সুরে-তালে-গতে বাঁধা আবহমান বাংলার মন-কেমনের কাব্য

‘পুণ্যাহ’, নাটকের দৃশ্যছবি: সংগৃহীত

অধুনা আমেরিকাপ্রবাসী বদরুজ্জামান আলমগীর এক বিস্ময়কর নাট্যকার। ঘরানার হিসাব কষলে সেলিম আল দীনের পত্তন করা জাহাঙ্গীরনগর ঘরানায় তাঁর অধিষ্ঠান। বর্ণনাত্মক রীতির তিনি অনুসারী। মৃত্তিকাসংলগ্ন অথচ গজদন্তমিনার বিলাসী। তা বলে নিজস্বতার খামতি নেই তাঁর। গ্রামবাংলার সমন্বয়ী জীবনের যে লোকায়ত ধারা, সেটি বদরুজ্জামানের করায়ত্ত। ইতিপূর্বে বাংলাদেশের মাটিতে কয়েকটি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে তাঁর। কমবেশি সাড়া ফেলেছে। বড়সড় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ওপর মরমি দৃষ্টিপাত করে জাদুবাস্তবতার মোড়কে নাট্যবস্তু পেশ করার যে ঝোঁক সেলিমের শেষ দিকের নাটকের বৈশিষ্ট্য, সেটিকে উপাত্ত করে হাল আমলে ‘পুণ্যাহ’ লিখেছেন বদরুজ্জামান। সেটি মঞ্চে এসেছে ‘জাহাঙ্গীরনগর’ ঘরানার খাস ওস্তাদ ইউসুফ হাসান অর্কর নির্দেশনাগুণে।
‘পুণ্যাহ’, অর্থাৎ পবিত্র দিন। খোলা ছাড়িয়ে খোসা ফেলে বাদামের আসল চেহারা যেমন দেখা যায়, সেভাবেই পৌঁছানো যায় ‘পুণ্যাহ’র মর্মমূলে। কাব্য-গদ্যের আল ধরে চলা এমন নাটক যে পড়ার জন্য উপাদেয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ঢাকার খানদানি নাটকের দল নাট্যকেন্দ্র দেখিয়ে দিল ‘পুণ্যাহ’ আমাদের প্রসেনিয়াম থিয়েটারের দেওয়ান-ই-খাসেও দাগ কেটে যেতে পারে।

ইউসুফ হাসান অর্কর নির্দেশনায় ‘পুণ্যাহ’ আত্মপ্রকাশ করেছে মাস পাঁচেক আগে। বেশ কয়েক বছর ঝিমিয়ে থাকার পর নাট্যকেন্দ্রের এই পঞ্চদশ প্রযোজনা চমকে দিয়েছে ঢাকার রঙ্গমঞ্চকে। অবাক হলো কলকাতাও। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ‘পুণ্যাহ’ মঞ্চস্থ হলো কালীঘাটের তপন থিয়েটারে, অনীকের ২৫তম গঙ্গা-যমুনা উৎসবের মঞ্চে। বুকঝিম এক ভালোবাসা নিয়ে ঘরে ফিরলেন পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহের নাট্যমোদীরা।
‘পুণ্যাহ’ এমন এক প্রযোজনা, যেখানে বিষয় আর আঙ্গিক হাত ধরাধরি করে চলে, কনটেন্ট আর ফর্মের এমন মিলমিশ ঘটে যে আলাদা করা দায়। তবু ক্ষীণতোয়া এক কাহিনিসূত্র থেকেই যায়। প্রযোজনা পুস্তিকায় দেখি—‘গল্পটি সত্য ঘটনা নয়, তবে সত্যমূলক।

গত ১৯ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ‘পুণ্যাহ’ মঞ্চস্থ হলো কালীঘাটের তপন থিয়েটারে, অনীকের ২৫তম গঙ্গা-যমুনা উৎসবের মঞ্চে

কাকরগাছি নামের একটি গ্রামে হঠাৎ একদিন ভয়াবহ ঝড় হয়েছিল। সেই ঝড়ে গ্রামটি মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়।’ কেন এমন হলো? কোনো ভৌগোলিক কারণ না খুঁজে ঘোড়াউত্রা নদীর ধারে কাকরগাছির লোকজন বসল পাপ–পুণ্যের খতিয়ান নিয়ে। কার পাপে? ডাইনি খোঁজার মতো করে তালাশ চলল। ইন্ধন জোগালেন মৌলভি খাইরুল বাশার (ঝুনা চৌধুরী)। বরাত খারাপ থাকায় গুনেগার হলেন আম্বিয়া (মনামী ইসলাম কনক), ঝড়ের কিছুদিন আগেই ঘরনি হয়ে কাকরগাছিতে পা পড়েছে যার। দিন যায়।

