প্রতি সপ্তাহে টেলিভিশনে মুখ দেখানোর মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই: তপন চৌধুরী
পরিবার নিয়ে এখন কানাডায় থাকেন জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী তপন চৌধুরী। সম্প্রতি ১০ দিনের জন্য বাংলাদেশে এসেছিলেন তিনি। শনিবার রাতে আবার ফিরে গেছেন কানাডায়। যাওয়ার আগে শনিবার দুপুরে ‘কিছুটা সময়’ শিরোনামের গানের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন তিনি। রিপন চৌধুরীর কথা ও সুরে গানটিতে তাঁর সহশিল্পী জান্নাতে রোম্মান। এ গানসহ অন্যান্য প্রসঙ্গে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছে বিনোদন
প্রশ্ন :
‘কিছুটা সময়’ গানটি শুনে মনে হচ্ছিল, নব্বইয়ের দশকের একটা ছোঁয়া আছে...
ঠিকই ধরেছেন। ওই মেজাজে গানটা তৈরি হয়েছে। খুবই চমৎকার কথা ও সুরের গানটি গেয়ে আমারও ভালো লেগেছে।
প্রশ্ন :
নতুন গান প্রকাশে এত সময় নিলেন কেন?
আমার তো এখন বাংলাদেশেই থাকা হয় না। এবার তিন বছর পর এলাম। চার বছর আগে একটা গান প্রকাশিত হয়েছিল। একই সময়ে রূপতনু শর্মার সুরেও চট্টগ্রামের এক তরুণের কথায় আরেকটি গান গেয়েছিলাম, সেটা অবশ্য প্রকাশিত হয়নি। তা ছাড়া এখন তো একটা করে গান হয়। গান প্রকাশের ধারাটা কেমন জানি হয়ে গেছে। এই গানের পরিকল্পনা বেশ কিছুদিন আগে থেকে হচ্ছিল। আমি কানাডা থেকে কণ্ঠ দিয়েছি। দেশে এসে ভিডিওর শুটিং করেছি। তিথিও (জান্নাতে রোম্মান) খুবই চমৎকার গেয়েছে। গানটি শোনা যাবে জান্নাতে রোম্মান তিথি নামের ইউটিউব চ্যানেলে।
প্রশ্ন :
গান প্রকাশের ধারা নিয়ে কথা বলছিলেন, তারপরও নতুন গান প্রকাশ করলেন?
সত্যি বলতে, গানটা ভালো লেগেছে। কথা ও সুর ভালো। গান ভালো লাগলে মনের আনন্দে গাই। আমরা তো ভালো গানের জন্য ক্ষুধার্ত। গাওয়ার পেছনে এটাই সবচেয়ে বড় কারণ। একটা ভালো গান পেলে কার সঙ্গে করব, আমার সঙ্গে কে করবে, সেটা কখনোই মুখ্য নয়। বয়স ও অভিজ্ঞতা—এসব আমার কাছে বিচার্য নয়। আমি মানের বিচার মেধা ও প্রতিভা দিয়ে করি।
প্রশ্ন :
নতুন গান না গাওয়ার পেছনে কোনো অভিমান আছে?
অভিমান করে লাভটা কী। কার জন্যই-বা অভিমান করব।
প্রশ্ন :
গানে ফেরা হলো নতুন একজন শিল্পীর সঙ্গে।
নতুন-পুরোনো বুঝি না। ভালো শিল্পী হলেই তাঁর সঙ্গে গাইতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। এই যেমন নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে কোনালকে আমি খুব আদর করি, কারণ, সে ভীষণ সফিসটিকেটেড। ওর সঙ্গে স্টেজে গেয়েছি, গেয়েছি টেলিভিশন লাইভেও। যারা ভালো গায়, তাদের আমি সব সময় শ্রদ্ধা করি। তাদের সঙ্গে গাইতে আমার কোনো অসুবিধা হয় না। আমার পরের প্রজন্মে আঁখি আলমগীর, ঝুমু খান, দিনাত জাহান মুন্নী, দিঠি আনোয়ার, অনুপমা মুক্তি আর হৈমন্তীর সঙ্গেও গেয়েছি। আমি নিজেও লম্ফঝম্প টাইপ গান গাই না, তাই যারা একটু ভালো গান গায়, সুন্দর গায়, তাদের একটু হিংসা হয়। তাদের সঙ্গে গান গাইতে পারলে ভালোও লাগে। অনেক সময় অনেকের সঙ্গে চাইলেও হয় না, কিন্তু গাইতে চাই তো। আমার কাছে ছোট শিল্পী বড় শিল্পী ম্যাটার করে না। ভালো গাইলেই হলো।
প্রশ্ন :
কানাডায় আপনার স্থায়ীভাবে চলে যাওয়াতে শ্রোতারা নতুন গান থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। আপনার কি মনে হয় না, নতুন আরও গান শ্রোতারা উপহার পেতেন?
