নিজের জন্মদিনের কথাই তো ভুলে যাই
১৯৭০ সালের ১০ এপ্রিল মুক্তি পায় জহির রায়হান পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’। গতকাল ছবিটি মুক্তির ৫২ বছর পূর্ণ করে। এই চলচ্চিত্রের অনেকেই এখন আর বেঁচে নেই। অন্যতম অভিনয়শিল্পী কোহিনুর আক্তার সুচন্দার সঙ্গে কথা হয় গতকাল রোববার বিকেলে। এই চলচ্চিত্রের সূত্র ধরে পেছনে ফিরে যান তিনি।
প্রশ্ন :
কেমন আছেন?
এখন তো আর বলতে পারব না, ১০ বছর আগে যেমন ছিলাম, তেমন আছি। তারপরও সবার দোয়ায় ভালোই আছি। সুস্থ আছি।
প্রশ্ন :
বাসায়?
বাসায় ঠিক না, আরেক বাসায় (হাসি)। আমার বাসায় নয়, অন্য একজনের বাসায়।
প্রশ্ন :
‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্র মুক্তির ৫২ বছর পূর্ণ হলো। মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা?
ভুলেই গিয়েছিলাম। কত বছর, সেটাও মনে নেই। আজ মনে পড়ে গেল। ছবিটি তো আর ভুলতে পারব না, মৃত্যুর আগপর্যন্তও ভোলা সম্ভব নয়। এই ছবি যে একবার দেখেছে, তার মনে থাকবেই। তবে এই দিনটার কথা হয়তো মনে থাকে না। কারণ, অনেক সময় নিজের জন্মদিনের কথাই তো ভুলে যাই। এই চলচ্চিত্রের আবেদন এখনো ম্লান হয়নি, যত দিন বেঁচে থাকবে, দর্শক এই ছবির কথা ভুলবে না। এই ধরনের ছবি অবশ্য সব সময় হয় না। কালেভাদ্রে একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে এমন কিছুর জন্ম হয়।
প্রশ্ন :
শুটিংয়ের সময়ের কিছু মনে পড়ে?
সবই মনে আছে। একদম পরিষ্কার। একটুও ভুলিনি। ২১ ফেব্রুয়ারি, ভোরবেলায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শুটিংয়ের স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বলে। সেদিন শুটিংয়ে আশপাশের এলাকার অনেকেই ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ফুল নিয়ে এসেছিলেন। এত লোকের মধ্যে সাবলীলভাবে শুটিং করতে পারব কি না, এ নিয়ে সন্দিহান ছিলাম। কিন্তু সবচেয়ে আনন্দের বিষয়, যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরা এতটাই আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেছেন যে বলে বোঝানো সম্ভব নয়। আমরা একসঙ্গে যাঁরা শহীদ মিনারে কাজ করেছিলাম, তাঁদের কথাও মনে পড়ে। এর মধ্যে অনেকেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন।
প্রশ্ন :
কার কার কথা মনে পড়ছে?
রাজ্জাক, আনোয়ার হোসেন, রোজী ভাবি, রওশন জামিল আপা, শওকত আকবর ভাই, আমজাদ হোসেন ভাই—তাঁদের কথা কী করে ভুলব?
প্রশ্ন :
ছবির চিত্রগ্রাহক আফজাল এইচ চৌধুরী?
আফজাল এইচ চৌধুরী ভাইয়ের সঙ্গে কয়েক দিন আগেও দেখা হলো। একসঙ্গে পিকনিকের মতো একটা অনুষ্ঠান করলাম। ঢাকার কাছে আমার মেয়ের একটা বাগানবাড়ি আছে। সেখানে তিনি তাঁর মিসেসসহ এসেছিলেন। শবনমও এসেছিলেন। আরও অনেকে এসেছিলেন। আমি মাটির চুলায় রান্না করেছি। নানা পদের রান্না ছিল। আর আমার রান্না খেয়ে সবাই মহাখুশি।
প্রশ্ন :
আপনি কোন পদ ভালো রান্না করেন?
