জীবনকে আগে যেভাবে দেখতাম, এখনো সেভাবেই দেখি: আফজাল হোসেন

আফজাল হোসেনছবি : প্রথম আলো
অভিনয়শিল্পী, পরিচালক ও চিত্রশিল্পী আফজাল হোসেন-এর আজ জন্মদিন। ৬৮ বছরে পদার্পণ করেছেন তিনি। সাতক্ষীরার পারুলিয়ায় জন্ম নেওয়া এই মানুষটি এখন দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের উজ্জ্বলতম একটি নাম। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে তাঁর সঙ্গে কথা হলো।

প্রশ্ন :

জন্মদিনের শুভেচ্ছা।

ধন্যবাদ।

আফজাল হোসেন
ছবি : প্রথম আলো

প্রশ্ন :

গত বছর জন্মদিনের ঠিক এক দিন আগে আপনার মা মারা যান। বেঁচে থাকতে আপনার জন্মদিনে তিনি কী করতেন?

মায়ের কাছে তার ছেলের জন্মদিন কোনো দিনই বিশেষ কিছু ছিল না। তাই আলাদা করে উদ্‌যাপিত হতো না। খারাপ লাগা হচ্ছে, গত বছরের এই দিনটির দুই দিন আগেও মা পৃথিবীতে ছিল। যদিও অসুস্থ ছিল, কিন্তু সঙ্গে তো ছিল। মায়েরা আসলে মা-ই হয়। এদিনটার জন্য আলাদা কিছু মায়ের কাছে দেখিনি। বরং অদ্ভুত একটা ব্যাপার এদিনে দেখতাম, আমরা সেটা নিয়ে হাসাহাসিও করতাম। যেমন হয়তো স্বাভাবিকভাবে জন্মদিনের দিন বাসায় আলাদা রান্না হয়। কিন্তু বয়সের কারণে হোক, কোলেস্টেরলের কারণে হোক কিংবা রক্তচাপের কারণে হোক, অনেক কিছু খাওয়ার ব্যাপারে নিয়ম করা ছিল। দেখা যেত, টেবিলে আম্মা পাশে বসে থাকলে, তার মধ্যে এক রকম ছটফটানি থাকত। হয়তো আমি পছন্দ করি চিংড়ি মাছ, কিন্তু খাচ্ছি না। বাসায় যেটা হয় আরকি, দেখা গেল, বউ হয়তো উঠে গেছে, সঙ্গে সঙ্গে আম্মা আমার পাতে চিংড়ি মাছ দিয়ে দিল। বলল, খা খা, আজকে খা। আজকে খেলে কোনো সমস্যা নেই। তার ধারণা, এটা হয়তো বউ নিয়ন্ত্রণ করে। সে যে মা, তার ধারণা, ছেলের এটা খেলে কোনো অসুবিধা নেই (হাসি)। এ রকম দিন এলে সবাই এসব গল্প গুজব করি। মায়েরা আসলে মা-ই থাকে।

প্রশ্ন :

জন্মদিন উদ্‌যাপনে আপনিও খুব একটা উৎসাহী নন। তারপরও এই দিনে এখন অনেকে ফেসবুকে নানান কথাবার্তা লিখে থাকেন। কেমন লাগে?

এটা তো সৌভাগ্যের ব্যাপার যে মানুষ আলাদা করে দিনটা মনে রাখে। সুচিন্তিত যেকোনো বিষয় আমার ভালো লাগে। শুভ জন্মদিন লেখাটা একটা বিষয়, তারপরও মানুষ আলাদা করে কিছু লিখেছে, তা ভালো লাগে। বেশি আনন্দের হচ্ছে, বাচ্চারা বাসায় এটা নিয়ে বেশ মেতে থাকে। দিনটায় উৎসব করে ওদের মতো করে। ওদের জন্যই আসলে জন্মদিনটা হয়। আমাদের অফিসটা যেহেতু আট-দশটা অফিসের মতো নয়, সেখানে আন্তরিকতা আছে, আলাদা করে আয়োজন হয়।

প্রশ্ন :

একেকজনের কাছে জীবন একেক রকম, আপনার কাছে আসলে জীবনটা কী?

জীবনকে আগে যেভাবে দেখতাম, এখনো সেভাবেই দেখি। আমার মতে জীবনটা সুন্দরভাবে উপভোগের। আমার নানা সুযোগ রয়েছে, আমি সেটা ছবি এঁকে উপভোগ করতে পারি। ক্রিয়েটিভ নানান কাজের মধ্যে থেকে উপভোগ করতে পারি। অভিনয় করে উপভোগ করতে পারি, লিখে উপভোগ করতে পারি এবং কিছু না করে শুয়ে-বসেও উপভোগ করতে পারি। আমি কোনো না কোনোভাবে আসলে জীবনটা উপভোগ করতে চাই। আমার এ রকম কোনো প্রয়োজন নেই-এটা হতে চাই, ওটা হতে হবে। আমার জীবনে কোনো হওয়া-হয়ি নেই। দিন, বছর কাটুক একটা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে, যেন সমৃদ্ধ হই। চিরকালই আমি সেটা করে আসছি। অ্যাট দ্য এন্ড, লাইফে হ্যাপি হওয়া এবং হ্যাপি ফিল করাটা সবচেয়ে ইমপর্ট্যান্ট।

আফজাল হোসেন
ছবি : প্রথম আলো

প্রশ্ন :

কিন্তু সুখী হওয়ার ধরনটা তো একেকজনের কাছে একেক রকম...

