বাংলা নাটকের মেলা বসেছে জাতীয় নাট্যশালায়
ভগ্নপ্রায় এক বাড়ি, যে বাড়ির বাসিন্দা মাত্র চার মানবসন্তান। এক বৃদ্ধ, এক বৃদ্ধা এবং তাঁদের সন্তানসম দুই তরুণ-তরুণী। চারজনকে একত্র করে একসঙ্গে বেঁধে রেখেছে ‘যাত্রা’। যাত্রা নিয়ে এই নাটক। পশ্চিম বাংলার নাটকের দল নান্দীপটের প্রযোজনা ‘আবৃত্ত’ নাটকটি গড়ে উঠেছে একদা যাত্রার সঙ্গে যুক্ত চারজন মানুষের পরস্পরের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা ও আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই নিয়ে। নাটকটির রচয়িতা তীর্থংকর চন্দ এবং নির্দেশনা করেছেন প্রকাশ ভট্টাচার্য। গত শনিবার জাতীয় নাট্যশালায় দুই বাংলার নাট্যমেলার দ্বিতীয় দিনে অভিনীত হলো নাটকটি।
এ যেন বাংলা নাটকের মহোৎসব। নাট্যদল প্রাঙ্গণেমোর আয়োজন করেছে ‘দুই বাংলার নাট্যমেলা ২০১৯’। ‘আমি বাংলায় ভালোবাসি, আমি বাংলাকে ভালোবাসি’ স্লোগানে এবার মেলায় বাংলাদেশ, ভারতের ৯টি দল অংশ নিচ্ছে। এর মধ্যে আছে বাংলাদেশের পাঁচটি এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও দিল্লির চারটি দল।
পরিবেশটা সত্যিকার অর্থে উৎসবমুখর। মূল মিলনায়তনের প্রবেশপথে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশাল প্রতিকৃতি। নিচে ঝলমলে আলোয় বাংলাদেশ ও ভারতের ৯টি নাটকের পোস্টার আর নানা রঙিন কাগজে দারুণ সাজ। আয়োজক সংগঠনের সদস্যরা সবাই এক নকশা, রঙের টি–শার্ট, ফতুয়া আর শাড়িতে মিশে গেছেন উৎসবে।
শুরুর দিন প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ ছিল। সেদিন উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে অভিনীত হয় কলকাতার প্রাক্সিস নাট্যদলের ‘আর্ট’ নাটকটি। পরদিন শনিবার ছিল ‘আবৃত্ত’। এদিন জাতীয় নাট্যশালার সুপরিসর মিলনাতনটি মাত্র কয়েকটি আসন খালি ছিল বলেন জানালেন প্রাঙ্গণেমোরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা অনন্ত হিরা। কথায় কথায় তিনি জানালেন উৎসবের প্রাসঙ্গিকতা। বললেন, ‘বাংলাদেশ ছাড়া শুধু ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ৯ কোটি বাংলাভাষী মানুষ আছে এবং পশ্চিমবঙ্গজুড়েই থিয়েটারচর্চার এক উন্মাতাল ব্যাপকতা ও ঐতিহ্য আছে। সঙ্গে আমরা বাংলাদেশে প্রায় ১৭ কোটি। থিয়েটারচর্চারও ব্যাপকতা আর ঐতিহ্যের গর্বিত দাবিদার আমরাও। তাই এই দুই বঙ্গের নাট্য সংস্কৃতির আদান-প্রদানের ভ্রাতৃত্ব আর বন্ধুত্ব নিশ্চিতভাবেই আমাদের নাট্য সংস্কৃতিকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিতে পারে—এ বিশ্বাস থেকেই এই নাট্যসেতু নির্মাণের প্রয়াস।’
