আমাদের গোপনে বিয়ে করার খবরটি আব্বা জানার পর খুব কেঁদেছে: সুচন্দা

মাত্র ৩৭ বছরের জীবনে বাংলাদেশের সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছিলেন জহির রায়হান। গতকাল ৩০ জানুয়ারি ছিল তাঁর প্রয়াণদিবস। এ উপলক্ষে গতকাল দুপুরে জহির রায়হানের স্ত্রী অভিনয়শিল্পী কোহিনূর আক্তার সুচন্দার সঙ্গে কথা বলেছে ‘বিনোদন’। এদিন স্মৃতির ঝাঁপি খুলে দিয়ে অভিনেত্রী জানিয়েছেন জহির রায়হানের সঙ্গে তাঁর প্রেম ও বিয়ে নিয়ে বিস্তারিত।সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনজুর কাদের

প্রথম আলো :

জহির রায়হানের সঙ্গে আপনার পরিচয় কীভাবে হয়েছিল?

১৯৬৬ সালের কথা। আমি ‘কাগজের নৌকা’ ছবির নায়িকা। শুটিং শেষ হলেও ছবিটি তখনো মুক্তি পায়নি। মুক্তির কিছুদিন আগে জহির রায়হান আমাদের গেন্ডারিয়ার বাড়িতে এসে হাজির। তখন আমরা সরাসরি সিনেমার বিষয়ে কথা বলতাম না। মা–বাবারা বলতেন। আমি ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখি, সোফায় তিনজন লোক বসা। একজনের হাতের আঙুলে চাবির রিং। পরিচয় হলো, জানলাম, তিনিই জহির রায়হান। শুরুর জীবনে যখন শুটিং করতাম, তখনই জানতে পেরেছি, জহির রায়হান নামকরা পরিচালক। ‘বেহুলা’ ছবিতে নায়িকা বানাতে তিনি আমাদের বাসায় এসেছিলেন।

প্রথম আলো :

আপনার সঙ্গে জহির রায়হানের প্রথম কী কথা হয়?

আমি এ রকম ছবি বানাব। নায়িকা হিসেবে আপনাকে নিতে চাই।

প্রথম আলো :

কীভাবে তিনি আপনার খোঁজ পেলেন?

আমি অবশ্য এটা জিজ্ঞেস করিনি। তবে শুনেছিলাম, সে সময় ‘চিত্রালী’ ম্যাগাজিনে ‘কাগজের নৌকা’ ছবির শুটিংয়ের ছবি দেখে আমাকে তাঁর পছন্দ হয়। ‘বেহুলা’ নামের সেই ছবিতে আমি ও রাজ্জাক সাহেব অভিনয় করেছিলাম।

সুচন্দা
ছবি : প্রথম আলো

প্রথম আলো :

আপনারা সম্পর্কের মায়াজালে জড়ালেন কীভাবে?

শুটিংয়ের সময় জহির রায়হান সাহেবের ক্যামেরায় লুক থ্রুতে বুঝতে পারতাম তিনি আমার প্রতি দুর্বল। ‘বেহুলা’ ছবির সময়ই তা টের পাই। তাঁর চোখের ভাষা বুঝতে পারতাম। ‘আনোয়ারা’ ছবির শুটিংয়ে জহির রায়হান সাহেব তাঁকে বিয়ের কথা বলেন। আমরা তখন এফডিসিতে ‘আনোয়ারা’ ছবির স্ক্রিপ্ট নিয়ে কথা বলছিলাম। আমি বিয়ে করব না বলতে তিনি অভিমানে বললেন, ছবি বানানোই ছেড়ে দেবেন। আমার কাছ থেকে এমন কথা শুনে জহির রায়হান সাহেব স্ক্রিপ্ট ছিঁড়ে ছুড়ে ফেললেন। ফ্যানের বাতাসে চিত্রনাট্য উড়ছে। তখন আমি বললাম, ‘তোমাকে পরীক্ষা করার জন্য এমনটা বলেছি।’ আমাদের প্রেম কিন্তু অন্য রকম ছিল।

প্রথম আলো :

কেমন তা বলবেন?

