২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

বাবা-মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কি আসলেই মুক্তি মেলে?

আজ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার হলে সন্ধ্যা ৭টায় থিয়েটারের ‘মুক্তি’ নাটকের শততম মঞ্চায়ন হবে। ১৭ বছর ধরে একই অভিনয়শিল্পীরা নাটকটিতে অভিনয় করে গেছেন। নাটকটির এই দীর্ঘযাত্রা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বললেন নির্দেশক ত্রপা মজুমদার।

প্রশ্ন :

অভিনন্দন। ‘মুক্তি’র আজ শততম মঞ্চায়ন। এই ১৭ বছরের যাত্রার অভিজ্ঞতা কেমন?

১৭ বছর অনেক দীর্ঘ সময়। এটা একটি খুব বড় ব্যাপার যে ১৭ বছর ধরে একই চরিত্রে সব কটি প্রদর্শনীতে একই অভিনয়শিল্পীরা অভিনয় করছেন। আর নির্দেশক হিসেবে আমি অতিক্ষুদ্র, নগণ্য এক নির্দেশক। সেই নির্দেশকের একটি নাটকের শততম মঞ্চায়ন হচ্ছে, এটা আমার জন্য একটি বড় প্রাপ্তি। এ প্রাপ্তিটা সম্ভব একমাত্র দর্শকের কারণে। তাঁরা পছন্দ করছেন বলেই শততম মঞ্চায়ন হচ্ছে, এত বছর ধরে চলছে। দর্শকের কৃতিত্বটাই অনেক বড়।

ত্রপা মজুমদার l
প্রথম আলো

প্রশ্ন :

১৭ বছর আগে আপনি আরও তরুণ...

একদমই তরুণ। এককভাবে ‘মুক্তি’ আমার প্রথম নির্দেশনা। এ ক্ষেত্রে আমাকে স্মরণ করতেই হবে আবদুল্লাহ আল মামুনের কথা। তিনি না থাকলে আমি বা আমরা যারা এখন থিয়েটারে নির্দেশনা দিচ্ছি, কখনোই নির্দেশনায় আসতাম না। তিনি আমাদের বাধ্য করেছেন যে তোমাদের করতেই হবে। আমি মরে গেলে কী হবে। আমার নির্দেশনা দেওয়ার সাহস কখনো ছিল না। সেই জায়গা থেকে তিনি আমাকে বাধ্য করেছিলেন। এটা একটা বড় জায়গা। দ্বিতীয় বড় জায়গা হচ্ছে (মিজারুল) কায়েস ভাই । বিভিন্ন নাটক পড়তে পড়তে যখন এটা ভালো লাগল, আমি তাঁকে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে কয়েক দিনের মধ্যেই কাজটা হয়ে গেল। এটাও এক ধরনের পাওয়া। এই প্রদর্শনীটি কায়েস ভাইয়ের স্মৃতির প্রতি উৎসর্গ করছি। আরেকটি ছেলে, জগলুল আলম, যে নাটকের আবহ তৈরি করেছিল, সে–ও অকালে চলে গেছে। জগলুলের কথাও বিশেষভাবে মনে হয় এই উপলক্ষকে কেন্দ্র করে।

মা ফেরদৌসী মজুমদারের সঙ্গে মেয়ে ত্রপা মজুমদার
সংগৃহীত

প্রশ্ন :

ফেরদৌসী মজুমদার একাধারে আপনার মা আবার এই নাটকের অভিনেত্রী। তাঁর সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

