মানুষের জন্য কাজ করাতেই আনন্দ
সাড়ে তিন দশক ধরে ‘ইত্যাদি’ উপস্থাপনা করে দেশে ও দেশের বাইরে দর্শকের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন হানিফ সংকেত। গতকাল ৬৪ বছর পূর্ণ করেছেন একুশে পদক পাওয়া এই উপস্থাপক ও নির্মাতা।
জন্মদিনের শুভেচ্ছা। দিনটি কেমন কাটল?
প্রতিদিনের মতোই কেটেছে। আমার কাছে সব দিনই সমান, বরং দিনটি এলে আমার একটু খারাপই লাগে। মনে হয়, জীবন থেকে একটি বছর চলে গেল। অনেক কিছু করার বাকি আছে।
অনেকেই ঘটা করে জন্মদিন উদ্যাপন করেন...
হ্যাঁ, করেন। শুধু করেন না, জন্মদিনে বিশাল অনুষ্ঠান করেন, বিশাল আয়োজনও থাকে। কেউ কেউ তো পত্রিকায় প্রেস রিলিজ পাঠায়, পত্রিকাগুলো সমাদর করে ছাপে। সেখানে এত কর্মকাণ্ড দেখা যায় যে দেখে পাঠক ভাবেন, এই লোক এত কর্মকাণ্ড করলেন কবে? বরং এই দিনে নস্টালজিয়ায় ভুগি, পুরোনো অনেক স্মৃতি মনে পড়ে।
দিনটি সেভাবে উদ্যাপন করেন না?
করি, পারিবারিকভাবে। আমার ছেলেমেয়ে, স্ত্রী ও বউমা জন্মদিনের রাতে শুভেচ্ছা জানিয়েছে, অনেক উপহার দিয়েছে। এটা আমার কাছে অনেক বড় পাওয়া। আর ভক্তরা তো আছেনই—দোয়া করেছেন, ফেসবুকে অনেক মন্তব্য, আবেগ–অনুভূতি জানিয়েছেন। আমিও পড়ে একটু আবেগপ্রবণ হয়েছি।
আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
কোনো পরিকল্পনা নেই। মনে হলো, কাজ করতে হবে। যে কাজগুলো করছি, সেগুলোই করে যেতে হবে। আমি গ্রামগঞ্জে গিয়ে কাজ করি। এখনো অনেক জায়গায় যাওয়ার বাকি আছে, সেসব জায়গায় যেতে হবে। বয়স হয়ে গেলে কাজ করার সাধ থাকলেও সাধ্য থাকবে না।
এই জীবনের সেরা প্রাপ্তি কী?
এগুলো নিয়ে খুব একটা ভাবি না। আমি যে কাজগুলো করি, সেগুলো মানুষ সময় নিয়ে বসে দেখেন। তাঁদের সময়ের মূল্য দেওয়ার চেষ্টা করি। সেই আশির দশক থেকে এখনকার ইউটিউবের যুগে এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা ‘ইত্যাদি’ দেখে—এটা বড় প্রাপ্তি।
যাঁদের বয়স ৯০ বছর, তাঁরাও আমাকে দেখেন, এই প্রজন্মের শিশুরাও আমার অনুষ্ঠান দেখে। আজ সকালে হাঁটতে গিয়ে বয়স্ক এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তিনি লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটছেন। মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করে আমার দীর্ঘ জীবন কামনা করেছেন। এটা আমার পরম পাওয়া। প্রাপ্তির কথা চিন্তা করে কাজ করি না।
মানুষের জন্য কাজ করাতেই আনন্দ। আমাদের কাজের বিনিময়ে, সাহায্য–সহযোগিতার মাধ্যমে কারও মুখে যদি একটুখানি হাসি ফুটিয়ে তুলতে পারি—সেটাতেই আনন্দ খুঁজে পাই। আমার অনুষ্ঠানের কারণে অনেক শিল্পীর আত্মপ্রকাশ হয়েছে, অনেকে প্রশংসিত হয়েছেন, রাষ্ট্রীয় সম্মান পেয়েছেন। এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষের উত্থান দেখলে আমার ভালো লাগে।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম ‘ইত্যাদি’ দেখছে। অনুষ্ঠানটি মানুষ কেন এত পছন্দ করে?
