শকের সঙ্গে সরাসরি কথা হয়েছে। বয়োজ্যেষ্ঠরা বলেছেন, তরুণ প্রজন্মের অবশ্যই এ ছবিটা দেখা উচিত। আমি এমনও দেখলাম, দাদা-দাদি তাঁদের নাতি-নাতনিকে নিয়ে এসেছেন। শিক্ষক এসেছেন তাঁর শিক্ষার্থীকে নিয়ে। তাঁরা সবাই নতুন প্রজন্মকে ছবিটি দেখাতে চান। কারণ, নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানানো। তাঁরা তো সেই সময়ের মানুষ, কত কষ্টের বিনিময়ে আমাদের এই বাংলাদেশ, এই ভূখণ্ড, এই পতাকা—এই প্রজন্মকে তা-ই দেখাতে ও বোঝাতে চান। আমরা আসলে কোথা থেকে কীভাবে এসেছি, আমাদের উৎপত্তিটা কোথায়, সত্যটা নতুন প্রজন্মকে দেখাতে চান।
প্রথম আলো :
গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি সিনেমায় অভিনয় করেছেন, যেগুলো সাহিত্য অবলম্বনে তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে আপনার প্রিয় কোনটি?
জয়া আহসান : আমার কাছে সব কটিই প্রিয়। যদি বলেন, ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’, কে না চায় কুসুম চরিত্রে অভিনয় করতে। ‘নকশীকাঁথার জমিন’ ছবিটিও আমার জীবনের উল্লেখযোগ্য একটি কাজ। ‘অলাতচক্র’ও ভালো লেগেছে। এসব ছবি করার কারণও তো আছে। এসবের আর্কাইভ ভ্যালু আছে। একটা মুক্তিযুদ্ধের ছবির অংশ হয়ে থাকতে পারলাম এই ছবির মাধ্যমে। একটা ’৪৭-এর কাজের অংশ হয়ে থাকতে পারলাম ‘খাঁচা’ ছবির মাধ্যমে।
সাহিত্যে আর কোন চরিত্র আছে, যেটি করতে চান?
জয়া আহসান : একটা চরিত্র তো সারা জীবন করতে চাই, কিন্তু তা আর এই জীবনে সম্ভব হবে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পোস্টমাস্টার’-এর রতন। আমি তো আর আসলে সেই আট বছর বা ছয় বছরের শিশুর চরিত্রে অভিনয় করতে পারব না। এই আফসোস নিয়ে আমাকে মরতে হবে।
প্রথম আলো :
‘পুতুলনাচের ইতিকথা’য় অভিনয়ের অভিজ্ঞতা বলুন।
জয়া আহসান : অসাধারণ অভিজ্ঞতা। অসাধারণ! লালদা (সুমন মুখার্জি) পরিচালক হিসেবে ভীষণ গোছানো। থিয়েটারের পরিচালক হিসেবেও দারুণ। আমার কাছে তো মনে হয়, ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ করার জন্য তিনি সেরা। পরিচালকের জায়গায় তিনি কতটা উঁচু দরের, তা তো সবাই জানেন। এই ছবিতে যেসব শিল্পী কাজ করেছেন, সবার সঙ্গে কাজ করে ঋদ্ধ হয়েছি। কারণ, তাঁরা সবাই অসাধারণ। অনন্যা চ্যাটার্জি আছেন, আমার প্রিয় শিল্পী। পরমব্রত, আবীরও আছে। শিল্প নির্দেশনা থেকে শুরু করে ক্যামেরার কাজ—সবই দুর্দান্ত। যে কারণে রটারড্যাম ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের মতো উৎসবে ছবিটির প্রিমিয়ার হতে যাচ্ছে, তা–ও আবার মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে।
প্রথম আলো :
‘দেবী’ দিয়ে প্রযোজক হিসেবে শুরু করেছিলেন। আপনার কাছ থেকে আর নতুন কাজ পাওয়া গেল না কেন?
