প্রথম আলো :
প্রথম আলো: এবারের আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবসে কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন কি না?
শিবলী মহম্মদ : আমাদের নাচের স্কুল নৃত্যাঞ্চলের ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। এদিকে এখন অনেক গরম পড়ছে, এই গরমে খোলা মঞ্চের শো বন্ধ রেখেছি। প্রতিবছরের এই দিনে আমরা নানা অনুষ্ঠান করেছি। কোভিডের আগেও ২৯ এপ্রিল অনেক বড় করে অনুষ্ঠান করতাম। একদিকে গরম আর অন্যদিকে আমার ভাই সাদি মহম্মদের মৃত্যুর কারণে চুপ হয়ে আছি। আমাদের কারও মন ভালো নেই। তাই আমরা কেউই এবার বড় কোনো কাজ হাতে নিইনি। তবে আমি আর শামীম নীপা একুশে পদক পেয়েছি বলে কক্সবাজারের নাচের কয়েকটি সংগঠন আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস উপলক্ষে ৩০ এপ্রিল সংবর্ধনা দেবে। ২৯ এপ্রিল আবার বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থা, বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী ফাউন্ডেশন—দুই জায়গায় আমাদের সংবর্ধনা দেবে। আমরা সেখানে নাচ নিয়ে কথাও বলব।
নানা আয়োজনে আপনারা আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস পালন করছেন। এটা কেবল পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ, নাকি নাচ নিয়ে আপনারা আন্তর্জাতিকভাবে ভূমিকা রাখতে পেরেছেন?
শিবলী মহম্মদ : সত্যি করে যদি বলি, সে রকম কোনো ভূমিকা আমরা আন্তর্জাতিকভাবে রাখতে পারিনি। এখন আন্তর্জাতিক হওয়া মানে যদি আমরা মনে করি বিভিন্ন দেশে গিয়ে অনুষ্ঠান করলাম, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানেরা এলে তাঁদের সামনে নিজেদের সংস্কৃতি তুলে ধরলাম, এটা নয়। এতে হয়তো নিজেদের আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরলাম, এটা হয়তো একধরনের যাওয়া। তবে এটার সঙ্গে আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবসের কোনো সম্পর্ক আছে বলে আমার মনে হয় না। আন্তর্জাতিকভাবে নিজেকে মেলে ধরতে যা যা করণীয়, তা আমাদের একার পক্ষে সম্ভবও নয়, এটার জন্য পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। সবার আগে দরকার সরকারের সদিচ্ছা ও উদ্যোগ। ব্যক্তিগতভাবে তো নিজেদের আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরা সম্ভব নয়। এটা ঠিক, আমাদের অনেক রিসোর্স আছে। আমাদের লোকনৃত্য দেশের বাইরে গিয়ে যদি উপস্থাপন করতে পারি, বড় বড় গুরুকে দেশে এনে যদি আমাদের নৃত্যের জগৎটাকে আরও আলোকিত করতে পারি, তাহলেই হয়। এ ব্যাপারগুলো সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ভারতে বা বড় বড় দেশেও যদি দেখি, শিল্পপতিরা এবং ব্যক্তিগতভাবেও অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যারা প্রচুর অর্থের মালিক, তারা নিজেদের দেশের সংস্কৃতিতে পৃষ্ঠপোষকতা করে। অথচ আমাদের দেশে সেভাবে শিল্পপতি ও বিত্তবান ব্যক্তিরা নিজ দেশের সংস্কৃতিকে পৃষ্ঠপোষকতা করে না। কোনো দিনই করে না। আমরা যদি ২০টা পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠানের কাছে যাই, তারপর বলে—এ বছরে বাজেট নেই। এটা তাদের কমন ডায়ালগ। সবাই নিজের টাকাপয়সা কামাতে ব্যস্ত। প্রতিষ্ঠান বড় করাতে ব্যস্ত। অথচ এই প্রতিষ্ঠানগুলো ভারতের মাঝারি মানের শিল্পী এলেও বেশ আগ্রহ নিয়ে পৃষ্ঠপোষকতা করে। বড় বড় প্রতিষ্ঠান কোটি কোটি টাকা দিতেও কার্পণ্য বোধ করে না। অথচ আমাদের তিন-পাঁচ লাখ টাকাও দেয় না।
এটা কেন হয়?
শিবলী মহম্মদ : এটা আসলে তাদের মানসিকতার সমস্যা। অথচ আমরা গুণগত মানের দিক থেকে ভারতের শিল্পীদের চেয়ে কোনো অংশে কম নই। আমি শুধু যদি বলি, গত বছর শিল্পকলা একাডেমিতে যে কত্থক–সন্ধ্যা হয়েছিল নৃত্যাঞ্চলের, প্রত্যেক নৃত্যশিল্পী সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আমি চার বছর ভারতে কাটিয়েছি, প্রখ্যাত গুরু পণ্ডিত বিরজু মহারাজের ছাত্র। ভারতেও কখনো এ রকম একটা অনুষ্ঠান দেখিনি, যেখানে ৩০০ নৃত্যশিল্পী একসঙ্গে মঞ্চে দাঁড়িয়ে পরিবেশনায় অংশ নিচ্ছে না। এ রকম বড় অনুষ্ঠান আমরা করতে পারি। আমাদের সেই রিসোর্স আছে, সক্ষমতা আছে, শুধু আমাদের পৃষ্ঠপোষকতা নেই। এটা খুবই দুঃখজনক। আমাদের শিল্পের প্রতি তাদের যেন কোনো দায় নেই।
বাংলাদেশের নাচের সার্বিক অবস্থা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
শিবলী মহম্মদ : মানের দিক দিয়ে আমি তো বলব, বাংলাদেশে নাচের সার্বিক অবস্থা অনেক ভালো। বহু নাচের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে হয়েছে, যারা দারুণ সব কাজ করছে। সবটাই নিজেদের পাগলামি থেকে। নৃত্যশিল্পীদের পাগলামি আছে বলেই তারা কিছু করতে পারছে। মফস্সল শহরগুলোতে নাচের গুরু কী পরিমাণ অর্থাভাবে আছে, বলে বোঝানো যাবে না। কত কম পয়সা বেতনে তারা বাচ্চাদের শেখায়। শিল্পকলায় চাকরি করে। এত অল্প টাকায় পরিবার চালানো কঠিন। তারপরও তারা নাচকে ভালোবেসে তা করে যাচ্ছে। এগুলো তারা পাগলামি থেকেই করে।