রাজশাহীতে শতফুলের যাত্রা উৎসব
রঞ্জন দেবনাথের ‘জীবন্ত শয়তান’ ও কাজী মো. আবু বকর সিদ্দিকের ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ যাত্রাপালা দেখার জন্য কোনো দর্শনী ছিল না। পাঁচ শতাধিক দর্শক গত রোববার ও গতকাল সোমবার দিবাগত রাতে রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার জাহানাবাদ গ্রামে পালা দুটি উপভোগ করেন।
প্রথম দিন বৃষ্টি ঠেকাতে ত্রিপলের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সবই করেছিল শতফুল বাংলাদেশ নামের একটি বেসরকারি সংস্থা। প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাই এই পালার শিল্পী। এক যুগ ধরে সংস্থার রেওয়াজ অনুযায়ী তাদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে যাত্রা উৎসবের আয়োজন করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন উৎসবে তারা যাত্রা ও নাটক মঞ্চায়ন করে। যেকোনো সময় পরিবেশনের জন্য তাদের ২২টি যাত্রাপালা প্রস্তুত রয়েছে।
শতফুল বাংলাদেশ–এর অডিটর মো. তাহেরুল হকের শিল্প নির্দেশনায়, এমআইএস অফিসার মো. আক্কাস আলী সরদারের পরিচালনায়, সংস্থার সংগীত বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তুষার মাহমুদ ও সহকারী হিসাবরক্ষক শিউলী আক্তারের আবহসংগীতের মাধ্যমে সংস্থার কার্যালয়ের পাশে অস্থায়ী মঞ্চে যাত্রাপালা দুটি মঞ্চস্থ হয়।
‘জীবন্ত শয়তান’ একটি কাল্পনিক ঐতিহাসিক যাত্রাপালা, যা মধ্যযুগে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গাকে পটভূমি করে রচিত হয়। এতে চাঁদ গাজী চরিত্রে অভিনয় করেছেন নাসির হোসেন, সূর্যদেব বর্মা চরিত্রে আক্কাস আলী সরদার, পীর আহসানউল্লাহ চরিত্রে শরীফুল ইসলাম, রানী কীর্তিমতী চরিত্রে মিস রুশিনার অভিনয় উৎরে গেছেন।
জনপ্রিয় বেদের মেয়ে জোসনা পালায় বেদের মেয়ে জোসনা চরিত্রে স্বপ্না, রাজকুমার চরিত্রে ইমরান আলী, কাজীর চরিত্রে আশরাফুল ইসলাম, বঙ্গরাজ চরিত্রে আক্কাস আলী সরদার, রানী চরিত্রে মিস রুশিনা, মোবারক চরিত্রে মো. ইব্রাহীম হোসাইন সফল অভিনয় করেছেন।
স্থানীয় দর্শক মো. আবু হানিফ দুটি পালাই দেখেছেন। নিজের ভালো লাগার কথা জানিয়ে বলেন, অপসংস্কৃতির কালো ছায়ায় ঢেকে গেছে যাত্রাপালার ঐতিহ্য। শতফুল বাংলাদেশ সংস্কৃতির পুরোনো ধারাকে নতুন করে জাগানোর চেষ্টা করছে।
দর্শক মনসুর আলীর ভাষায়, ‘আগে কত আনন্দ করিছি এগলান দেকে। কিন্তুক এখন আর আগের মতন সেগলা হয় না। শতফুল একনা আয়োজন করে সে তকনে একনা দেকতে পারি। দোয়া করি, প্রতিবছর যেন শতফুল এগনান যাত্রাপালা করবার পারে।’
শতফুল বাংলাদেশ–এর নির্বাহী পরিচালক মো. নাজীম উদ্দীন মোল্লা জানান, এই যাত্রাপালার সব কলাকুশলীই অপেশাদার শিল্পী। অপেশাদার এই অর্থে যে নাটকই তাঁদের একমাত্র জীবিকা নয়। তাঁরা শতফুল বাংলাদেশ–এর বিভিন্ন স্তরের কর্মী। মূলত হৃদয়ের টানেই তাঁরা নিয়মিত নাট্যচর্চা করে যাচ্ছেন। ক্ষুদ্র ঋণে বিনোদনহীন ব্যস্ত সময় কাটানোর পর অবসরে এই নাট্যচর্চা তাঁদের মনকে প্রফুল্ল রাখে। এখানে একই ছাদের নিচে অবস্থান করছেন সেই আশির দশকের নাট্যকর্মী থেকে শুরু করে নবীন শিল্পীরাও।
নাজীম উদ্দীন মোল্লার মতে, বরেন্দ্র ভূমিখ্যাত রাজশাহী অঞ্চলের শিল্প ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, বিশেষ করে নাট্যজগৎ বর্তমানে খুব বেশি বিস্তৃত নয়। এমন নয় যে এখানকার মানুষ সংস্কৃতিবিমুখ, বরং নাটক পছন্দ করেন যাঁরা, তাঁদের একটা বিশাল অংশ রয়েছেন এখানে। তাই এ অঞ্চলের নাট্যজগতের হারিয়ে যাওয়া পথরেখা পুনরুদ্ধার, তথা সেই অধরা সুখ পাখিকে নীড়ে ফিরিয়ে আনার প্রয়াসেই ২০১১ সাল থেকে তিনি এই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।