গ্রুপ থিয়েটার চর্চা
৫০ বছর পার করেও মুখর চট্টগ্রামের নাট্যাঙ্গন
১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি থিয়েটার-৭৩ নাট্যদলের দুটো নাট্যপ্রযোজনার মাধ্যমে চট্টগ্রামে শুরু হয় শহরকেন্দ্রিক গ্রুপ থিয়েটারের যাত্রা। এদিন চট্টগ্রাম ক্লাব মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হয় জহির রায়হানের ম্যাসাকার এবং মমতাজউদদীন আহমদের স্পার্টাকাস বিষয়ক জটিলতা। প্রথম নাটকের নির্দেশক জিয়া হায়দার, দ্বিতীয়টির মমতাজউদদীন আহমদ।
১৯৭৬ সাল। ২১ ফেব্রুয়ারি। প্রভাতফেরির সতীর্থদের সঙ্গে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে কাছের আন্দরকিল্লায় হাঁটছি। কোথাও কোনো যানবাহন নেই। মানুষ হাঁটছে লাইন ধরে। কোনো লাইন শহীদ মিনারের দিকে যাচ্ছে, কোনো লাইন সেখান থেকে ফিরছে। আমরা কজন আন্দরকিল্লার মোড়ে এসে পৌঁছতেই একটা ভিড়ের দিকে নজর গেল। ভেতর থেকে ঢোলের তালে তালে এক গায়েনের মনকাড়া সুরেলা আওয়াজ ভেসে আসছে। ভিড় ঠেলে ভেতরে গিয়ে একটা অন্য রকম জগতে ঢুকে গেলাম। একজন ঢুলি অসাধারণ দক্ষতায় ঢোল বাজাচ্ছেন আর তার তালে তালে উদাত্ত গলায় গান গাইছেন গায়েন। লোকসুরে গানে গানে মানুষের মনের কথা বলছেন। গায়েনের পাশাপাশি ওখানে রাজা, মন্ত্রী, সেপাই, জনতাও দেখলাম। গায়েন গানের সুরে সুরে রাজার উদ্দেশে বলেন, ‘ওরে হুতোম দেশের রাজা, তুই মানুষ মেরে করবি কী তা বল?’ ওটা আসলে একটা নাটক। মিলন চৌধুরী রচিত যায় দিন, ফাগুন দিন। বাংলাদেশের প্রথম পথনাটক। গণায়ন নাট্য সম্প্রদায় এই নাটকের আয়োজন করেছিল। মিলনায়তন, মঞ্চের উপকরণ, আলোক, শব্দনিয়ন্ত্রণ সরঞ্জামসহ নানা সীমাবদ্ধতা ও ৭৫–পরবর্তী থমথমে আবহ কাটাতে মঞ্চের বাইরে গিয়ে নাটক নিয়ে নতুন কিছু করার প্রচেষ্টা ছিল এই নাটক। এভাবে চট্টগ্রামে গ্রুপ থিয়েটার শুরুর তিন বছরের মাথায় গণায়ন নাট্য সম্প্রদায়ের মাধ্যমে শুরু হলো বাংলাদেশে পথনাটকের যাত্রা।
১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি থিয়েটার–৭৩ নাট্যদলের দুটো নাট্যপ্রযোজনার মাধ্যমে চট্টগ্রামে শুরু হয় শহরকেন্দ্রিক গ্রুপ থিয়েটারের যাত্রা। এদিন চট্টগ্রাম ক্লাব মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হয় জহির রায়হানের গল্প ম্যাসাকার এবং মমতাজউদদীন আহমদের স্পার্টাকাস বিষয়ক জটিলতা।
১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি থিয়েটার–৭৩ নাট্যদলের দুটো নাট্যপ্রযোজনার মাধ্যমে চট্টগ্রামে শুরু হয় শহরকেন্দ্রিক গ্রুপ থিয়েটারের যাত্রা। এদিন চট্টগ্রাম ক্লাব মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হয় জহির রায়হানের গল্প ম্যাসাকার এবং মমতাজউদদীন আহমদের স্পার্টাকাস বিষয়ক জটিলতা। প্রথম নাটকের নির্দেশক জিয়া হায়দার, দ্বিতীয়টির মমতাজ উদদীন আহমদ।