সমরেশ মজুমদার আমাকে নায়িকা হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন: ফেরদৌস আরা

বাবার চাকরিসূত্রে নজরুলসংগীতের জনপ্রিয় শিল্পী ফেরদৌস আরাকে দেশের বিভিন্ন জেলায় থাকতে হয়েছে। তাঁর জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশের বিভিন্ন জেলা। ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের পৈতৃক বাড়ি নিয়েও আছে অনেক স্মৃতি। গতকাল ছিল দেশের গুণী এই নজরুলসংগীতশিল্পীর জন্মদিন। দিনটি উপলক্ষে শনিবার সকালে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। জানালেন অজানা গল্প। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনজুর কাদের

প্রথম আলো:

শুভ জন্মদিন।

ফেরদৌস আরা : ধন্যবাদ। আজ (শনিবার) আমার ভীষণ আনন্দের দিন। কারণ, দিনটিতে আমার নাতি বাসায় ফিরবে। দুদিন আগে সে জন্মগ্রহণ করেছে। আজ ওকে নিয়ে আমরা বাসায় ফিরব। এটাই আমার জন্মদিনের সবচেয়ে বড় উপহার।

ফেরদৌস আরা
প্রথম আলো
প্রথম আলো:

জন্মদিন এলে কী রকম অনুভূতি হয়?

ফেরদৌস আরা : আমরা চার বোন ও এক ভাই। ছোটবেলায় ভাইয়ের জন্য যথেষ্ট করা হতো। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, পুরো বাড়িতে আমার জন্মদিন ভোলার কারও পথ ছিল না। কোনোভাবে অবহেলার রাস্তা ছিল না। আমি নাকি যখন কথা বলতে পারতাম না, আধো আধো বলতে শিখছি, তখনই ১২ অক্টোবরকে নাকি ‘বালো অট্টবল’ বলতাম। এটা বলে বলে নাকি কান ঝালাপালা করে ফেলতাম। মা–বাবার ছেলে একটা হলেও সবচেয়ে বড় আয়োজন করত আমার জন্যই। আমি বোনদের মধ্যেও সবার ছোট ছিলাম। আমরা তখন এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় থাকতাম। আমি আমার জীবনকে তিনটা অধ্যায়ে ভাগ করেছি। ‘বালোই অট্টবল’ (১২ অক্টোবর) মানে ছোটবেলা। তারপর হচ্ছে কিশোরকাল। কিশোরীকাল আমার দুরন্তপনায় ভরা ছিল। এ সময়ে জন্মদিন কেউ করল কি করল না, এসব নিয়ে কোনো গুরুত্ব দিতাম না। কিন্তু করতই। এটা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। খাওয়ানো বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আত্মীয়স্বজন ও পাড়া–প্রতিবেশী সবাই আসত। আমাদের বাড়িটা তো লঙ্গরখানা ছিল। জীবনের সবচেয়ে ভালো লাগার সময়টা হচ্ছে বড়বেলা। গানের স্কুল সুরসপ্তক যখন প্রতিষ্ঠা করি। ২০০০ সালে এটি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছি, সেখানেও শিক্ষার্থীরা আচমকা সারপ্রাইজ দিয়ে দিত, যা আমি ভাবতেও পারতাম না। প্রতিবছর আমার স্কুলের শিক্ষার্থীরাও নানাভাবে চমকে দেওয়ার চেষ্টা করে। গতকালও এমনটা ঘটেছে। জামালপুর থেকে আমার প্রথম দিনকার শিক্ষার্থী শান্তসহ অনেকে এসেছিল। চমকে দিয়েছে। আজকেও একদল আসবে। তারা আনন্দ করবে।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

এমন কোনো স্মরণীয় ঘটনা?

ফেরদৌস আরা : সেবার আমি কানাডায় ছিলাম ছেলেমেয়েদের সঙ্গে। আমার জন্মদিনের আগের দিন অর্থাৎ রাত ১২টা বাজার আগে ওরা বায়না ধরল, আমাকে নিয়ে বাইরে যাবে। ছেলেমেয়েদের আবদার রাখতে আমাকে বাইরে বের হতে হলো। বিদেশের রাস্তায় দেখা যায় গভীর রাত পর্যন্ত স্ট্রিট শিল্পীরা গান গেয়ে বেড়াচ্ছে। আমিও দেখলাম তারা গাইছে। একটু পরে দেখি, আমার নাম নিয়ে গাইছে ওরা। আমি তো অবাক। আমার নাম ওদের গানে। তারপর খেয়াল করলাম, তারা আমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। তারপর একটা রেস্টুরেন্টে বসতেই দেখি একদল ছেলেমেয়ে হইহুল্লোড় করে ঢুকে পড়ছে। আমি তো ভয় পেয়ে গেলাম। তারপর দেখি, ওরাও এসেছে আমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে আনন্দ উদ্‌যাপন করতে। আর এগুলোর সব আয়োজন ছিল আমার ছেলেমেয়ের। একজন মা হিসেবে এটা আমার অনেক বড় পাওয়া।

ফেরদৌস আরা
সংগৃহীত
প্রথম আলো:

বাবা কী হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন?