ওই যে বললাম, জীবনে এটা পেলাম না, এটা পাওয়ার দরকার ছিল। তাহলে ইহজীবনে কারও পক্ষে সুখী হওয়া সম্ভব নয়। তোমার আজকে দু-চার–পাঁচ কলম লিখে মনে হতে পারে, যা অদ্ভুত কাজ করে ফেলেছি। ছবি এঁকে আমারও একই মনে হতে পারে। মাথার মধ্যে যদি থাকে কিছু একটা করতে হবে, সেই ভাবনাটা একটা অসুখ। একেকজন মানুষের মধ্যে তা একেক রকমভাবে থাকে। রিসেন্টলি আমি একটা কবরস্থানে গিয়েছি। গিয়ে দেখলাম, যে মানুষটা এখনো মরেনি, সে–ও তো জায়গা কিনে মার্বেল পাথর দিয়ে বাঁধিয়ে সুখ অনুভব করে। করে না? ভাবে, মরে যাওয়ার পর থাকার জায়গাটা ঠিক করে গেলাম। প্রত্যেকটা মানুষের নানান ধরনের সুখ অনুভূতি আছে। কদিন আগে কলকাতায় গিয়েছিলাম। সেখানে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়—দুজনের এক্সিবিশন দেখার সুযোগ হয়েছিল। আমি তো জীবনেও চিন্তা করিনি, এই দুজনের এক্সিবিশন দেখার সুযোগ হবে। এটা বিশাল প্রাপ্তি না? কতজনই তো কত দরকারে যাচ্ছে, কিন্তু এটা তো হচ্ছে না। এই যে পেলাম, এই যে উপলব্ধি, এটাই তো হ্যাপিনেস।

প্রশ্ন :

২০১৯ সালে ছায়ানটে আপনার দুটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘বড় হওয়ার স্বপ্ন নেই আমার। কেননা খুব বড় হতে গেলে প্রাকৃতিক অনেক কিছু বিসর্জন দিতে হয়। আমি সেটা চাই না। আমি নিজের মতো বাঁচতে চাই।’ এই জন্মদিনে জানতে চাওয়া, নিজের মতো কতটা বাঁচতে পেরেছেন?

বড় হওয়ার স্বপ্নটা সত্যিই এখনো আমার নেই। আমার লাইফে এত দিন পর্যন্ত যেভাবে থেকে আনন্দ বোধ করি, আজও একই রকমভাবে আনন্দ বোধ করি। দৃষ্টিভঙ্গির তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। সবকিছুর মধ্যে ওই যে হওয়া-হয়ি, সেটা নেই। কিছু হতে চাইলে চিন্তাভাবনার অনেক কিছুই বিসর্জন দিতে হয়। তখন মাথায় একটা অঙ্ক থাকে, এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে। কড়াকড়ির বিষয়টা আমার জীবনে নেই। যেটা স্বাভাবিক নিয়মে হওয়ার, সেটা হবে, না হলে নেই। প্রাপ্তির জন্য কোনো বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করতে আমি নারাজ। কিন্তু কাজের জন্য বুদ্ধিমত্তা তো অবশ্যই দরকার, প্রাপ্তির জন্য নয়। আমি নিজেকে কোথাও স্থাপন করার জন্য কোনো বুদ্ধিবৃত্তির সাহায্য নিই না। কোনো কিছু গুছিয়ে করার প্রভৃতি আমার মধ্যে নেই। খেয়াল করলে দেখবে, কিছু ভালো লাগলেই আমি করি।

আফজাল হোসেন ও তাঁর স্ত্রী তাজিন হালিম
ছবি : ফেসবুক

প্রশ্ন :

ছোটবেলায় অনেকেরই মনে ছোট ছোট নানা স্বপ্ন উঁকি দেয়, যা বড় হয়ে পূরণ করতে চায়। আপনার মন কি তেমন কিছু হতে চেয়েছিল, যা বাস্তবে হয়নি?

হতে চাওয়া নয়, বিষয়টা হচ্ছে ছবি আঁকব, এটা ছিল। বাকি বিষয়গুলো হতে চাওয়ার কারণে হয়নি। আগ্রহ ছিল। আমাকে যদি বাচ্চু (নাসির উদ্দীন ইউসুফ) ভাই মঞ্চনাটকে অভিনয় করার কথা না বলতেন, নিজের তাগিদে কখনো করতাম না। আমাকে যদি শ্রদ্ধেয় আবদুল্লাহ আল–মামুন টিভি নাটকে অভিনয় করতে না নিতেন, আমি টেলিভিশন নাটকেও অভিনয় করতাম না। আমাকে যদি কাজী জহির তাঁর সিনেমার জন্য প্রস্তাব না দিতেন, আমি তা–ও করতাম না। বিষয়টা হচ্ছে এ রকম, এ বিষয়গুলোর প্রতি আমার আকর্ষণ ছিল কিন্তু এসব হতেই হবে, এমনটা কখনো মাথায় ছিল না। মনে হয়েছে যে এটা করলে রেসপেক্টেড হবে, তাই কাজটা সিরিয়াসলি কীভাবে করা যায়, সেটাই ভাবতাম।

প্রশ্ন :

এবার কাজের প্রসঙ্গ। আপনার পরিচালিত ‘মানিকের লাল কাঁকড়া’ এখন কী অবস্থায় আছে?

আমাদের দায়িত্ব ছিল কাজ শেষ করে সেন্সরে জমা দেওয়া, তা দিয়েছি। এটা শিশু একাডেমির ছবি, অপেক্ষা করছি সেন্সর পেলে মুক্তির খবরটা সবাইকে জানাব। পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র যে রকম ধাঁচের হয়, এটা একটু ভিন্নমাত্রার।

প্রশ্ন :

সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

তোমাকেও ধন্যবাদ। প্রথম আলোর জন্য শুভকামনা রইল।