বছর কয়েকের মধ্যে তির্যক, অরিন্দম, নান্দিকার, গণায়ন, লোকালয়, ধ্রুপদী, অঙ্গন, দেশকাল, রূপকারের মতো বেশ কয়েকটি নাট্যদলের আবির্ভাব হলো। তাদের পথচলাটা খুব একটা মসৃণ ছিল না। মঞ্চ, মঞ্চসজ্জা ও আলোকসম্পাতের সরঞ্জামসহ নাটক প্রযোজনায় প্রয়োজনীয় সবকিছুর অভাব ছিল। তখন যেসব মঞ্চে নাটক হতো, সেগুলো ঠিক নাটক মঞ্চায়নের জন্য তৈরি হয়নি। এত দৈন্যের মধ্যে যেটুকু সম্পদ ছিল তা হলো, সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটা দেশের তরুণদের উদ্যম, স্বপ্ন, সৃজনশীল নতুন কিছু একটা করার প্রেরণা। সেই প্রেরণাই চট্টগ্রামের থিয়েটারকে ৫০ বছর ধরে এগিয়ে নিয়ে গেছে। এই অর্ধশতাব্দীকালের একটা দীর্ঘ যাত্রায় সাফল্য আর ব্যর্থতা যা–ই থাকুক না কেন, একটা চর্চাকে এভাবে নিয়মিতভাবে টিকিয়ে রাখাটাই বড় অর্জন।সত্তর, আশি, এমনকি নব্বইয়ের দশকে যেসব সীমাবদ্ধতা ছিল, আজকের নবীন প্রজন্মের থিয়েটারকর্মী সেসব কল্পনাও করতে পারবেন না। শব্দ, আলোক নিয়ন্ত্রণের আধুনিক ব্যবস্থাসহ একাধিক মিলনায়তনে এখন নিয়মিত নাটক হয়। এতে জড়িত আছেন শত শত নাট্যকর্মী।
আধুনিক সুযোগ–সুবিধাসংবলিত নতুন নতুন মিলনায়তন হচ্ছে। এই প্রাপ্তি শুরুর দিকের কর্মীদের দীর্ঘ সংগ্রাম আর ত্যাগের ফসল।বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সদস্য হিসেবে চট্টগ্রামে নিয়মিত নাটক করছে ২৭টি দল। সদস্য নয়, এমন নাটকের দলের তালিকা বেশ দীর্ঘ।
নাটকের কাগজ নাট্যমঞ্চে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে চট্টগ্রামের ৭৯টি নাটকের দলের তালিকা দিয়েছে। সত্তরের দশকের নাটকপাগল কিছু তরুণ নাওয়া–খাওয়া ভুলে নাটককেই জীবন মনে করেছিলেন বলেই আজ এত দূর আসা সম্ভব হয়েছে। চট্টগ্রামের প্রবীণ নাট্যজন অঙ্গন থিয়েটার ইউনিটের সনজীব বড়ুয়া বললেন, ৫০ বছরের দীর্ঘ যাত্রায় চট্টগ্রামের প্রথম সাফল্য যায় দিন, ফাগুন দিন। এই পথনাটকে একুশে পদকপ্রাপ্ত ঢোলবাদক বিনয়বাঁশী ঢোল বাজিয়েছেন। গায়েনের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন নাট্যজন ও গায়ক শান্তনু বিশ্বাস। তাঁরা দুজনই আজ প্রয়াত। কিন্তু শান্তনুর গানের সুর আর বিনয়বাঁশীর ঢোল এখনো বুকে ধুকপুকের মতো বাজে।চট্টগ্রামের অরিন্দম নাট্যসম্প্রদায়ের একসময়ের দলনায়ক শিশির দত্ত জানান প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির নানা কথা, ‘অনেক কাজ চট্টগ্রামের নাটকের দলগুলো করেছে। তারা শুধু নিজেদের নাটক নিয়ে ব্যস্ত থাকেনি। দর্শকের রুচি পরিবর্তন করতে, দর্শকদের কাছে টানতে প্রতিবছর বিভিন্ন মৌসুমে নানা উৎসবের আয়োজন করে আসছে। ঢাকা, কলকাতাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকা থেকে বিখ্যাত সব নাটকের দল এই চট্টগ্রামের মঞ্চে নাটক করে গেছে আমাদেরই উদ্যোগে।’