একটা কথা খুব পরিষ্কার যে যখন ফ্লোরে যাই, তখন মা, ভাই, বোন, স্বামী, বন্ধু, ছেলে, মেয়ে মাথায় কিচ্ছু থাকে না। তখন কিন্তু যে নির্দেশক, সে নির্দেশক; যে অভিনেতা, সে অভিনেতা। এখানে আর কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকে না। ওখানে শুধু নাটকেরই সম্পর্ক। মায়ের যেটা বড় গুণ, সেটি হচ্ছে, মা কিন্তু ভীষণ ডিরেক্টরস অ্যাক্টর। নির্দেশক যেটা বলবেন, কোনোভাবেই সেটা অমান্য করেন না। ওই নির্দেশক কত ছোট এগুলো ম্যাটার করে না। আমার প্রতিও মায়ের এটাই শিক্ষা ছিল। মা আমাকে বলেছিলেন, যখন কোনো নির্দেশকের সঙ্গে কাজ করবে, তিনি যেটা বলবেন, অবশ্যই সেটি করার চেষ্টা করবে। কখনো যদি মনে হয়, এই নির্দেশক কিছু জানেন না, তাঁর সঙ্গে কাজ করতেই যাবে না। কিন্তু যদি কাজ করো, তাঁর কথা তোমাকে মেনে চলতে হবে। মা এটা মানেন। এটা আমার জন্য বিশাল একটি সুবিধা হয়েছে। আর মায়ের সঙ্গে আরও তিনজন মেয়ে কাজ করে। তানভীন সুইটি, তানজুম আরা পল্লী ও তামান্না ইসলাম। এরা চারজন যখন কাজটা শুরু করেছিল, অনেকেই মহড়ায় এসে বলেছিল, চারটা মেয়ে শুধু বক বক করবে। চারটা মেয়ের এই অভিনয় কেউ দেখবেন? এ ধরনের কিছু মন্তব্য শুনেছি। কিন্তু ফুল এফোর্টের মধ্য দিয়ে আমরা সেটা ওভারকাম করতে পেরেছি। আজ পর্যন্ত এ অভিজ্ঞতা হয়নি, দেশে–বিদেশে মঞ্চায়ন করেছি, এমন কোনো অভিজ্ঞতা হয়নি যে দেখার পরে কেউ বলেছেন, ‘ধুর ভাল্লাগলো না।’ একজন দর্শকও বলেননি। তখন আমার মনে হয়েছে, আমরা যদি কোনো পরিশ্রম করে থাকি, তাহলে এটাই আমার প্রাপ্তি।

মুক্তি নাটকের দৃশ্য
সংগৃহীত

প্রশ্ন :

আপনি বলছেন চারজন। আমি দেখি পাঁচজন নারী। কারণ, নির্দেশকও নারী। এটার কোনো তাৎপর্য কি আপনার কাছে আছে?

না। জেন্ডারের কোনো সিগনিফিকেন্স নেই। অ্যাবসলিউটলি নেই। আমি একেবারেই কোনো নারী–পুরষ দেখে করিনি। এটা তো আমার প্রথম নির্দেশনা ছিল। আমি শুধু খুঁজছিলাম ছোট পরিসরের নাটক। কারণ, খুব বড় ক্যানভাসের নাটক প্রথমে করার সাহস আমার ছিল না। যে কারণে খুঁজতে খুঁজতে এ নাটকের কাহিনি পড়ে আমার মনে হলো, এখানে এমন এক মানবীয় সম্পর্কের কথা বলা হচ্ছে, যে মানবীয় সম্পর্কের সংকটটা আমাদের সমাজেও আমরা অনুভব করতে শুরু করেছি। একাকিত্বের সংকট, পরিবার ভেঙে যাওয়ার সংকট, বাবা–মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সংকট। এটিই আমাকে আকর্ষণ করেছে। চরিত্র কম, এ বিষয়ও আমাকে আকর্ষণ করেছে। এখানে নারী–পুরুষ বিষয় একেবারেই আমার বিবেচনায় ছিল না। কিন্তু আমি এটুকু বলতে পারি, আমি যখন চারজন নারীকে নিয়ে কাজ করেছি, আমার কাজটা অনেক আরামদায়ক ছিল। এটা যদিও জেন্ডার ইনসেনসেটিভ একটি কমেন্ট হবে। কিন্তু আরামদায়ক কেন আমি বলছি? ইন জেনারেল, ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সিনসিয়ারিটি লেভেলটা অনেক ভালো। মেয়েরা অনেক বেশি মনোযোগী। অনেক বেশি এফোর্ট দেয়। মানে সিনসিয়ার। মেয়েরা সাধারণত ফাঁকি দেয় না। অনেক মনোযোগ দেয়, অনেক শ্রম দেয়। এটা আমার জন্য বাড়তি পাওনা বলে মনে হয়েছে।

প্রশ্ন :

১৭ বছর আগে যে মানবীয় সংকট মাথায় রেখে এই নাটকটিকে বেছে নিয়েছিলেন, এই সময়ে এসে কি মনে হয়, সেই সংকট দিন দিন আরও বাড়ছে?