(হাসি)। আমাদের প্রেম মধুর ছিল। জহিরের মরিস অক্সফোর্ড ব্র্যান্ডের একটা গাড়ি ছিল। গাড়িটা হারিয়ে গেছে। ওই গাড়িতে আমাদের অনেক স্মৃতি। গাড়িতে করে কখনো আরিচা যাচ্ছি, কখনো কুমিল্লায় ‘দুই ভাই’ ছবির শুটিংয়ে যাচ্ছি। জহির গাড়ি চালাত, পাশের সিটে আমি বসে থাকতাম। জহিরের খুব জোরে গাড়ি চালানোর অভ্যাস ছিল। দেখা যেত, গাড়ি চলতে চলতে হঠাৎ ডান দিকে ঘুরবে, এমনভাবে জহির গাড়ি ঘোরাত, আমি হুড়মুড় করে ওর বুকে গিয়ে পড়তাম। ওই যে হুড়মুড় করে পড়তাম, যে স্পর্শ ছিল, ওটা ছিল অসাধারণ প্রেমের অনুভূতি।

জহির রায়হান ও সুচন্দা
ছবি : সংগৃহীত

প্রথম আলো :

মনে মনে কবে ভেবে নিলেন, জহির রায়হানের মতো একজন মানুষ জীবনসঙ্গী হলে ভালো হয়?

তত দিনে কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করা হয়েছে। মুক্তিও পেয়েছে একাধিক ছবি। ভাবলাম, জহির যেহেতু আমাকে বোঝে, আমারও ওকে ভালো লাগে, তাহলে বিয়ে করতে সমস্যা তো দেখি না। ১৯৬৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর বিয়ে করি। ১৯৬৬ সালে তো সুভাষ দত্তের ‘কাগজের নৌকা’ ছবি দিয়েই অভিনয়ের শুরু। প্রথমে তো বুঝিনি, পরে দেখলাম জহিরের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে আমার জন্মদিনে।

প্রথম আলো :

বিয়ে কি পারিবারিকভাবে হয়েছে?

আমরা বিয়েটা তো গোপনে করেছি। জহিরের বন্ধুর বাড়িতে বিয়ে পড়ানো হয়। এটা নিয়ে অনেক বড় কাহিনি আছে।

সুচন্দা
ছবি : সংগৃহীত

প্রথম আলো :

কী সেই কাহিনি?

আমি নিজেও জানতাম না যে সেদিন আমার বিয়ে হবে। যে কাপড় পরা ছিল, ওই কাপড়েই বিয়ে হয়েছে। জহির তাঁর মরিস অক্সফোর্ড গাড়ি চালিয়ে আমাদের গেন্ডারিয়ার বাড়িতে এলো। আমাকে বলল যে শুটিং আছে। কিন্তু আমি জানতাম যে কোনো শুটিং নেই। বাসায় এসে আম্মা–আব্বার সামনেই বলছে, আজ শুটিং। আমি তো আর মা–বাবার সামনে কিছু বলতে পারছি না। আমি তো বুঝতে পারছি, পাগলের অন্য কোনো মতলব আছে। সে হয়তো ঘুরতে বের হবে। এরপর আমাকে গাড়িতে তুলেই ধানমন্ডির দিকে ছুটল। গাড়িতে যেতে যেতে জহির বলল, ‘আজ আমাদের বিয়ে হবে।’ আমি বললাম, কী? আজ আমাদের বিয়ে মানে কী? সে বলল, বিয়ে মানে বিয়ে! তখন আমি চুপ হয়ে গেছি। হতভম্ব হয়ে গেছি। ভাবছি, আমার পরিবার, মা–বাবা কীভাবে নেবে এই বিষয়? এভাবে কোনো মেয়ের বিয়ে হয়?

প্রথম আলো :

ধানমন্ডির সেই বাসায় বিয়ের অনুষ্ঠানে কে কে ছিলেন?