যত রকম বাঙালি খাবার আছে, আমি সবই দারুণ রান্না করতে পারি। মাছ–মাংসের নানা রেসিপি আছে। চিংড়ি মাছ এক রকমভাবে, ইলিশ মাছ আরেক রকম। অন্যান্য মাছও চার–পাঁচ রকমভাবে রান্না শিখেছি। আমার রান্না করা খাবার দেশ–বিদেশে—সুদূর আমেরিকা, লন্ডনের যাঁরাই খেয়েছেন, কখনোই ভুলতে পারেন না। এখনো অনেকে ফোন করে বলেন, ‘আপা, আপনার ইলিশ মাছ রান্নাটা দারুণ।’ অনেকে রেসিপিও নেন।
প্রশ্ন :
তার মানে আপনি রান্নাটা বেশ উপভোগ করেন?
আমি রান্না করে খাওয়াতে আনন্দ পাই। খুব মানে খুব। এমনকি আমার খাবার আমি নিজেই রান্না করে খাই। কাজের লোকের হাতে রান্না করা খাবার খাওয়া হয় না। অভিনয় করার সময় তো আর পারতাম না। যখন অভিনয়ে ব্যস্ততা কমল, তখন থেকে নিজের রান্না নিজেই করি। ব্যস্ততার মধ্যেও বিশেষ কিছু পদ রান্না করতাম, যাঁরা খেতেন, বলতেন, বেশ মজা। শুঁটকিভর্তা, গরু ও মুরগির মাংসের নানা পদ।
প্রশ্ন :
আপনার নিজের পছন্দের খাবার কী?
ইলিশ, চিংড়ি, কই, বড় রুই মাছ ছাড়া অন্য কোনো মাছ খুব একটা খাই না। এর বাইরে টকজাতীয় খাবার বেশি ভালো লাগে। টক ডাল। সবচেয়ে বেশি পছন্দের কথা শুনলে হয়তো কেউ হাসবে, পান্তাভাত আমার ভীষণ পছন্দের। শজনে যে কী পছন্দ, সেটা বলে বোঝাতে পারব না। শজনের সিজন এলে আমার গ্রামের বাড়ি যশোর থেকে পরিচিতজনেরা গাড়ি ভরে শজনে নিয়ে আসেন। আমি প্রতিদিনই কোনো না কোনোভাবে এটি খাই।
প্রশ্ন :
আপনার সময় কাটে কীভাবে?
ভীষণ ব্যস্ততায় কাটে। আমি একা মানুষ, কিন্তু চারপাশে অনেকে আছেন। ছেলে–মেয়ে–নাতি–নাতনি সবার সঙ্গে কথা বলে সময় পাই না। ঘরের কাজ, সংসার, রান্না, ইবাদত তো আছেই। সারা জীবন একে হাসিয়েছি, ওকে কাঁদিয়েছে, কত কী যে করেছি। কষ্টের দিনও পার করেছি। কিন্তু হাল ছাড়িনি। আমি নেগেটিভ কোনো কথা চিন্তাও করি না, সব সময় পজিটিভ চিন্তা করি। আমাকে এটা করতেই হবে। আমি কোনো কিছু ভাবলে সেটা করেই ছাড়ি। জীবনে যা চেয়েছি, সবই পেয়েছি। আমি সূর্যোদয়ের আগে ঘুম থেকে উঠি। আবার রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাই। সকালে পাখির ডাকে আমার ঘুম ভেঙে যায়। এখন অবশ্য ঘুরতে খুব মন চায়।
প্রশ্ন :
দেশের বাইরে যাবেন নাকি?
আপাতত দেশের বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা নেই। দেশের মধ্যে অনেক সুন্দর জায়গায় যাওয়া হয় না। শুটিংয়ের সময় কত সুন্দর সুন্দর জায়গায় যাওয়া হতো। এখন মাঝেমধ্যে মনে হয়, একটু পাহাড় ও সমুদ্রের কাছে যাই। এসব আমাকে খুব টানে। নিরিবিলি এসব জায়গায় যেতে মন খুব আনচান করে।
প্রশ্ন :
আবার চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে ইচ্ছা করে?
সিনেমা নির্মাণের ইচ্ছা কোনো দিনই লোপ পায়নি। পাবেও না। শক্তি থাকলে, মৃত্যুর আগপর্যন্ত সিনেমা বানাতে চাই। আমার শিরায় শিয়ার চলচ্চিত্র। আমার মনের মধ্যে আরেকটা ইচ্ছা আছে, জহির রায়হানের বরফ গলা নদী নিয়ে চলচ্চিত্র বানাতে চাই, খুব ইচ্ছা। এই উপন্যাসের স্ক্রিপ্টও তৈরি করা আছে। কোনো প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান বা ভালো বাজেট পেলে সিনেমাটি বানাতে চাই।