বাধ্য হয়ে ৯০ ভাগ অভিনয়শিল্পী মুখ বুজে অপমান সহ্য করে শুটিং করে যাচ্ছেন
সর্বশেষ তাঁকে ‘আমরা আমরাই’ ধারাবাহিক নাটকে দেখা গেছে। এ ছাড়া ‘স্বীকার’ নামে একটি টেলিভিশন শোতে দেখা যায় তাঁকে। সব মিলিয়ে খুবই কম কাজে দেখা যাচ্ছে অভিনয়শিল্পী মাজনুন মিজানকে। কেন হঠাৎ নিয়মিত অভিনয় থেকে কিছুটা দূরে সরলেন? আলাপচারিতায় উঠে আসে তাঁর অভিনয়জীবনের নানা প্রসঙ্গ।
আগের চেয়ে আপনি অভিনয় কিছুটা কমিয়ে দিয়েছেন? এর কারণ কী?
১৯৯৬ সালে আমার থিয়েটার শুরু। ২০০১ সাল থেকে আমি টেলিভিশনে প্রফেশনাল অভিনয় করি। ২০০৬ সালে হুমায়ূন স্যারের ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’ সিনেমা করি। শুরুটা এভাবে বলার কারণ, আমি প্রথম থেকেই অভিনয়কে পেশা হিসেবে নিতে চেয়েছি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে কোথাও সিভি দিইনি। অভিনয়টা ইমোশনাল ব্যাপার ছিল। অভিনয়টাই করে যেতে চেয়েছি। এভাবে দীর্ঘ একটা সময় কেটে গেল। পরে মনে হলো, অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেওয়াটা কঠিন, ভুল সিদ্ধান্ত ছিল।
কেন কঠিন বা ভুল সিদ্ধান্ত মনে হয়েছে?
সেই কথাই বলছি। মিডিয়ার প্রথম সারির ৫ জন ছেলে বা মেয়ে, ধরলাম ১০ জন ছেলে, ১০ জন মেয়ে ভালোভাবে সার্ভাইভ করতে পারছে। সেই সংখ্যায় আর অল্প কিছু যোগ হতে পারে। কিন্তু বেশির ভাগ অভিনয়শিল্পীর পেশা যদি শুধু অভিনয় হয়, তাহলে সার্ভাইভ করা কঠিন। এটা রিয়ালাইজ করতে করতে আমার অনেক সময় চলে গেছে।
এখন কেন এই সংকটের কথা মনে হলো?
একসময় বিয়ে করলাম, আমার দুটি সন্তান হলো, মা আমাদের সঙ্গে থাকেন। এই দীর্ঘ সময় আমি কখনোই শুটিং বন্ধ করিনি। কিন্তু করোনায় যখন শুটিং বন্ধ হলো, তখন আমি আবিষ্কার করলাম, আমার পরিবারের সুরক্ষা হিসেবে যে টাকা আছে, সেটি এক মাসের খরচও নয়। তখন মনে হলো, পাগলের মতো আমি কী করেছি। তবে এখানে আমার আত্মপক্ষ সমর্থনের জায়গা আছে। আমি হয়তো প্রথম সারির ১০ জন বা ২০ জন হতে পারতাম। তাহলে ভালো থাকতাম। সেটা পারিনি; আমার কোয়ালিটি, সেই যোগ্যতা, গোল হয়তো ছিল। সেই ব্যর্থতা আমার। এখন প্রথম সারিতে নেই বলে কি আমি অভিনয়কে পেশা হিসেবে নিতে পারব না? পারব, কিন্তু এখানে দীর্ঘদিনেও সেই জায়গা তৈরি হয়নি। ২০ বছর পরে আমার কাছে মনে হয়, শুধু অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেওয়ার সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল।
তার মানে করোনার সময়ে এই উপলব্ধি হলো?
হ্যাঁ। তখন মনে হলো, অভিনয়ের পাশাপাশি কিছু একটা করতে হবে। তখন আমি ব্যবসা শুরুর চেষ্টা করি। এখন ব্যবসা আছে বায়িং হাউসের। এমন নয় যে অভিনয় করেই খেতে হবে। এতে লাভ হয়েছে। আমি পছন্দমতো চরিত্রের গল্পে কাজ করছি। অভিনয় করেই চলতে হবে, সেই জায়গা থেকে মুক্তি পেয়েছি। কারও ডাকের প্রতি এখন আর অপেক্ষা করতে হয় না। এখন আমি পরিবারকে সময় দিতে পারি। তাদের সঙ্গে বাইরে খেতে যেতে পারি।
কখনো কি মনে হয়েছে, অনেক বেশি কাজে নাম লিখিয়েছেন, যার কোনো দরকার ছিল না?
