সময়ের প্রয়োজনে বদলানো দরকার: মহসিনা আক্তার
আগামীকাল নতুন আরেকটি নাটক নিয়ে আসছে ‘স্পর্ধা: ইনডিপেনডেন্ট থিয়েটার কালেকটিভ’। ‘তবুও জেগে উঠি’ নামের নাটকটির নির্দেশক মহসিনা আক্তার।
ছাঁচেঢালা ইতিহাসে কীভাবে নারীকে উপস্থাপন করা হয়, ‘স্টিল আই রাইজ’ কবিতায় তা-ই তুলে ধরেছেন মার্কিন কবি মায়া অ্যাঞ্জেলো। এই কবিতায় নিজেকে খুঁজে ফিরেছেন বহু নারী; দীর্ঘশ্বাসের পথ পেরিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর মন্ত্র পেয়েছেন কেউ কেউ।
কবিতাটির নাম থেকে মহসিনা আক্তারও পেয়েছেন অনুপ্রেরণা। সেই অনুপ্রেরণার ওপর ভর করে প্রায় এক দশক পর নির্দেশনায় ফিরছেন তিনি। এই সময়ে নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিবাদে ‘তবুও জেগে উঠি’ নিয়ে মঞ্চে আসছেন এই নির্দেশক।
গতকাল স্পর্ধা: ইনডিপেনডেন্ট থিয়েটার কালেকটিভ জানিয়েছে, আগামীকাল ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের মীর তাজ স্কয়ারে নাটকটির দুটি প্রদর্শনী হবে। প্রথমটি রাত ৮টায় আর রাত ১০টায় দ্বিতীয় প্রদর্শনী।
মাসখানেক আগে নাটকটির পরিকল্পনা করে স্পর্ধা। ঢাকার বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ পার্কসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় নাটকের মহড়া হয়েছে।
নাটকটির পটভূমি বিষয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে স্পর্ধা লিখেছে, ‘সংকটের সময় নারীকে ব্যবহার করা এবং সংকট পেরিয়ে গেলে নারীর রিপ্রেজেন্টেশন মুছে ফেলা হয়। এক বিপ্লবোত্তর আশার বাংলাদেশে আবারও তার অভিজ্ঞতা আমাদের হচ্ছে। যে হাতে হাত মিলিয়ে আমরা এগিয়েছিলাম, সেই হাত এখন নির্দেশ করে নারী কী করবে; সমাজের নারীর অবস্থান ঠিক করে দেওয়া হচ্ছে।’
এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের নীরবতার প্রতি আঙুল তুলে স্পর্ধা বলছে, ‘আমরা মনে করি, ইতিহাস, সভ্যতা কখনোই আমাদের পক্ষে ছিল না। লড়াই আমাদের রক্তে, স্বাধীনতা আমাদের আত্মায়। তাই আমরা কালো হাতের থাবার ভয় না করে আবার জেগে উঠি।’
নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিবাদ করতে শিল্পের শরণ নিয়েছেন মহসিনা। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন একদল তরুণ।
নাটক নিয়ে আমাদের মানুষের কাছে যেতে হবে।
নাটক যাবে দর্শকের কাছে
ছয় বছরের পথচলায় বরাবরই নিরীক্ষাধর্মী কাজ করছে স্পর্ধা। ২০২১ সালে ডানকান ম্যাকমিলান ও জনি ডোনাহো রচিত ও সৈয়দ জামিল আহমেদ নির্দেশিত ‘বিস্ময়কর সবকিছু’ নাটকে অভিনয় করেন মহসিনা। মঞ্চের গণ্ডি পেরিয়ে নাটকটি দর্শকের কাছে ছড়িয়ে পড়েছিল।
‘বিস্ময়কর সবকিছু’র সঙ্গে ‘তবুও জেগে উঠি’র তেমন মিল থাকবে না; তবে প্রদর্শনের ধরনে খানিকটা মিল থাকবে। সীমিত পরিসরেই প্রদর্শিত হবে তবুও জেগে উঠি। তবে ‘বিস্ময়কর সবকিছু’ যেখানে শুধু ইনডোরে প্রদর্শিত হয়েছে, সেখানে ৪৫ মিনিট দৈর্ঘ্যের ‘তবুও জেগে উঠি’ পার্কসহ খোলা জায়গায়ও প্রদর্শনের পরিকল্পনা করেছে স্পর্ধা।