এটার শক্তি হচ্ছে, অনুষ্ঠানের প্রতি আমার ভালোবাসা। আমার দায়বদ্ধতা, একাগ্রতা ও আন্তরিকতা; সঙ্গে একটুখানি মেধা হয়তো আছে। ব্যস্ততম জীবনে সময় বের করে দর্শক ‘ইত্যাদি’ দেখেন। ‘ইত্যাদি’ দেখার জন্য আশির দশকেও বসে থাকতেন, এখনো বসে থাকেন। এটাই আমার পরম পাওয়া। এটার জন্য আমাকে শ্রম দিতে হয়। আমার নিজস্ব একটি বিশাল প্রোডাকশনও আছে, ইচ্ছা করলে প্রতি সপ্তাহে একটা করে অনুষ্ঠান করতে পারি। আমি কোয়ান্টিটিতে না, কোয়ালিটিতে বিশ্বাস করি। আমাদের অনুষ্ঠান থেকে অনেকে তথ্য সংগ্রহ করেন। কারণ, এটির একটি আর্কাইভাল ভ্যালু রয়েছে। একটা প্রোগ্রাম শেষ হলে আরেকটা প্রোগ্রামের চিন্তা করতে হয়। কোথায় প্রোগ্রাম করব, কীভাবে করব, সেখানকার বিষয়বস্তু কী—এসব নিয়ে গবেষণা করতে হয়।
জন্মদিনের পর নতুন বছরে কী করতে চান?
বললামই তো, আমার জীবনটা শিডিউলের মধ্যে চলে গেছে, ৩৫ বছর ধরে একই শিডিউলে চলছি। ঝড়ঝঞ্ঝা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ—কখনোই শিডিউল মিস হয়নি, নির্দিষ্ট সময়ে ‘ইত্যাদি’ প্রচারিত হয়েছে। বরং আমি পিছিয়ে গেছি, অনুষ্ঠান পিছিয়ে যায়নি। অনুষ্ঠানের জন্য বহু কাজ মিস করেছি। আমি বিদেশে যাইনি, অনেক অনুষ্ঠান মিস করেছি—অনেকে আমার ওপর নাখোশ হয়েছেন। আমার লক্ষ্য হচ্ছেন দর্শক, তাঁরা খুশি থাকলেই আমি খুশি।
আপনার অর্ধশতাধিক বই প্রকাশিত হয়েছে, এবার কী বই লিখবেন?
প্রোগ্রামের জন্য টুকটাক লেখালেখি সব সময় করছি। পাশাপাশি বইয়ের জন্যও লেখালেখির চেষ্টা করি। এখানেও একটু ব্যতিক্রম আছে। আমি কখনোই মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান করিনি। এ ক্ষেত্রে আমাকে কিছুটা প্রচারবিমুখ বলতে পারেন।
আপনি নিজেকে লুকিয়ে রাখেন কেন? অনেকে প্রচারের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন...
আমি আমার মতো, অন্যেরা অন্যের মতো। আমি নিজেকে লুকিয়ে রাখি না, আমি কম কথা বলতে ভালোবাসি। যেটুকু সময় পাই, কাজ করতে চেষ্টা করি। নৈশকালীন টক শোর মতো সারাক্ষণ কথা বললে তো হবে না। আসলে এখন আর্ট কালচার হয়ে গেছে অনেকটা গালিভিত্তিক, গত প্রোগ্রামে আমি বলেছিলাম, শিল্পমাধ্যমের বড় অলংকার হচ্ছে গালি। এখন অনেক বড় বড় লোকও তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন। তবে এসব ছাড়াও আমাদের অনুষ্ঠান মানুষ দেখেন। শুধু দেখেনই না, পরিবার নিয়ে সব বয়সের সব শ্রেণি–পেশার মানুষ দেখেন। এর চেয়ে আনন্দের আর কী আছে, বলুন।