আম্বিয়ার ওপর চাপ বাড়ে। মরদের সঙ্গে ‘বাংলাদেশের অর্ধেকটার সমান ঢাকা শহরে’ পালাতে চান আম্বিয়া। উপায় হয় না। একা ক্রমে একা হয়ে শেষমেশ চাঁপাকলার পাতায় বসে বিষ খেয়ে মরেন। ‘নির্লিপ্ত মহাকালের নিচে একবিন্দু আম্বিয়া অপমানে কাতরায়’।
এতকাল ইউরোপিয়ান ড্রামাটার্জিতে মগ্ন থেকে নাটক করেছে নাট্যকেন্দ্র। মলিয়ের থেকে গোলদোনির কমেডি নিয়ে হুলুস্থুল করেছে। বছর সাতেক আগে তাদের দেখেছি মিসরের নাটকের হদিশ খুঁজতে। ‘পুণ্যাহ’তে একেবারে ভোল পাল্টে ফেলেছে তারা। মাটি ও মানুষের কাছাকাছি থাকা যে আখ্যানবস্তু নিয়ে কতক ঐতিহ্যবাহী আর কতক বর্ণনাত্মক একটি নাট্যভাষ গড়ে উঠেছে বাংলাদেশে—বিশেষ করে জাহাঙ্গীরনগর ঘরানার প্রভাবে—তার স্রোতে গা ভাসিয়ে এ নতুন প্রযোজনার উপস্থাপনা।
নাট্যকেন্দ্রের ঘরের ছেলে তথা জাহাঙ্গীরনগরের অধ্যাপক অর্ক ‘পুণ্যাহ’র নির্দেশক হওয়ায় রূপান্তরটি বেশ জমকালো হয়েছে। অর্ক একাধারে নির্দেশক ও সংগীতকার। গত এক দশকে পোড় খেয়েছেন। নিরীক্ষাধর্মী কাজে হাত পাকিয়েছেন। ‘পুণ্যাহ’র হালকা মঞ্চস্থাপত্য তাঁরই হাতযশ। এমনকি আপস্টেজের সীমানা বরাবর গাইয়ে-বাজিয়েদের বসিয়ে হারমোনিয়াম-হাতে মধ্যমণিও তিনি। প্রযোজনার ঘাড়ে নির্দেশকের লাগাম এমন জোরদার হলে যে সুচারু নাট্যনির্মাণ সম্ভব, তার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করছে ‘পুণ্যাহ’।

ইউসুফ হাসান অর্কর নির্দেশনায় ‘পুণ্যাহ’ আত্মপ্রকাশ করেছে মাস পাঁচেক আগে

বদরুজ্জামানের লেখায় বর্ণনা আর সংলাপ মিলেমিশে থাকে। মুহুর্মুহু তৈরি হতে থাকে ছবির পর ছবি। এ চিত্রল রচনাকে বাঁধবার জন্য গীতল একটি প্রকরণ আমদানি করলেন অর্ক। সুরের ভাঁজে, নাচের ছাঁদে একেবারে বেঁধে দিলেন কুশীলবদের প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি উচ্চারণ। এ নিটোল বাঁধুনি মাথায় রেখেই ডানা মেলল অম্লান বিশ্বাসের আলোক পরিকল্পনা। এতই অনুপুঙ্খ সে পরিকল্পনা যে কয়েক লহমার উনিশ-বিশে মাঠে মারা যেতে পারে অনেক দ্যোতক নাট্যমুহূর্ত।


নাটক শুরু হতেই মঞ্চমায়ায় মজলাম আমরা। খন্দকার সাজিয়া আফরিন প্যাস্টেল শেডের কাপড়জামা পরালেন কুশীলবদের। প্রান্তিক দেবের নৃত্যনির্মাণ আলোর স্রোতের পাল তোলা হাজার প্রজাপতিকে প্রসেনিয়াম জুড়ে নেচে বেড়ানোর জায়গা করে দিল। কথক ও নর্তক একাকার হয়ে গেলে সংগীতা চৌধুরীর দিঘল গড়ন এক আচ্ছন্নতা বুনে দিল। সূত্রধারের ভূমিকায় পাওয়া গেল হাবিব মাসুদকে। নাটক গড়াতে লাগল চড়াই–উতরাই বেয়ে। সেকাল-একালের আনাগোনা চলল অহরহ। যৎসামান্য প্রপস কাজে লাগিয়ে ঘুড়ি ওড়ানোর মতো ছোটখাটো অথচ রংচঙে নাট্যমুহূর্ত রচনা করে চললেন অর্ক। কখনো চমকে দিয়ে প্রজেকশন স্ক্রিন হয়ে উঠল সাইক্লোরামা। সাদা-কালোয় বীভৎসতার আঁকিবুঁকি কাটা হলো। বিপদ যত ঘনাল, তত লৌকিক সংস্কারের গণ্ডির মধ্যে সেঁধিয়ে গেল নাটক। কবিরাজের হাতে উঠে এল ঝড়ের কোপে পড়া গরুর কাটা মুণ্ডু। সাইক্লোরামায় ভেসে ওঠা পূর্ণিমার চাঁদের সামনে হাতে-ধরা ওই মুণ্ডু এক আধিভৌতিক আবহাওয়া তৈরি করল নাটকের শেষ দিকে।