অনেক তো দিয়েছি। দিয়ে লাভটা কী হয়েছে। টানা ৪০ বছর গান গেয়েছি, বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে গাওয়ার সুযোগ পাইনি। কানাডা থেকে ডেকে এনে গাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে। আমাদের মূল্যায়নের সময় হয় না। অথচ অনেক শিল্পী আছে ওই আয়োজনে প্রতিদিনই গান গেয়েছে, দু–চারটা গানও গেয়েছে। তপন চৌধুরী একজীবনে বহু কিছু দিয়েছে। অবশ্যই অনেক কিছু দেওয়ার আছে। আমি তো জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত গাইতে চাই। আমরাই নতুন গান অনেক বেশি করেছি। এখন নতুন সেভাবে তৈরি হচ্ছে কই। রিমিক্স গানই বেশি করা হচ্ছে। নতুনদের দিয়ে তেমনটা করার চেষ্টা হচ্ছেই না। আমরা মানুষের পালস বুঝি, কোন গান শুনবে। কুমার বিশ্বজিৎ তো এক দিনে তৈরি হয়নি। এখনকার অনেকে আছে ২০০–৩০০ গান গেয়ে ফেলেছে, কিন্তু দেখা যাচ্ছে সব গানই একই রকম। সব গান একটা–দুটো চাকার মধ্যে ঘুরছে। আমাদের বড় পাওনা যে শ্রোতারা কী বোঝেন, তা বুঝতে পারি। অ্যানিওয়ে, এটা হয়তো ওপরওয়ালার আশীর্বাদ, মা–বাবার আশীর্বাদ। ছোট–বড় সবার ভালোবাসা পেয়েছি।
প্রশ্ন :
তাহলে আপনি কি কানাডায় থেকে যাবেন?
কেন থাকব! চলে আসব তো। আলটিমেটলি এ দেশেই থাকব। এই দেশই আমাকে তপন চৌধুরী বানিয়েছে। আমার যত পরিচিতি—সব বাংলা গানের কারণেই। এ দেশের মানুষের ভালোবাসা আমার সবচেয়ে বড় প্রেরণা। যে গানটা রিলিজ হলো, এই গানটাও তো দেশের বাইরে থেকে কণ্ঠ দিলাম। তবে এটাও ঠিক, কেন জানি নতুন গান ও স্টেজ শো করাসহ অনেক কিছুতে ভালো লাগে না।
প্রশ্ন :
বাইরের দেশে তো নিয়মিত স্টেজ শো করছেন। তা ভালো না লাগার কারণটা কী?
৪০ বছর গান গেয়ে কী পেয়েছি? এখানকার জাতীয় অনুষ্ঠানের শিল্পীদের নির্ধারণ করে বিজ্ঞাপনী সংস্থা বা এজেন্সি। জাতীয় পর্যায়ের শিল্পীদের নির্ধারণ করার ওরা কারা। এটা অনেক বড় অন্যায়। রাষ্ট্রীয়ভাবে শিল্পকলার মতো প্রতিষ্ঠান আছে, এসব তো তাদেরই করা উচিত। যারা সত্যিকারের শিল্পীদের, গানবাজনার পৃষ্ঠপোষকতা করছে, তারা এসব করবে। বিজ্ঞাপনী সংস্থা, এজেন্সি, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করার করুক। দেশের যেকোনো প্রয়োজনে বা সংকটে এদের তো দেখা যায় না। গানের মধ্যেও মধ্যস্বত্বভোগী ঢুকে গেছে। এসব সব সময় ছিল, কম আর বেশি। নব্বইয়ের দশকের পর এখন বেশি হচ্ছে। আমার ক্ষোভটা হচ্ছে এই যে দেশের ৫০ বছর হলো, এখন না হয় বেঁচে আছি। ৭৫ বছর হলে তখন বাঁচব কি না, তার কোনো ঠিক নেই। আমরা কি তাহলে গানবাজনার জন্য কিছুই করিনি! আমরা কি কোনো একটা কোরাস গানেও সুযোগ পেতে পারতাম না! আমাকে ডেকে এনেও গাওয়ানো হয়নি! অথচ এমন শিল্পীদের দেখেছি, প্রতিদিন গান গেয়েছে, তিন–চারবারও গেয়েছে।
প্রশ্ন :
দেশের সংগীতের এখন কী অবস্থা?
সংগীত একটা চক্রে ঘুরছে। রিমিক্স–সাম্রাজ্য বন্ধ না হলে এটা আরও বিপদ। তরুণদের বেশি বেশি নতুন গান প্রকাশ করতে হবে। টেলিভিশন, রেডিওতে এসব বারবার প্রচার করতে হবে। দেখা যাবে একবার, দুবার, তিনবার, পাঁচবার শোনার পর এসব গান শ্রোতার মনে জায়গা করবে। আমাদের গানগুলোও সেভাবে এত দূর এসেছে। প্রথম দিনে কি আমাদের গান হিট হয়েছে? হয়নি। আস্তে আস্তে তা করতে হবে। নতুন শিল্পীরা টেলিভিশনে অন্যের গান গেয়ে থাকলে কোনো দিন এই দৃশ্য বদলাবে না। অন্যের গান গাইলেও নিজেদের গান বেশি করে গাইতে হবে। বারবার গাইতে হবে। তরুণদের সেই গাটসও থাকতে হবে। আমি তো মনে করি, ১৫–২০ জন তরুণ শিল্পী যদি সিদ্ধান্ত নেয়, আমরা নিজেদের গান ছাড়া গাইব না, তখন এমনিতে চ্যানেল বাধ্য হবে। শিল্পীদের নিজেদের প্রতি আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে। ‘না’ বলার মতো শক্তি–সাহস লাগবে। প্রতি সপ্তাহে টেলিভিশনে মুখ দেখানোর মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই। শিল্পীরা নিজেকে যতটা এক্সক্লুসিভ রাখতে পারে, ততটাই ভালো। একবার যদি দর্শক–শ্রোতারা মুখ ফিরিয়ে নেন, তাহলে কিন্তু সারা জীবনের জন্য সব শেষ।