ফেরদৌস আরা : পরপর তিনটা মেয়ে হয়েছে। বাবা ভেবেছিলেন, ৪ নম্বরটা ছেলে হবে। শার্ট–প্যান্ট কিনে রেখেছিলেন। পরে তো আমার জন্ম হলো। এরপর ছেলে। তাই ওসব শার্ট–প্যান্ট আমাকে পরানো হতো। আমার মানসিকতাও হয়ে গেল ছেলেদের মতো। দুরন্তপনা। দুষ্টুমিতে ভরা। টমবয় টাইপের। আমাকে তো বাড়ির সামনের কেউ গাছ থেকে নামাতে পারত না। সারা দিন টইটই করে বেড়াতাম। আমার আব্বাও প্রচণ্ড ভালো গাইতেন। ক্ল্যাসিক্যাল দারুণ গাইতেন। ওই সময়ের স্বনামধন্য শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী আখতার সাদমানিরাও আমার আব্বাকে ভালোবাসতেন। ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকের ওমর ফারুক স্যারকে আমাদের ড্রয়িংরুমে অনেক দেখেছি। কারণ, আব্বার কাছ থেকে বন্দিশ নেবেন। সে কারণে আমাদের শিক্ষাটা উচ্চাঙ্গসংগীতে বেশি। ছোটবেলায় আমি অনেক দুষ্টু ছিলাম বলে হয়তো আব্বা গান নিয়ে আমার কাছে আশাই করতেন না। তবে বোনদের কাছ থেকে ক্ল্যাসিক্যাল চাইতেন। ওই সময় তো বিদেশ থেকে অনেক ওস্তাদরা আসতেন। যেমন ওস্তাদ সালামত আলী, নাজাকাত আলী, মেহেদি হাসান, ফরিদা খানম—তাঁদের সঙ্গে আব্বার দারুণ সম্পর্ক ছিল। ওই সময় সারা রাত আমাদের বাসায় তাঁদের নিয়ে আসর জমত। ওখানে তাঁরা দেখতেন, সবচেয়ে ছোট আমি সারা রাত জেগে ক্ল্যাসিক্যাল গিলছি। তাঁরা একদিন অবাক বললেন, এটা কার মেয়ে! এ রকম শ্রোতা তো আর এখানে নেই। তখন আমার আব্বা বললেন, এই একটাই মেয়ে আমাকে জ্বালিয়ে–পুড়িয়ে শেষ করে দিচ্ছে। সে কোনোভাবে গান শিখে না। তখন তাঁরা উর্দুতে বললেন, হাই (এ এ কে এম আব্দুল হাই, পিডব্লিউডির প্রধান প্রকৌশলী) ভাই আপনি ভুল বলছেন, ওর মধ্যে কিন্তু ভয়ংকরভাবে সংগীত বাস করছে। এখানে অনেক বড় সংগীতের ওস্তাদও ঘুমিয়ে গেছে। কিন্তু সে তো নড়েও না, চড়ে না। তখন আমার আব্বা বললেন, হয়তোবা চেষ্টা করলে হবে। তখন ওস্তাদ সালামত আলী ও নাজাকাত আলী একটা গান শুনতে চাইলেন। আমিও শোনালাম। আমরা তখন ঢাকায় নয়, রাজশাহীতে থাকতাম। বাবার কাছ থেকে আমি সব সময় লুকিয়ে লুকিয়ে চলতাম। বাবা চেয়েছিলেন, আমি গানই করি। তবে বাসার কাউকে রাগাতে চাইলে আমি আধুনিক গাইতাম। আধুনিক গাইলে মা–বাবা দুজনই বেত নিয়ে দৌড়ানি দিতেন। বাসায় কোনো পরিবেশই ছিল না আধুনিক গাওয়ার। ক্ল্যাসিক্যালই ছিল প্রধান। আমার আব্বা বলতেন, নোট টু নোট। ১৯৭২ সালে আমি রেডিও টেলিভিশনে অডিশন দিতে গেলাম।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

অডিশনের কথা মনে আছে?