জয়া আহসান : প্রযোজক হলে জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ—সবকিছু নিজেকেই করতে হয়। ছবি আরও আছে, সি-তে সিনেমার আরও প্রোডাকশন সামনে আসছে। আমরা কিন্তু এই প্রোডাকশন হাউস থেকে শুধু সিনেমা করেছি তা নয়, আমরা টক শো করেছি, ডকুমেন্টারি করেছি। ‘জয়া আর শারমিন’ ও ‘ফেরেশতে’ ছবিতেও প্রযোজক হিসেবে আছি। সামনে কোনো ছবিতেও প্রযোজক হিসেবে দেখা যেতে পারে।
আমাদের চলচ্চিত্রশিল্প সেভাবে দাঁড়াতে পারছে না। না নিয়মিত ভালো বাণিজ্যিক সিনেমা হচ্ছে, না ধারাবাহিকভাবে শৈল্পিক ঘরানার সিনেমা। আপনি তো কলকাতায় দীর্ঘদিন কাজ করছেন, হিন্দি সিনেমা করেছেন। এ অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের ইন্ডাস্ট্রির জন্য কী পরামর্শ দেবেন?
জয়া আহসান : দেখুন, আমাদের দেশটারও তো বয়স বেশি নয়। এই ৫৪ বছরের সময়টায় আমরা টালমাটাল অবস্থার মধ্য দিয়েও গেছি। পরিবেশ, পরিস্থিতি, সেগুলো তো নির্ভর করে অনেকটা দেশ, রাজনীতি—সবকিছুর ওপর। তারপরও প্রতিবছর আমাদের অনেক ভালো ভালো সিনেমা হচ্ছে, ওয়েব সিরিজ হচ্ছে, উৎসবের সিনেমা তো খুব ভালো হচ্ছে। বাণিজ্যিক সিনেমাও বছরে দু-একটা খুব ভালো দেখেছি। আসলে সবকিছুর জন্য আমাদের দরকার অনেকগুলো সিনেমা, অনেক কাজ একসঙ্গে আসা। তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন মানুষ হিসেবে আমাদের নিরাপদ ফিল করা, যাতে আমরা হলে গিয়ে সিনেমাটা দেখতে পারি। মুক্তভাবে চলাফেরা করতে পারি। তবেই না আসলে আমরা বিনোদনের দিকে বেশি ঝুঁকব।
প্রথম আলো :
সম্প্রতি দেশের কোন কাজ দেখেছেন?
জয়া আহসান : ‘প্রিয় মালতী’ দেখলাম। দেখে ভালো লেগেছে। শঙ্খ দাশগুপ্তর পরিচালনা এবং অবশ্যই মেহজাবীনের ড্রাইভটা ভালো লেগেছে। তার আগে নুহাশের ‘ষ’ দেখেছি। এটা তো অসাধারণ, অনবদ্য। অসম্ভব ভালো কাজ। আমার এ-ও মনে হয়েছে, এই সময়ের যত পরিচালক আছে, কয়েকজনের ভেতরে অন্যতম হচ্ছে নুহাশ হুমায়ূন।
প্রথম আলো :
আপনি তো নুহাশ হুমায়ূনের পরিচালনায় সিরিজে কাজ করেছেন...
জয়া আহসান : কাজটা আসলে শুরু হয়েছিল বহু আগে। এটা আসলে আমার ক্যামিও চরিত্র। এই চরিত্র করতে গিয়েও অনেক দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। অনেকবার শুটিং বাধার মুখে পড়েছে। কখনো বৃষ্টি, কখনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মাঝখানে আবার রাজনৈতিক অস্থিরতা। কিন্তু ফাইনালি আমরা শেষ করেছি। আমার কাজ অল্প ছিল; কিন্তু শুটিংয়ে যেতে হয়েছে অনেক দিন। আমার অংশের শুটিং হয়েছে রাউজান, সীতাকুণ্ডে। কাজটা করে খুব ভালো লেগেছে।
ক্যামিও চরিত্র কি প্রথমবার করলেন?