শিশির দত্ত বলেন, ‘বলতে গেলে বাংলা ও বিশ্ব নাট্যসাহিত্যের সেরা সব নাটক চট্টগ্রামের নাটকের দলগুলোর প্রযোজনায় মঞ্চস্থ হয়েছে। নাটকপ্রেমী মানুষ এই চট্টগ্রামেই উপভোগ করেছেন শেক্সপিয়ার, ব্রেখট, ওলে সোয়েঙ্কা, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ, জাঁ পল সার্ত্রে, জে এম সিঞ্জ, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর নাটক।
তবে কিছু কিছু ব্যর্থতার কথাও বলেন শিশির দত্ত, ‘এই দীর্ঘ ৫০ বছরে আমরা তেমন মৌলিক নাটক দিতে পারিনি। সৃষ্টি করতে পারিনি নিজস্ব কোনো বৈশিষ্ট্য।’একুশে পদকপ্রাপ্ত নাট্যজন অভিনেতা আহমেদ ইকবাল হায়দারের কথায়ও আক্ষেপের সুর, ‘আমরা আসলে দর্শকের কাছে যেতে পারিনি। ৫০ বছরে জনসংখ্যা যত বেড়েছে, সে তুলনায় থিয়েটারের দর্শক বাড়েনি। তা ছাড়া আমরা পেশাদারত্বটা আয়ত্ত করতে পারিনি।’
আশায়, নিরাশায়, হতাশায় আর সাফল্যে ৫০ বছর পার করেও এখনো মুখর চট্টগ্রামের নাট্যাঙ্গন। নাটকের পত্রিকা নাট্যমঞ্চের সম্পাদক জাহেদুল আলম জানান, চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমিভিত্তিক এবং চট্টগ্রাম গ্রুপ থিয়েটার ফোরামভুক্ত তির্যক নাট্য গোষ্ঠী, অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায়, গণায়ন নাট্য সম্প্রদায়, অঙ্গন থিয়েটার ইউনিট, প্রতিনিধি নাট্য সম্প্রদায়, থিয়েটার ওয়ার্কশপ চট্টগ্রাম, কালপুরুষ, সমীকরণ থিয়েটার, নান্দীমুখ, কথক থিয়েটার, শব্দ নাট্যচর্চা কেন্দ্র (এখন ঢাকায়), এ্যাঁভাগার্ড, উত্তরাধিকার, নাট্যাধার, লোক থিয়েটার নাটক করে।
আমরা আসলে দর্শকের কাছে যেতে পারিনি। ৫০ বছরে জনসংখ্যা যত বেড়েছে, সে তুলনায় থিয়েটারের দর্শক বাড়েনি। তা ছাড়া আমরা পেশাদারত্বটা আয়ত্ত করতে পারিনি
তা ছাড়া তির্যক নাট্য দল, নান্দিকার, কথক নাট্য সম্প্রদায়, মঞ্চমুকুট নাট্য সম্প্রদায়, চট্টল থিয়েটার, চট্টগ্রাম থিয়েটার, অনন্য থিয়েটার এবং উচ্চারণ সারা বছর মুখর করে রাখে টিআইসি (থিয়েটার ইনস্টিটিউট চট্টগ্রাম) প্রাঙ্গণ। কোনো নাট্যমোর্চা, ফোরাম কিংবা ঋতুভিত্তিক নাট্যমেলার অন্তর্ভুক্ত না হয়েও নিয়মিতি নাটক করে যাচ্ছে প্রতিভাস, ফেইম স্কুল অব ড্যান্স, একাডেমি অব পারফরমিং আর্টস, থিয়েটার জয় বাংলা, নাট্যমঞ্চ রেপার্টরি, স্কেচ গ্যালারি, প্রসেনিয়াম, নাট্যাহিত, আমরা পলাশ এবং বিনোদিনী।থিয়েটার কোনো একার সাধনা নয়, এটা আমাদের আদি সমাজের সংস্কৃতির মতো—যূথবদ্ধ মানুষের কর্মযজ্ঞ। তাঁদের সংগ্রাম, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম। এর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সহস্র রকমের সীমাবদ্ধতা, শত শত বাধার ভেতর যূথবদ্ধতা, ঐক্য টিকিয়ে রাখা। একা একা থিয়েটার হয় না বলেই দল চালাতে হয়। আমাদের মতো সমাজে থিয়েটারের দল মানে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সাগরে ভাসমান একেকটি জাহাজ। সেসব জাহাজ প্রতিকূলে যেতে যেতে একদিন নিশ্চয়ই পেয়ে যাবে দারুচিনি দ্বীপের সন্ধান।