কেমন চলছে রেপার্টরি থিয়েটার?
বাংলাদেশের মঞ্চনাটকে বড় ধরনের অবদান আছে গ্রুপ থিয়েটারের। পেশাদারি নাট্যচর্চার লক্ষ্যে গ্রুপ থিয়েটারের পাশাপাশি শুরু হয় রেপার্টরি থিয়েটারচর্চা। এখানে সামান্য হলেও প্রযোজনা–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সম্মানী দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা গেছে, যা পেশাদারি নাট্যচর্চার একধরনের যাত্রা বলা যায়।
এরই মধ্যে এই রেপার্টরি নাট্যচর্চা পার করেছে কয়েক দশক। এখনো ঠিক পেশাদারি কাঠামো তৈরি না হলেও পেশাদারি চর্চার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে নাট্যকর্মীদের ধারণা। এটা ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন অনেকে। সেই সঙ্গে তুলে ধরছেন রেপার্টরি নাট্যচর্চার সংকটের কথাও।
এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি রেপার্টরি নাটকের দলের কাজ দেখা গেছে বাংলাদেশের নাট্যচর্চায়। সেখানে আছে প্রবীণ নাট্যজনদের তৈরি রেপার্টরি নাটকের দল, আছে একদমই তরুণ নাট্যশিল্পীদের গড়া দলও। এর মধ্যে উল্লেখ করা যায় বাঙলা থিয়েটার, থিয়েটার আর্ট রেপার্টরি, নন্দন, সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার (সিএটি), জন্মসূত্র, কারিগর, থিয়েটারওয়ালা রেপার্টরি, নাট্যম রেপার্টরি, দশরূপক, শূন্যন, আগন্তুক, বঙ্গলোক, ম্যাড থেটার, যাত্রিক, হৃৎমঞ্চ, নাটবাঙলা, স্পর্ধা ইত্যাদি। এসব দল থেকে বেশ কিছু জনপ্রিয় ও ভালো নাটকও উঠে এসেছে। যেমন চে’র সাইকেল, শাইলক অ্যান্ড সিকোফ্যান্ট, দমের মাদার, লাল জমিন, জবর আজব ভালোবাসা, রিজওয়ান, অন্ধকারে মিথেন, হ্যামলেট, রুধিররঙ্গিনী, পুত্র, দি কমিউনিকেটর, অ্যাম্পিউটিশন, দ্য লেডি ফ্রম দ্য সি, সেনাপতি ইত্যাদি নাটক।
বাঙলা থিয়েটারের মাধ্যমে রেপার্টরি নাট্যচর্চা শুরু করেন নাট্যজন মামুনুর রশীদ। বর্তমান অবস্থা নিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন তো অনেক রেপার্টরি নাটকের দল কাজ করছে। আগে হাতে গোনা কয়েকটি ছিল। আমরাও চাই রেপার্টরির সংখ্যা বাড়ুক। কারণ, অনেক নাট্যদলের লোক একসঙ্গে কাজ করতে পারে। যৎসামান্য সম্মানী পায়। এর মাধ্যমে আমরা পেশাদারি নাট্যচর্চার দিকে এগোতে পারি।’
তবে শুধু অর্থনৈতিক দিক নয়, গ্রুপ থিয়েটারচর্চার বাইরে গিয়ে একটি আলাদা নাট্যচর্চাকেও গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন আগন্তুক রেপার্টরি দলের হয়ে কাজ করা নাট্যশিল্পী পান্থ শাহরিয়ার। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক চিন্তাই যে গুরুত্বপূর্ণ এমনটি নয়, এটা গ্রুপ থিয়েটারচর্চার বাইরে একধরনের নাট্যচর্চাও—যা ইতিবাচক। এখানে নানা দলের নাট্যকর্মীরা নিজেদের মধ্যে আদান–প্রদানের মাধ্যমে নাট্যচর্চা করতে পারছে। এটাও রেপার্টরি নাট্যচর্চার সফলতা বলা যায়।
থিয়েটারওয়ালা রেপার্টরি নাটকের দলের সাইফ সুমন বলেন, ‘আমাদের এখানে রেপার্টরি দাঁড়ানোর সম্ভাবনা কম। শুধু বললেই তো হবে না, অগ্রজদের পেশাদারির জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। রেপার্টরিটা হয়ে গেছে সাময়িক উত্তেজনার বিষয়। শুধু বিভিন্ন দলের নাট্যকর্মী নিয়ে কাজ করলেই চলবে না। রেপার্টরি নাম দিয়ে গ্রুপ থিয়েটারের কনসেপ্টে চললে তো হবে না। বিষয়টি বুঝে ভালোভাবে এগোতে হবে।’