পেশার জায়গা থেকে করেছি। তখন অভিনয় ছাড়া আয়ের কোনো মাধ্যম ছিল না। আমাকে সার্ভাইভ করার জন্য কাজগুলো ছাড় দিয়ে করতে হয়েছে। ডিরেক্টরের কাজের ধরন, গল্প, চরিত্র পছন্দ না হলেও করতে হয়েছে। তখন মন খারাপ করে কাজ করেছি। সারা দিন আশায় থেকেছি, কাজটা থেকে আমার টাকা আসবে। সেটি দরকার।
চরিত্রাভিনেতার জায়গাটায় নিয়ে কী বলবেন?
এখানে যাঁরা চরিত্রাভিনেতা আছেন, তাঁরা অবহেলিত, আর্থিকভাবে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। সমাজে যে আমাদের ইমেজ আছে, অনেক জায়গায় যাওয়া-আসা করেছি। কোথাও গিয়ে শুনতে হয়েছে, ‘ওর নাটক ফালতু’, ‘সিনেমা করে সস্তা’, তখন অপমান লাগে। এভাবে কোনো একটি পেশা কন্টিনিউ করা যায় না। কারণ, দীর্ঘ সময়েও আমাদের নাট্যাঙ্গন পরিচ্ছন্নভাবে ডেভেলপড হয়নি যে এটাকে সুন্দর অর্থে পেশা হিসেবে নেওয়া যায়। উল্টো অপমান, লজ্জা, অপবাদ মাথায় নিতে হয়েছে।
এর জন্য কি কখনো কাউকে দায়ী মনে হয়?
এর জন্য আমাদের সেক্টরের কেউ কেউ দায়ী। কেউ কেউ এমন এমন কাজ এবং জীবন যাপন করেছেন, সেগুলোর জন্য সাধারণ মানুষ যাঁরা মিডিয়া বোঝেন না, তাঁরা মনে করেন, এই সেক্টরের লোক মানেই খারাপ মানুষ। উদাহরণ দিয়ে বলি, আমি যখন ব্যাংকে লোনের জন্য যাই, তখন সব ঠিকঠাক কিন্তু বোর্ড মিটিংয়ে দেখা গেল, আমি মিডিয়ায় অভিনয় করি, আমাকে লোন দেবে না। কারণ হিসেবে দেখাল, সিনিয়র অভিনেতা-অভিনেত্রী ব্যাংকের সঙ্গে এমন কিছু কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছেন, যে কারণে তারা এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু সেই দায় আমাকে নিতে হচ্ছে।
চরিত্রাভিনেতাদের নিয়ে শুটিংয়ে কোনো বৈষম্য দেখেছেন?
শুটিংয়ে প্রধান চরিত্রের অভিনয়শিল্পীদের যেভাবে দেখা হয়, সেই তুলনায় চরিত্রাভিনেতাদের অবহেলা করা হয়। এটা আসলে অপমানের। এগুলো অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। আমার সঙ্গে হয়নি, কিন্তু দেখেছি। একজন চরিত্রাভিনেতাকে শুটিংয়ে চা-নাশতা চেয়ে খেতে হয়, আবার আরেকজনের পেছনে খাবার ঘোরে। আমাকে হয়তো চা দিচ্ছেন, কিন্তু এই সিস্টেম তরুণদের জন্য কী বার্তা দেয়। যে নতুন আসছে, সে কী শিখবে? কী সিস্টেম আমরা ডেভেলপ করছি। আবার পারিশ্রমিক চরিত্র অভিনয়শিল্পীদের প্রপার ওয়েতে দেওয়া হয় না। এখানেও চরিত্রাভিনেতাদের সঙ্গে ছলচাতুরির সুযোগ নেয়। এগুলো অন্যায়। আমি এখান থেকে মুক্তি পেয়েছি। কিন্তু আমার মতো অনেকেই আছেন, তাঁরা আমার মতোই অভিনয়ের পাশাপাশি আয়ের সোর্স চাচ্ছেন, কিন্তু পারছেন না। আমি শিওর। এর সংখ্যা ৯০ ভাগ। বাধ্য হয়ে ৯০ ভাগ অভিনয়শিল্পী মুখ বুজে অপমান সহ্য করে শুটিং করে যাচ্ছেন। অথচ তাঁরা জীবনের সবকিছু ত্যাগ করে অভিনয় করতে এসেছেন। অভিনয়ের জন্য তাঁদের অগাধ ভালোবাসা। তাঁদের রক্তে অভিনয়, তাঁদের স্পন্দনে অভিনয়। এগুলো কষ্টদায়ক।