মহাপরিচালকের দায়িত্ব নেওয়ার প্রশ্নে আপনি তো আগ্রহী ছিলেন না। কোন পটভূমিতে দায়িত্ব নিলেন?
সৈয়দ জামিল আহমেদ: দেশে একটা আন্দোলন হয়ে গেছে। যেটাকে আমরা বলছি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। আমরা সব প্রকারের বৈষম্যহীন বাংলাদেশ চাইছি। আগে হয়তো বলতাম, শ্রেণিহীন। এখানটায় বলছি, বৈষম্যহীন।
প্রসঙ্গটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য হাজার মানুষের প্রাণ গেছে। অনেকে ছররা গুলি খেয়েছেন, চোখে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন, অনেকে পিঠে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। অনেকে যন্ত্রণায় নড়তে পারছেন না। আমি ভেবেছিলাম, দায়িত্ব নেব না। আমার বয়স হয়েছে। আমি মনে করেছি, এখন আমার নাটক করার সময়।
এখানে অনেক অনিয়ম হয়েছে। সেটা আগে থেকেই জানতাম। এটা (দায়িত্ব) নিলে আর নাটক করা হবে না। তারপরও আসিফ নজরুল সাহেব ও কয়েকজন তরুণের সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হলো, আমার একটা দায়িত্ব রয়েছে। যেহেতু আমার জীবনটা সৎপথে পরিচালিত করেছি। আমার কোনো রাজনৈতিক শক্তির কিছু নেই। সততার শক্তি দিয়ে হয়তো আমি ঠিক করতে পারব। এই প্রতিষ্ঠানটা যদি ভেঙে যায়, তাহলে ছারখার হয়ে যাবে। এই জায়গাটাকে বাঁচানোর জন্য আমি শেষ পর্যন্ত দায়িত্ব গ্রহণে রাজি হয়েছি।
মহাপরিচালক হিসেবে এই সময়ে কোন কাজটাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন?
সৈয়দ জামিল আহমেদ: আমি তিনটা লক্ষ্য ঠিক করেছি—স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি। স্বল্প মেয়াদে তিনটা লক্ষ্য আছে। এক. প্রশাসনিক স্বচ্ছতা। কোনো রকম অনিয়ম, অবিচার যেন না হয়। আইন অনুসারেই যেন সবকিছুর সমাধান হয়।
দুই. আর্থিক ক্ষেত্রে সংস্কার। আমি কালকে (মঙ্গলবার) যোগ দিয়েছি। তার আগপর্যন্ত সব খাতা তালাবদ্ধ রাখতে বলেছি। অডিট করা হবে। অডিট করে পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত করতে হবে, কোথায় কোথায় গন্ডগোল আছে। যারা গন্ডগোল করেছে, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে।
তিন. যত দ্রুত পারি, শিল্পকলাকে খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করব।
এই তিনটি কাজ শেষ করে বিভাগীয় পর্যায়ে যাওয়া দরকার। কীভাবে জেলার শিল্পকলা একাডেমিকে আরও শক্তিশালী করতে পারি, তা নিয়ে কাজ করব।
আপনি বরাবরই ‘ইনক্লুসিভ’ বাংলাদেশের কথা বলে এসেছেন। এ ক্ষেত্রে কালচার কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে?