গতকাল রোববার ছিল উৎসবের তৃতীয় দিন। জাতীয় নাট্যশালায় হয়েছে আয়োজক সংগঠনের নাটক ‘হাছনজানের রাজা’। অনন্ত হিরার নির্দেশনায় এ নাটক লিখেছেন শাকুর মজিদ। উল্লেখযোগ্য দর্শক গতকালও দেখা গেছে।
বৈচিত্র্যপূর্ণ নাটক আছে এবারের উৎসবে। যেমন আজ সন্ধ্যায় আছে প্রাচ্যনাটের নতুন নাটক ‘পুলসিরাত’। ফিলিস্তিনের লেখক ঘাসান কানাফানির উপন্যাস ‘ম্যান ইন দ্য সান’-এর বাংলা অনুবাদ করেছেন মাসুমুল আলম। নাট্যরূপ দিয়েছেন মনিরুল ইসলাম রুবেল। ‘পুলসিরাত’ নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন কাজী তৌফিকুল ইসলাম। স্বপ্নময় এক নতুন সচ্ছল জীবনের প্রত্যাশায় আগস্ট মাসের প্রচণ্ড গরমে, রোদে পুড়ে মরুভূমির পথে এগিয়ে চলা তিনটি হতভাগ্য জীবন ছুটে চলা নিয়ে এ নাটক। যে তিনজন প্রতিনিধিত্ব করে উপমহাদেশীয় অর্থনৈতিক উদ্বাস্তুদের, যারা ক্রমাগত ভিড় করছে উন্নত বিশ্বে। কাল ১০ ডিসেম্বর কলকাতার রসিকতা মঞ্চস্থ করবে অভিজ্ঞান ভট্টাচার্য নির্দেশিত ‘জ্যান্ত হ্যামলেট’। শেক্সপিয়ার হ্যামলেট গল্পের বিষয় যে আজকের সমাজেও ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক, তা তুলে ধরা হয়েছে এ নাটকে। ১১ ডিসেম্বর ফয়েজ জহিরের নির্দেশনায় বিবর্তন যশোর নিয়ে আসবে নাটক ‘কৈবর্তগাথা’। নাটকটি রচনা করেছেন আবদুল্লাহহেল মাহমুদ, নির্দেশনা দিয়েছেন ফয়েজ জহির। প্রাচীন বাংলার একটি ইতিহাস নিয়ে এ নাটক। এরপর ১২ ডিসেম্বর আরণ্যকের ‘ময়ূরসিংহাসন’, ১৩ ডিসেম্বর লোকনাট্য দলের ‘আমরা তিনজন’।
উৎসবের সমাপনী দিনে দিল্লির দল গ্রিনরুম থিয়েটার প্রযোজিত ও অঞ্জন কাঞ্জিলাল নির্দেশিত নাটক ‘বিসমিল্লা’ মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে শেষ হবে প্রাঙ্গণেমোর আয়োজিত এবারের ‘দুই বাংলার নাট্যমেলা ২০১৯’। এ ছাড়া ১৩ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় ‘থিয়েটারের সংকট দর্শক না ভালো নাটক’ শিরোনামে মুক্ত আলোচনার আয়োজন করা হয়েছে। এতে ধারণাপত্র পাঠ করবেন হাসান শাহরিয়ার এবং মুখ্য আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন স্বপন রায়, মলয় ভৌমিক, আহমেদ ইকবাল হায়দার, রতন সিদ্দিকী, মোহাম্মদ আলী হায়দার ও রহমান রাজু। সঞ্চালক হিসেবে থাকবেন অনন্ত হিরা।
অন্যদিকে, ‘প্রাঙ্গণেমোর নাট্যযোদ্ধা সহযোদ্ধা সম্মাননা ২০১৯’ প্রদান করবেন নাট্যযোদ্ধা মামুনুর রশীদের সহধর্মিণী গওহর আরা চৌধুরী, নাট্যযোদ্ধা আতাউর রহমানের সহধর্মিণী শাহিদা রহমান এবং নাট্যযোদ্ধা লিয়াকত আলীর সহধর্মিণী কৃষ্টি হেফাজ।
দুই বাংলার নাটক নিয়ে এটি হচ্ছে প্রাঙ্গণেমোরের ১১তম আয়োজন। ২০০৮ সালে প্রথমবার আয়োজনটি করে প্রাঙ্গণেমোর। এক বছর পরপর নিয়মিতই করে আসছে তারা।