বাড়ছে তো বটেই। কারণ, আপনাকে আমি বলি, আমাদের প্রত্যেক অনুষ্ঠানের পরেই অভিজ্ঞতা হয়, কেউ না কেউ দর্শক সারিতে শো শেষ হয়ে গেলেও বসে থাকেন। নিজেদের জীবনের সঙ্গে নাটককে রিলেট করেন। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, একদিকে যেমন অনেক বয়স্ক লোক বসে থাকেন, অনেক তরুণকেও দেখেছি চুপ করে বসে থাকতে। কারণ, তাঁদের মধ্যে এক ধরনের তোলপাড় বোধহয় হয়। এই অনুভূতিটা শুধু ছড়িয়ে দিতে চাই। আমরা নাটকে প্রশ্নটা ওটাই রেখেছি, ‘বাবা–মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কি আসলেই মুক্তি মেলে?’

মুক্তি নাটকের দৃশ্য
সংগৃহীত

প্রশ্ন :

কালকের অনুষ্ঠানে কী কী আয়োজন থাকছে?

কোনো আনুষ্ঠানিকতা নেই। শুধু ‘মুক্তি’ নাটকের একটি বই বের হচ্ছে। সবাই মিলে শুধু বইটার মোড়ক উন্মোচন করছি।

প্রশ্ন :

নানা ধরনের মাধ্যমে মানুষ এখন বিনোদন ও সংস্কৃতির খোরাক মেটাচ্ছে। প্রযুক্তির ক্রমাগত উন্নয়নে মানুষের রুচিও পরিবর্তন হচ্ছে। আপনার কি মনে হয়, থিয়েটার নিয়ে আরও ভাবার আছে, কিংবা আরও বৈচিত্র্য আনা যেতে পারে?

এই প্রশ্নটার উত্তর আমার কাছে সত্যিই নেই। আমরা প্রতিদিন মহড়া করে বা প্রদর্শনীর পরে গাড়িতে একসঙ্গে তিন–চারজন যখন ফিরি, রোজ আমাদের আলোচনায় এ ধরনের বিষয়গুলোই থাকে। কারণ হচ্ছে, মঞ্চে আমরা তো আসলেই একটি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। মঞ্চে এখন দর্শক কোথায়? বলা যায়, খুবই কম। সামগ্রিক সমাধান আমি জানি না তবে একটা জিনিস আমার কাছে মনে হয়, যদি ঢাকা শহর বা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বলি, আমাদের এটা আশা করা ভুল হবে যে আমাদের কাছে দর্শক আসবেন। আমাদের এখন দর্শকের কাছে যেতে হবে। তার মানে হচ্ছে ডিসেন্ট্রালাইজড করতে হবে। এই যে আমরা শিল্পকলা কিংবা মহিলা সমিতিকেন্দ্রিক মঞ্চনাটক করছি, সেখান থেকে যদি একটু বেরোতে পারি, ভিন্ন জায়গায় গিয়ে নাটক মঞ্চায়ন করতে পারি, তাহলে হয়তো নতুন দর্শক তৈরির সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে।

ত্রপা মজুমদার বাবা রামেন্দু মজুমদারের সঙ্গে
সংগৃহীত

প্রশ্ন :

তাহলে ঢাকাকে যদি আমরা উদাহরণ হিসেবে ধরি। তাহলে উত্তরায় যদি একটা মঞ্চ হয়, সেখানে যে অনেক বড় মঞ্চ হতে হবে, এমনটা নয়...

হ্যাঁ, কিছুই না। খুব দারুণ কিছু ফ্যাসিলিটি লাগবে, এমন নয়। দরকার নেই। তার কারণ হলো, এটা তো সত্য কথা—আমার নাটকের প্রতি এত প্রেম যে দুই ঘণ্টা জার্নি করে বনানী থেকে শিল্পকলায় যাই। কারণ, এটাকে আমি দারুণভাবে ভালোবাসি। কিন্তু আমি কি প্রত্যাশা করতে পারি, আমার মতো যে ৯টা–৫টা চাকরি করে বাসায় যাবে, বাসায় গিয়ে দুই ঘণ্টা ব্যয় করে আবার নাটক দেখতে আসবে? এটা কি সম্ভব? সম্ভব নয়। সে কারণেই আমাদের এখন প্রয়োজন, বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে নাটক প্রদর্শনী করা। এই আমি উত্তরায় যাব, মিরপুরে যাব, পুরান ঢাকায়, গুলশান–বনানী যাব—এভাবে বিভিন্ন জায়গায় যেতে পারলেই নতুন দর্শক তৈরির সুযোগ থাকবে।