সৈয়দ জামিল আহমেদ: মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কথা বলি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে এম আর আখতার মুকুল সাহেব ‘চরমপত্র’ অনুষ্ঠান করতেন। এতে এমনভাবে রসিয়ে কথা বলতেন, যেটা সবার মনে আগ্রহ তৈরি করেছিল। এটা মানুষের মনে উদ্দীপনা জুগিয়েছিল। যুদ্ধে আমি গুলি করব, কিন্তু তার পেছনে তো উদ্দীপনা লাগবে।
মুক্তিযুদ্ধের জন্য আমরা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম। সংস্কৃতি আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল। তখন ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’ কিংবা হাজারও গান হয়েছিল। সেই গান-কবিতা আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল। সংস্কৃতি এটাই করে।
এই সময়েও সংস্কৃতি একই কাজ করেছে। দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতি, স্লোগান—নতুন ধরনের প্রতিবাদের ভাষা তৈরি হয়েছে। সেই ভাষাই সাংস্কৃতিক চেতনা, ওটাকে ধারণ করেছে। ‘পানি লাগবে পানি’ বলে যে ছবিগুলো আঁকা হয়েছে, এটা দেখলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক যুবক (আবু সাঈদ), তার ওপর এক ভারতীয় শিল্পী ছবি এঁকেছে। সেই ছবি দেখে মন খারাপ হয়েছে।
একজন অর্থনীতিবিদ পরিকল্পনা করেন, সেই পরিকল্পনার জন্য মানুষকে ছুটতে হয়; সংস্কৃতি সেটাই করে। আমাদের ওইটাই (সংস্কৃতি) শক্তিশালী করতে হবে। যেটা শেখ হাসিনা একদম বোঝেননি। দলীয়করণ করে ফেলেছেন। স্রেফ শেখ মুজিবকে নিয়ে কথা বলেছেন, আর কোনো কথা হয়নি।
এর মধ্যে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে যেমন সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি হয়েছে, তেমনি অনেকের মধ্যে মানুষের কথা বলার চেষ্টাটাও ছিল...
সৈয়দ জামিল আহমেদ: নতুন প্রজন্ম বের হয়ে আসতে সাহস করেছে। আমাদের প্রজন্ম কিংবা আমাদের চেয়ে একটু কম বয়সী তারা সাহস করেনি। তারা ভেবেছে, বিকল্প কী! তারা ভয় পেয়েছে। ভেবেছে, আওয়ামী লীগ চলে গেলে জামায়াত আসবে।
এরা কালচারাল ন্যাশনালিস্ট, তাদের ভয় ছিল। এ জন্য তারা চুপ করে ছিল আর বলেছে, বিকল্প কই? কিন্তু ছাত্ররা দেখিয়েছে, তারাই বিকল্প। বিকল্প জনতা তৈরি করেছে। আপনাদের এটা নিয়ে ভয় পাওয়া উচিত নয়।
সাবেক মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর সাত মেয়াদে বিস্তর দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হওয়ার পরও শিল্পকলায় নিয়োগের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের প্রভাব ছিল। এ ক্ষেত্রে আপনার অবস্থান কেমন হবে?
সৈয়দ জামিল আহমেদ: আমার কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ নেই। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, আমাদের নাট্যদল ‘স্পর্ধা’ থেকে কোনো নিয়োগ হবে না। আমার শিল্পকলায় দুটি প্রজেক্ট ছিল। এক. বই প্রকাশ। আমি বলেছি, এটা বাইরে নিয়ে যাব। এটা স্বার্থের সংঘাত।
আরেকটি প্রজেক্ট আগেই অর্ধেক হয়েছিল। ওটাও স্বার্থের সংঘাত। দরকার হলে ওটা বন্ধ করে দেব। মেয়াদ শেষের পর প্রয়োজন হলে প্রজেক্ট সাবমিট করব। শিল্পকলা করলে করবে, অন্যথায় বাইরে থেকে করব। আমার তরফ থেকে এটা করব।
আমি সব জায়গায় বলেছি, অনেকের ভেতর অনেক ক্ষোভ ছিল। এখানে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা হয়েছে। সেটা হচ্ছে, প্রশাসনিক ও আর্থিক। ওটাকে পরিষ্কার না করলে পরের কাজগুলো করা যাবে না। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব, এ রকম কোনো দলীয়করণ যেন না হয়।
দীর্ঘদিন ধরে সংকটকাল পার করছে শিল্পকলা একাডেমি। দুই বছরে এর সংস্কার করা কতটা সম্ভব?
সৈয়দ জামিল আহমেদ: আমরা সবাই মিলে কাজ করলে অনেক কিছু সম্ভব। আমরা সবাই মিলে ইচ্ছা করলে প্রশাসনিক ও আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফেরানো সর্বোচ্চ এক মাসের কাজ।
আর ইচ্ছা না করলে তো হবে না। প্রত্যেকে দায়িত্ব পালন করলেই সম্ভব, আমার এককভাবে সম্ভব নয়। সবাই মিলে কাজ করলেই সম্ভব।