উত্তমকুমারকে দেখে অভিনেতা হতে চেয়েছি

তারিক আনাম খান
প্রথম আলো
চার দশকের বেশি সময় ধরে মঞ্চ, নাটক আর সিনেমায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। করোনার কারণে শুটিং থেকে দীর্ঘদিন দূরে ছিলেন। আবার তিনি ফিরেছেন শুটিং সেটে। কথা হলো গুণী অভিনেতা তারিক আনাম খানের সঙ্গে।

প্রশ্ন :

কেমন আছেন?

এখন পর্যন্ত ভালো আছি, আক্রান্ত হইনি। এটাই খবর।

প্রশ্ন :

দীর্ঘ বিরতি শেষে কাজ শুরু করেছেন। কর্মক্ষেত্রে কি স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে?

মানা হচ্ছে, এটা পুরোপুরি সত্য নয়। প্রথম দিকে একটা নাটকে শুটিং করলাম, সেখানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে, সামাজিক দূরত্ব রেখে শুটিং হয়েছে। পরে একটি সেটে গিয়ে দেখি, মানুষে ভর্তি। কোনো কিছু মানার বালাই নেই। আমি সরাসরি বললাম, এভাবে আমি কাজ করতে পারব না। আমাকে বাদ দিতে হবে। তবে প্রকৃত অবস্থা হলো, কাজ তো করতে হবে। নাহলে মানুষ চলবে কী করে! অনেক ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যবিধি মানা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

প্রশ্ন :

এখন কী নিয়ে ব্যস্ত?

নাটকের কাজ শুরু করেছি। একটা সিরিয়ালের কাজও চলছে। বেশ কিছু সিনেমার কাজ আটকে আছে। নভেম্বর থেকে শুরু হবে। আশফাক নিপুণের পরিচালনায় একটা টেলিছবির কাজ শুরু করব। আর শিহাব শাহীনের একটা ওয়েব ছবিও করব সামনে।

প্রশ্ন:

আপনার ছেলে আরিক আনাম খানের প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি দুটো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রতিযোগিতা করছে। বাবা হিসেবে ছেলের কাছ থেকে আপনার প্রত্যাশা কী?

আমার কোনো প্রত্যাশা নেই। আমি শুধু চাই, ও ভালো মানুষ হোক। ও যা করে খুশি থাকে তা–ই করুক। ওর খুশিতেই আমার খুশি। আমরা একসঙ্গে অনেক সিনেমা দেখেছি। সিনেমা নিয়ে কথা বলেছি। লন্ডন ফিল্ম স্কুলে পড়তে গিয়ে ওর চোখ আর মন তৈরি হয়েছে। আমার ভালো লাগছে যে আরিক যেটা করছে, জেনেবুঝে করছে। বাবা হিসেবে আমি চাই, ওর জীবনটা যেন অর্থপূর্ণ হয়।

তারিক আনাম খান
সংগৃহীত

প্রশ্ন :

আপনি দশকের পর দশক ধরে বিনোদন ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে কাজ করছেন। কোন পথে চলছে ইন্ডাস্ট্রি?

আমাদের সিনেমার যাত্রা শুরু হয়েছিল দারুণভাবে। ‘সূর্যস্নান’, ‘ধারাপাত’, ‘কখনো আসেনি’, ‘কাঁচের দেয়াল’, ‘সুতরাং’—অসাধারণ সব সিনেমা তৈরি হয়েছে। নাটকের বেলায়ও তাই। আমার মনে আছে, বিটিভির জন্য আব্দুস শাকুরের একটি নাটকে অভিনয় করেছিলাম, যেখানে আমি ছিলাম এক সরকারি কেরানি, দিনের পর দিন ধরে যাঁর কোনো পদোন্নতি নেই। একটা সরকারি চ্যানেলে এক সরকারি কেরানির দুঃখ–দুর্দশার কথা কী শৈল্পিকভাবেই না বলা হয়েছে! একজন শিল্পী যা বলতে চান, অল্প পরিসরে হলেও তা বলার একটা সুযোগ ছিল। মহিলা সমিতিতে ছোট্ট জায়গায় কী সুন্দর করেই না শুরুটা হলো মঞ্চনাটকের। আশির দশকটা আমাদের চমৎকার কেটেছে। নব্বইয়ের দশকও ভালো গেছে। অদ্ভুত একটা সুন্দর সময় ছিল। উন্মাদনা ছিল। সেসব যে কোথায় হারিয়ে গেল! ওই দিনগুলো খুব মিস করি।

প্রশ্ন :

কেন সময়টা হারিয়ে গেল?

