গল্পে শোনা মহামারি দরজায় কড়া নাড়ছে। ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ ঘরবন্দী। সব দুয়ার বন্ধ, এ রকম সময়ে দুঃসাহস করে দুয়ার খুলেছিলেন মঞ্চনাটকের মানুষেরা। সংস্কৃতি অঙ্গন থেকে তাঁরাই বলেছিলেন, ঘরবন্দী হয়ে থাকা আর নয়। আবার শুরু হয় নাটক মঞ্চায়ন।
মহামারির কারণে গত ১৮ মার্চ থেকে দেশের সবখানে নাট্য প্রদর্শনী বন্ধ করে দেওয়া হয়। টানা ৬ মাস পর গত ২৮ আগস্ট সন্ধ্যায় খুলে দেওয়া হয় বাংলাদেশ মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তন। বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের আঁতুড়ঘর দুর্দিনে ঠাঁই দেয় নাটকের মানুষ ও দর্শকদের। সেখানে মঞ্চস্থ হয় শূন্যন রেপার্টরি থিয়েটারের নাটক ‘লালজমিন’। এখানে একক অভিনয় করেন মোমেনা চৌধুরী। অনেক রেকর্ডের সঙ্গে নাটকটির ললাটে যোগ হয় আরেক রেকর্ড, মহামারির মধ্যে রাজধানীতে মঞ্চস্থ হওয়া প্রথম মঞ্চনাটক—‘লালজমিন’।
মহামারিতে নাটকপাড়াতেও সৃষ্টি হয়েছিল হাহাকার। এমনিতেই এই অঙ্গনে আয়ের সুযোগ সীমিত। তার ওপর প্রদর্শনী না থাকায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় অনেক দল। ছড়িয়ে–ছিটিয়ে পড়েন মঞ্চকর্মীরা। কারও–বা এ অঙ্গন ছাড়ার উপক্রম হয়। কিন্তু অনলাইনে হঠাৎ তৎপর হয়ে ওঠেন সবাই। শুরু হয় পাণ্ডুলিপি বিনিময়, শুরু হয় মহড়া। একপর্যায়ে প্রদর্শনীও শুরু হয়। প্রাচ্যনাট নিজেদের আঙিনায় দর্শকদের জন্য ছোট পরিসরে মাত্র ২০টি আসন পেতে আয়োজন করে নাট্যমেলা ‘মহলা মগন’। বন্ধ থাকার সাত মাস পর খুলে গিয়েছিল বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। জাতীয় নাট্যশালার প্রধান মিলনায়তন, পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তন, স্টুডিও থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয় বেশ কিছু নাটক। উল্লেখ করা যায় পালাকারের ‘উজানে মৃত্যু’, জাগরণী থিয়েটারের ‘রাজার চিঠি’, থিয়েটার ফ্যাক্টরির ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে’ নাটকগুলোর কথা।
আশার কথা হলো, দুঃসহ এই সময়ে বেশ কিছু নতুন নাটক পেয়েছে নাট্যাঙ্গন। সেসবের মধ্যে রয়েছে অনুস্বর-এর ‘মূল্য অমূল্য’। আর্থার মিলারের ‘দ্য প্রাইস’ অবলম্বনে এর ভাবানুবাদ করেন অসিত মুখোপাধ্যায়, রূপান্তর ও নির্দেশনা দেন মোহাম্মদ বারী। করোনাভাইরাস সংক্রমণে সতর্কতামূলক এক নাটক নিয়ে আসেন মহাকাল নাট্য সম্প্রদায়ের শিল্পী মো. শাহনেওয়াজ। তাঁর গল্প-ভাবনা ও কথক থিয়েটারের সহযোগিতায় ‘জয়ী হব একদিন’ নাটকটি ধারণ করা হয় ইউটিউবে দেখানোর জন্য। সঞ্জীব কুমার দে নির্দেশিত নাটক ‘পাকে বিপাকে’ মঞ্চে আনে পদাতিক নাট্য সংসদ। আনন জামানের রচনা ও শহীদুজ্জামান সেলিমের নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয় ঢাকা থিয়েটারের নাটক ‘একটি লৌকিক অথবা অলৌকিক ইস্টিমার’। অনন্ত হিরার রচনা ও নির্দেশনায় প্রাঙ্গণেমোর ও শব্দ নাট্যচর্চা কেন্দ্র যৌথভাবে মঞ্চে আনে ‘মেজর’ নাটকটি। মাহবুব আলমের রচনা ও নির্দেশনায় অনুরাগ থিয়েটার মঞ্চে আনে ‘অবজেকশন ওভার রুলড’। শাহমান মৈশান ও শরীফ সিরাজের অনুবাদ, সৈয়দ জামিল আহমেদের নির্দেশনায় ব্রিটিশ নাট্যকার সারাহ কেইনের নাটক ‘৪.৪৮ মন্ত্রাস’ মঞ্চে নিয়ে আসে স্পর্ধা।
নতুন নাটকের এ সংখ্যা হয়তো অপ্রতুল। কিন্তু চলতি বছরটিও অন্য বছরগুলো থেকে আলাদা। এই সময়ে মনোবল ধরে রেখে, ঝুঁকি নিয়ে নতুন নাটক মঞ্চে তোলার জন্য টুপি খুলে অভিবাদন জানাতে হয় নাট্যকর্মীদের। আসছে বছর, ২০২১ সালটি বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনের জন্য হতে যাচ্ছে অন্য রকম এক বছর। কেননা দীর্ঘদিন ঘরবন্দী নাটকের মানুষেরা। তাঁরা প্রস্তুত হয়েছেন নতুন কাজের জন্য।