ফেরদৌস আরা : আরে সেখানে তো মজার ঘটনা ঘটে। ছোট্ট আমি। কামিজ পরা। রেডিওর পর অডিশন দিই বিটিভিতে। তখন ডিআইটিতে বিটিভি। পাস করলাম। প্রথম হলাম। কার মধ্যে কী হলাম, এটা নিয়ে খবর ছিল না। শুধু খবর নিতাম, ভালো করছি কি না। এটুকু ছিল আমাদের চাহিদা। বিটিভির অনুষ্ঠান করতে হবে। অনুষ্ঠানের সময় ফ্রকের ওপর শাড়ি পরিয়ে দিলেন আমার বোনরা। নামকরা শিল্পীদের সঙ্গে সেদিন আমাকে সরাসরি গানের একটি অনুষ্ঠানে দাঁড়াতে হলো। প্রথম দিনের প্রথম অনুষ্ঠান। তৎকালীন নামকরা শিল্পীদের মধ্যে শওকত আরা বেগম, সীমা খানসহ আরও কে কে যেন ছিলেন। সেদিন দাঁড়িয়ে সরাসরি গান গাইলাম। পরে শুনি টেলিভিশনে সরাসরি গানের সেই অনুষ্ঠান দেখে বাইক নিয়ে তাড়াহুড়া করে এলেন আজমল হুদা মিঠু। তখন সহকারী প্রযোজক ছিলেন মুসা আহমেদ তাঁকে বলেছেন, ‘আমি এক জায়গায় খেতে গিয়েছিলাম। মেয়েটাকে দেখে চলে এলাম। একটু মেয়েটার সঙ্গে কথা বলে দেখেন না, এই মেয়েটাকে আমার দরকার। মেয়েটাকে আমি ফিল্মে নায়িকা হিসেবে চাই।’ আমি তো এত কিছু বুঝি না। মাথায় ঢুকছে, নায়িকারা খারাপ হয়। কী অদ্ভুত একটা মানসিকতা তখন। যেই মাত্র আমার কানে এল নায়িকা বানাতে চেয়েছে, এই যে কান্না, তা আর থামে না। নায়িকা হওয়ার প্রস্তাবে সাত দিন কেঁদেছিলাম। শুধু ভেবেছি, কেন? আমার মধ্যে কী খারাপটা পাওয়া গেল যে নায়িকা হওয়ার প্রস্তাব দিল? বাসাতে এসব নিয়ে কথা হচ্ছিল।

নিজ বাড়িতে রেয়াজ করছেন ফেরদৌস আরা
ছবি : প্রথম আলো
প্রথম আলো:

এরপর কি আরও নায়িকা হওয়ার প্রস্তাব পেয়েছিলেন?

ফেরদৌস আরা : সে তো আরও অদ্ভুত ঘটনা। ভারত থেকেও নায়িকা হওয়ার প্রস্তাব পেয়েছি। বাংলাদেশ থেকেও পেয়েছি। সমরেশ মজুমদার আমাকে যুক্তরাষ্ট্রেও নায়িকা হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সেদিন তাঁর সঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও ছিলেন। সমরেশ ও সুনীল আমাকে এ–ও বলেছিলেন, ‘আমরা কিন্তু রবীন্দ্রনাথের লেখা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অনেক কাজ করি। আপনি ওখানে কাজ করুন।’ আমি তখন বলেছিলাম, আপনারা নজরুল নিয়ে কিছু করেন, আমি সেখানে থাকব। মোটকথা, এ রকম নায়িকা হওয়ার প্রস্তাব অনেক ছিল। সব কটি উপেক্ষা করেছি।

প্রথম আলো :

তাহলে তো একজীবনে নায়িকা হওয়ার প্রস্তাবও কম পাননি?

ফেরদৌস আরা : অনেক অনেক। নায়িকা হওয়ার প্রস্তাব ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ ছবির জন্যও পেয়েছিলাম। আমাদের বাড়িতে ওই সময়ে ছবিটির অনেকে এসেছিলেন, ছিলেন তখন বিটিভির উপস্থাপিকা লায়লা বানুও। এরপরও অনেকবার নায়িকা হওয়ার প্রস্তাব পেয়েছি। যত দূর মনে পড়ে, ২০ বারের বেশি নায়িকা হওয়ার প্রস্তাব পেয়েছি। নাটকে অভিনয়ের প্রস্তাবের কথা আর নাইবা বলি। বিটিভিতে আলাউদ্দীন ভাই নামের একজন ছিলেন, তিনি তো একদিন পথ আগলে রেখেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আজকে আর না করা যাবে না। রাজি হতেই হবে। আপনি সিনেমা করেন নাই ঠিক আছে, কিন্তু নাটকে অভিনয় করতেই হবে।’ তবে আমি নাচ করতাম।

নজরুলসংগীতশিল্পী ফেরদৌস আরা
প্রথম আলো:

সংগীতশিল্পী না হলে কী হতেন?

ফেরদৌস আরা : মনে হয় খেলোয়াড় বা নৃত্যশিল্পী হতাম। মা–বাবা চেয়েছিলেন ডাক্তার বানাতে, সেটা তো আর হয়নি। তবে আমার বিশ্বাস, আমি যে পথেই যেতাম, সফলতা পেতাম। ইডেন কলেজে পড়ার সময় খেলাধুলা, নাচ ও গানে প্রথম হতে পেরেছি। গানের দিকটা মনে হয় আমার রক্তেই মিশে ছিল। ইডেন কলেজেই আমি বেশ কয়েকবার গানে প্রথম হয়েছি। বড় আপু জান্নাত আরা যখন ছিলেন, তখন তিনি প্রথম হতেন এবং আমি রানারআপ হতাম। কিন্তু আধুনিক গানে আমি সব সময়ে প্রথম হতাম। কলেজ শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে আমি এমএ করেছি। এরপর অবশ্য নাচ ও খেলা আস্তে আস্তে বাদ হলেও গান আমার সঙ্গে সব সময়ই ছিল।