পরিচিতদের মধ্যে বেবি জামান ছিল। আর কয়েকজন বন্ধুবান্ধব, তাদেরঁ আমি অবশ্য সেভাবে চিনতাম না।

প্রথম আলো :

বিয়ের দিন রাতে কি বাড়িতে ফিরেছিলেন?

তা তো ফিরতেই হবে। আমার বাবা খুব কড়া ছিলেন। বিয়ে পড়ানো শেষে সবাই খাওয়াদাওয়া, আড্ডাবাজি করে রাতেই ফিরলাম। জহির আমাকে অনেক রাতে পৌঁছে দেয় গেন্ডারিয়ার বাড়িতে।

প্রথম আলো :

তাহলে বিয়ের কথা বাড়িতে জানালেন কী করে?

আমি তো ভয়ে অস্থির। কিছুদিন পর জহির বলে যে, ‘আমি এখন সংসার করব।’ এরপর আরও কত কথা! তারপর একদিন কায়দা করে বিয়ের বিষয়টা মাকে জানালাম। মা আবার খুবই বন্ধুর মতো ছিল। সব ব্যাপারে মায়ের সঙ্গে আলাপ করতাম। প্রেমিক হয়ে যারা চিঠিপত্র লিখত, সেগুলোও মাকে পড়ে শোনাতাম। স্কুল ও কলেজজীবনে এমন কত ঘটনা যে আছে! বিয়ের খবরটা মাকে জানিয়ে বললাম, তাহলে আব্বাকে একটু বুঝিয়ে বলতে হবে। মা বলে, ‘ওরে বাবা, তোমার আব্বারে কেমনে বলব।’ বললাম, যখন আমি থাকব না বাসায়, তখন কায়দা করে বলবে আরকি। তারপর মা একসময় আব্বার কাছে বলল। গোপনে বিয়ে করার খবরটি আব্বা জানার পর খুব কেঁদেছে। খুব কষ্ট পেয়েছে। আমি যে বাড়িতে না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলেছি, এটা বাবা ভাবতেই পারেনি!

প্রথম আলো :

জহির রায়হানকে আপনার মা–বাবা পছন্দ করতেন?


পছন্দ করত। তবে জহির তো সব সময় বাসায় যেত না। মাঝেমধ্যে কাজ থাকলে তবেই যেত। কিন্তু একটা ব্যাপারে হয়তো পছন্দ করবে না, কারণ, না বলে বিয়ে করা। আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে, জহির তো আগে বিবাহিত ছিল। তা ছাড়া জহিরের যে যোগ্যতা, তাতে পরিবারের কারোরই দ্বিমত ছিল না। তবে আমাকে যখন বিয়ে করছে, তখন আগের স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্স ছিল। ডিভোর্স না হলে আমি বিয়ে করব নাকি।

প্রথম আলো :

জহির রায়হান পরিচালিত কয়টি ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ হয়েছে?

সঠিক হিসাব মনে নেই। তবে ১৫-১৬টি ছবি তো হবেই। এসবের মধ্যে ‘বেহুলা’, ‘আনোয়ারা’, ‘সুয়োরানী দুয়োরানী’, ‘দুই ভাই’, ‘কুচবরণ কন্যা’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘জুলেখা’, ‘যোগ বিয়োগ’, ‘অপবাদ’ উল্লেখযোগ্য।

প্রথম আলো :

জহির রায়হানের সংসারে আপনার সন্তানেরা কী করছেন?

দুই সন্তানই বিবাহিত। নাতি-নাতনি নিয়ে আমি ভালো আছি। বড় ছেলে আরাফাত রায়হান অপু ব্যাংকে চাকরি করে আর ছোট ছেলে তপু রায়হান ব্যবসা করে।

প্রথম আলো :

জহির রায়হানের ‘বরফ গলা নদী’ নিয়ে ছবি নির্মাণের কথা বলেছিলেন...

অনেক আগেই ছবিটির পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু নানা কারণে করা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ছবিটি বানাতে চাই। শরীর ঠিকঠাক থাকলে অবশ্যই ছবিটি নির্মাণ করব। আমার তো এমনও মনে হয়, ছবিটি বানাতে পারলে, আমার জীবনে কোনো আফসোস থাকত না।