অংশুমান ভৌমিক
ছবি: সংগৃহীত

নাট্যকেন্দ্রের কুশীলবকুল বাচিক অভিনয়ে সিদ্ধ। আঙ্গিক অভিনয়ে তাঁদের পটুতা এবারে নজরে এল। আম্বিয়া নামটির সঙ্গে আমাদের ভাব করিয়েছিলেন সৈয়দ শামসুল হক, ‘নূরলদীনের সারাজীবনে’। অপূর্ণতা, অচরিতার্থতার সমনামী হয়ে উঠেছিলেন সেই আম্বিয়া। ‘পুণ্যাহ’র আম্বিয়ার মধ্যে ওই আদিকল্পের আদল বুনে দিলেন অভিনেত্রী কনক। চোখের তারায় বিষণ্ণতা সেচে একটু একটু করে বিষাদপ্রতিমা হয়ে উঠলেন। আটপৌরে গড়নের এ অভিনেত্রী আরও পোড় খেলে আরও স্তরীভূত চরিত্রায়ণ পাব আমরা।


নাটকের তুঙ্গ মুহূর্তগুলোতে অর্কর দরাজ গলা সুরে বেঁধে গেয়ে উঠল ‘পুণ্যাহ’। শুরুর দিককার উচ্ছ্বাস ক্রমে মিলল হাহাকারের রবে। সব মিলিয়ে একটি আকর্ষণীয় নাট্যনির্মাণকে তারিফ করে মিলনায়তন থেকে বেরোলাম আমরা। নিরীক্ষাধর্মী নাটকও যে দর্শককে চুম্বকের মতো টেনে রাখতে পারে, এমন প্রযোজনা তার প্রমাণ। ১০৫ মিনিট কোথা দিয়ে চলে গেল ঠাহর হলো না।

দুটি মুশকিলের কথা বলি। প্রসেনিয়াম থিয়েটারের মঞ্চমায়ায় এমন নাটককে সাজানো-গোছানো হলে একটি কলাকৈবল্যবাদী চেহারা ফুটে ওঠার সম্ভাবনা থাকে, যাতে শ্রমকিণাঙ্ক মিলিয়ে যায়। কথার পরে কথা সাজিয়ে যে শব্দচিত্র রচনা হয়, তাতে কৌমজীবনের দিনগুজরানের ছবি আবছা হয়ে যায়। ‘পুণ্যাহ’ এই ঘেরাটোপে আটকেছে। আরেকটি মুশকিল বিষয়গত। এক দিকে পুরুষতন্ত্র অন্য দিকে লোকধর্মের কারবারিদের কায়েমি স্বার্থ, এই জোড়াফলায় নারীর স্বাধিকারের প্রশ্ন যে উহ্য থেকে যায়, সে কথা নাগরিক নাটমঞ্চে এসে বড় মুখ করে বলার মধ্যে আত্মসমীক্ষার একটি অনুচ্চকিত আহ্বান থাকা বাঞ্ছনীয়। আম্বিয়ার জন্য আমাদের প্রাণ না কাঁদলে এবং পাশাপাশি ঢাকাই আদব–কায়দার আড়ালে ঘাপটি মেরে থাকা কেয়ামতের নিশির ডাক না চেনালে ‘পুণ্যাহ’র সমাজমনস্কতা উহ্য থেকে যায়। পুণ্যের ধুয়ো তুলে পাপের খবরদারি চাপা পড়ে যায়। বদরুজ্জামানের লেখায় এই ইশারা ছিল, অর্কর নির্মাণে সেটি প্রকট হওয়ার ছিল। ষোলোকলা পূর্ণ হলো না বলে আমাদের একটু আফসোস রয়ে যাচ্ছে।