এ কথার সঙ্গে একমত সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার (সিএটি) দলের অভিনেতা এ কে আজাদ সেতু। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রযোজনা, ডিজাইন, অভিনয়—সবকিছু মিলে পেশাদার জায়গাটা বজায় রাখছি। আমরা খেয়াল রাখি, আমাদের প্রযোজনা নিয়ে যেন কোনো ধরনের প্রশ্ন না ওঠে। গ্রুপ থিয়েটারে যেভাবে নাট্যচর্চা হয়, এখানে এমন যেন না হয়। বর্তমানে যেভাবে রেপার্টরিগুলো হচ্ছে, তাতে দু–একটি ভালো কাজ হচ্ছে। কিন্তু তাতে পুরোপুরি পেশাদারত্ব আসছে না। অনেকেই মনে করছেন, একটা নাটক করছেন, সম্মানী পাচ্ছেন—এটাই হয়তো পেশাদারি। এটা নয়। আপনাকে স্কিল্ড হতে হবে।’
পেশাদারি নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে সরকারি, বেসরকারি ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি। বিশ্বজুড়ে এমনটি দেখা যায়। নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বুদ্ধিজীবীর দায় ও অন্যান্য বইয়ে ‘কেন নাটক?’ প্রবন্ধে লেখেন, ‘সব দেশেই বাণিজ্যিক থিয়েটারের বাইরে বড় বড় ভালো থিয়েটার চলে সরকারি–বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়। যেমন ইংল্যান্ডে ন্যাশনাল থিয়েটার, বারবিকান সেন্টার, গ্লোব থিয়েটার বা রয়াল শেক্সপিয়ার কোম্পানির মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর্টস কাউন্সিলের মাধ্যমে সরকার এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো করপোরেট পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে থাকে। তাদের বাজেটের ৮০ ভাগ আসে এসব অনুদান থেকে। বাকি ২০ ভাগ টিকিট বিক্রি থেকে।’
তাই বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় এই পৃষ্ঠপোষকতায় অভাবের কথাও বললেন অনেকে। পাশাপাশি সমস্যা হিসেবে উঠে এসেছে মঞ্চসংকটের বিষয়টি। নাট্যম রেপার্টরি নিয়ে কাজ করেন আইরিন পারভীন লোপা। তিনি বলেন, ‘আমাদের রেপার্টরি কোম্পানি আকারে দাঁড়াচ্ছে না অর্থনৈতিক সংকটের কারণে। এ জন্য বেসরকারি ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকদের এগিয়ে আসতে হবে। শিল্পকলায় আমরা রেপার্টরি দলগুলো খুব কম হল পাই। সরকার ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।’
একই কথা শোনা গেল শূন্যন রেপার্টরি দলের হয়ে কাজ করা মোমেনা চৌধুরীর কণ্ঠেও। তিনি বলেন, ‘রেপার্টরি থিয়েটারে সম্ভাবনা অনেক বেশি। সংকট হলো রেপার্টরি থিয়েটারগুলো হল কম পায়। তবে পৃষ্ঠপোষকতা খুব জরুরি। আমরা শূন্যন থেকে প্রত্যেক সদস্যকে প্রদর্শনী বাবদ সম্মানী দিতে পারি। সরকারি সহযোগিতার কারণে এটা হয়েছে। এটা সম্ভাবনার দিক।’
সবকিছু মিলে রেপার্টরি নাটকের মাধ্যমে পেশাদারি নাট্যচর্চার একটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে বলে ধারণা করেন নাট্যকর্মীরা। এতে যেমন ভালো প্রযোজনা হচ্ছে, আবার শিল্পীরাও সম্মানী পাচ্ছেন। সৈয়দ জামিল আহমেদ নির্দেশিত রিজওয়ান নাটকটি বড় উদাহরণ। শোনা যাচ্ছে, তিনি নতুন আরেকটি নাটক রেপার্টরি আঙ্গিকে স্পর্ধার ব্যানারে নিয়ে আসছেন।