মেধাচর্চার জায়গাটাই নষ্ট হয়ে গেছে। হলিউড বা বলিউডে একটা দৃশ্য কতবার করে অনুশীলন করা হয়। আমির খান কিংবা রাজকুমার রাও—একটা শট দেওয়ার আগে কয়েকবার প্র্যাকটিস করেন। এখন হলিউড, বলিউড, ওয়েব প্লাটফর্ম—সবই হাতের মুঠোয়। তাই প্রতিযোগিতার কোনো সীমানা নেই। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকারও কোনো বিকল্প নেই। এটা মাথায় নিয়েই আমাদের কাজ করতে হবে। নতুবা দর্শক এ ধরনের কনটেন্ট দেখে, আমার কাজ দেখে না—এটা হবে স্রেফ অরণ্যে রোদন। এ অভিযোগ, আহাজারির কোনো মানে থাকবে না। সব জায়গা সবার জন্য নয়, এটাও মেনে নিতে হবে। বিচ্ছিন্নভাবে বিনোদন ইন্ডাস্ট্রির অধঃপতন ঘটেনি। আমাদের সময়ের সেই সাহিত্যিকেরা কোথায়? আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, মহাদেব সাহা, আবুল হাসান...। অবশ্য লকডাউনে বাসায় সমসাময়িক বেশ কিছু লেখকের বই পড়েছি। শাহীন আক্তার, মাসরুর আরেফিন, সিদ্ধার্থ হকদের লেখা ভালো লেগেছে।

প্রশ্ন :

নিমা রহমানের সঙ্গে দাম্পত্যজীবনের বয়স ৩৫ পেরোতে চলল...

সেই যে ‘ম্যাকবেথ’ নাটক করতে গিয়ে তিনি আমায় ধরে ফেললেন আর ছাড়াছাড়ি নেই। এই যে এখনো আমার পাশেই আছেন। আমাদের ঝগড়া, মনোমালিন্য হয়নি তা নয়। তবে আমাদের মধ্যে শিল্পের ক্ষেত্রে দ্বিমত হয়েছে খুব কম। রুচি আর বোধের অমিল খুব কম। খাওয়াদাওয়ার পছন্দ–অপছন্দেও মিল। তবে হ্যাঁ, ঠিক করেছি বাকি জীবনে আর কখনোই ঝগড়া করব না।

প্রশ্ন :

আপনি তো বিজ্ঞানের ভালো ছাত্র ছিলেন। ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার বা পাইলট না হয়ে অভিনেতা কেন হলেন?

আমার বাবা চেয়েছিলেন আমি যেন ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ারই হই। কারণ, আমি অঙ্কে ভালো ছিলাম। আমাদের সময়ে নায়ক ছিলেন একজনই—উত্তমকুমার। তাঁকে দেখে অভিনেতা হতে চেয়েছি। আবার আয়নায় নিজেকে দেখে ভেবেছি, অভিনেতা হওয়াটা ঠিক হবে না। এরপর মুক্তিযুদ্ধের পরে থিয়েটার নিয়ে পড়ালেখা করতে গেলাম দিল্লির ন্যশনাল স্কুল অব ড্রামায়। তখন অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম। এখন মনে হয়, সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলাম।

প্রশ্ন :

আপনি শিক্ষক হলে নিজেকে অভিনয়ে কত নম্বর দেবেন?

একজন শিল্পী কখনো নিজের কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারেন না। যখন নিজের কাজে সন্তুষ্টি চলে আসে, সেখানেই শিল্পীর মৃত্যু ঘটে। আত্মসমালোচনার জায়গা রাখতেই হবে। আমি নিজেকে শিক্ষক নয়, বরং ছাত্র হিসেবেই দেখি, যে প্রতিনিয়ত শিখছে। সময়ের দাবি পূরণ করার চেষ্টা করছে।

তারিক আনাম খান
সংগৃহীত

প্রশ্ন :

কোথায় করছেন? ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম—কোথাও আপনি নেই...

ওটা ভিন্ন ব্যাপার। আমি এখনো প্রযুক্তিতে তেমন পারদর্শী নই। আমার কাগজে–কলমে লিখতেই ভালো লাগে। টাইপ করতে পারি না। বই পড়তে ভালো লাগে। ট্যাবে অভ্যস্ত নই।

প্রশ্ন :

আপনাকে নেতিবাচক চরিত্রে বেশি দেখা যায় কেন?

(হাসতে হাসতে) ওই যে, দেখতে খারাপ। আর আমার সমসাময়িক অভিনয়শিল্পীরা শুরুর দিকে অনেক রোমান্টিক চরিত্র করেছেন। আমার সেভাবে করা হয়নি।

প্রশ্ন :

আপনি সব সময় বলেন, বয়স কেবল একটা সংখ্যা। আপনার মনের বয়স কত?

আমরা যখন গল্প করি, আমাদের তারুণ্যে ফিরে যাই। শিক্ষকদের কথা উঠে আসে। স্মৃতি খুঁড়ে যেন সেই সময়ে চলে যাই, সেই বয়সেই থাকি। আসলে বিষয়টা হলো নিজের ভেতরের শিশুটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।