জয়া আহসান : বলতে পারেন তেমনই। করেছি কারণ, এত ভালো, এত স্ট্রং, এতটা বার্তাবহ—যে কয়টা সংলাপ আমার, মনে হয় কোনো বুদ্ধিমান অভিনয়শিল্পী এই লাইনগুলো বলার সুযোগটা মিস করবে না। কেউই না। আমরা সারাটা জীবন যে অভিনয় করি, শিল্পচর্চা করি—সবকিছুর উত্তর দেওয়া আছে আমি যে কয়টা লাইন বলেছি, তার মধ্যে। এত শক্তিশালী, এত অসাধারণ সংলাপ আমার অভিনয়জীবনে পাইনি। আমি দেখিওনি কাউকে এমন সংলাপ বলতে। এই কয়েকটা লাইন বলার জন্য অভিনয়শিল্পী সারা জীবন অপেক্ষা করতে পারে। এই চারটা লাইন অভিনেতা হিসেবে আমি বলতে পেরেছি, এটার জন্য নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। এটা গুলতেকিন খান ও নুহাশের লেখা। এত সুন্দর, মারকাটারি লাইন বলে না, তেমনই!
প্রথম আলো :
কোন বাস্তবতায় এমনটা বলছেন?
জয়া আহসান : আমার জীবনবাস্তবতা। কেন বলছি, এটি দেখার পর সবাই তা বুঝতে পারবেন। এর ভেতরে যে গল্প আছে, বার্তা আছে, যে দর্শন আছে, সেটা আসলে অসাধারণভাবে নুহাশ বলেছে। আমি অন্তত স্ক্রিপ্টে এটা পেয়েছি। আমি তো দেখিনি। কিন্তু পুরো স্ক্রিপ্ট পড়ে এটা পেয়েছি। পুরো গল্পের দর্শনটাই অন্য রকম। পুরো গল্প পড়ে ক্যামিও চরিত্রে কাজ করতে রাজি হয়েছি।
প্রথম আলো :
ব্যক্তি জয়াকে নিয়ে ভক্তদের কৌতূহলের শেষ নেই। তাঁদের অনেকের মতে, জয় আহসানের কি বিয়ে করে সংসারী হওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই? নাকি এভাবেই জীবনটা কাটিয়ে দিতে চান?
জয়া আহসান : আমি তো সংসারই করি। করছি। বিয়ে করলেই কি শুধু সংসার হয়? আমার দায়িত্ব আছে এত এত, তা সংসারের চেয়ে কম কী! আমি তো এসব করেই সময় পাই না। সবাইকে বিশ্বাস করতে হবে, বিয়ে করলেই সংসার হয় না। আমিও তো বিয়ে করে সংসার করেছিলাম। সেটার স্বাদও আমি নিয়েছি। এখন এই সংসারটা করছি। এটাই মন্দ কী। এটা তো ভালো লাগছে আমার। যেহেতু এটায় বেশি ভালো লাগছে, এই সংসারটাতে আমি সাকসেসফুল।
আমার চারটা চারপেয়ে বাচ্চা। আমার মা, পরিবারের ভাইবোন, আমার গাছাপালা—সবকিছুই আমার সংসার। এরাই আমার সংসারের সব। বিয়ে করেও তো অনেকের ভেতর যোজন যোজন দূরত্ব থাকে। সেই অর্থে সেটাও কি সংসার তাহলে? যারা বিয়ে করেও যোজন ক্রোশ দূরে থাকে মানসিকভাবে, সেটাই কি সংসার? মানুষকে দেখানোর জন্য ফটোফ্রেম সংসার করে তো লাভ নেই। সংসার সত্যিকারভাবে কেউ যদি করে, সেটা তারা করুক। তার এক্সটেনশন তৈরি করুক। পৃথিবীতে দিয়ে যাওয়ার মতো কিছু করুক। আমি আমার মতো করে এভাবেই সংসার করছি। করব।