গতকাল নাট্যদলটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মহসিনা আক্তার বললেন, ‘পারফর্মিং আর্টের ক্ষেত্রে স্পেসটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পারফর্মার চরিত্র হয়ে উঠছেন না—চরিত্র ও ব্যক্তির মাঝামাঝি থাকছেন। আমরা আমাদের কথা বলছে চাই। সেটা কখনো কাল্পনিক ভুবন তৈরি করে, কাল্পনিক চরিত্রের মাধ্যমে, আবার কখনো বাস্তবে দাঁড়িয়ে। নাটক নিয়ে আমাদের মানুষের কাছে যেতে হবে। যতটা সম্ভব মিনিমাল উপকরণ রাখার চেষ্টা করছি। অভিনয়ের ওপর অধিক জোর দিচ্ছি।’
বলা হচ্ছে, ‘তবুও জেগে উঠি’ হচ্ছে সিরিজ নাটকের একটি; বিষয়ভিত্তিক আরও নাটক করা হবে। এর মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষেরাও কতটা চাপে থাকেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন বিষয়ে নাটক করবে দলটি।
খুব বেশি উপকরণ ছাড়াই বাহুল্যবর্জিত নাটক করার ক্ষেত্রে স্পর্ধার আলাদা পরিচিতি রয়েছে। এই জাদুটা কোথায়? ‘বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য, নাটকের স্টাইল অনুযায়ী যা প্রয়োজন তাই করি। যদি অল্প কিছুতে স্টাইল ঠিক রেখে বক্তব্য তীব্রভাবে দর্শককে আঘাত করে, তবে আমার বাহুল্যের দরকার কী?’
উদাহরণ টেনে মহসিনা বললেন, ‘চোখে চোখ রেখে হাত ধরে বলা যায়, “আমি তোমাকে ভালোবাসি”, আবার মহা আয়োজন করে লোক ডেকে, বেলুন উড়িয়েও বলা যায়। কোনটা বেছে নেব, তা আমার বিষয়বস্তুর পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে। আমি নানা উপকরণ দিয়ে মঞ্চে দৃশ্য তৈরি করতে যেমন পছন্দ করি, তেমনি নিরাভরণ সত্য ও বিশ্বাস দ্বারা নির্মিত শিল্পকর্মও আমাকে প্রচণ্ডভাবে টানে।’
আমি নানা উপকরণ দিয়ে মঞ্চে দৃশ্য তৈরি করতে যেমন পছন্দ করি, তেমনি নিরাভরণ সত্য ও বিশ্বাস দ্বারা নির্মিত শিল্পকর্মও আমাকে প্রচণ্ডভাবে টানে।
সৈয়দ জামিল আহমেদ নির্দেশিত ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’, ‘৪.৪৮ মন্ত্রাস’, ‘বিস্ময়কর সবকিছু’ ও ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ নাটকে অভিনয় করে খ্যাতি পেয়েছেন মহসিনা। আগেও নাটক নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। সর্বশেষ ২০১৪ সালে নির্দেশনা দেন শহীদুল জহিরের ‘ইন্দুর-বিলাই খেল’।
সময়ের প্রয়োজনে বদলানো দরকার
২০১৭ সালে সৈয়দ জামিল আহমেদ নির্দেশিত ‘রিজওয়ান’ নাটকে ফাতিমা চরিত্রে অভিনয় করে পরিচিতি পান মহসিনা। পরের বছর ২০১৮ সালে সৈয়দ জামিল আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘স্পর্ধা: ইনডিপেনডেন্ট থিয়েটার কালেকটিভ’। শুরু থেকেই নাট্যদলটির সঙ্গে রয়েছেন মহসিনা।
সৈয়দ জামিল আহমেদ নির্দেশিত ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’, ‘৪.৪৮ মন্ত্রাস’, ‘বিস্ময়কর সবকিছু’ ও ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ নাটকে অভিনয় করে খ্যাতি পেয়েছেন মহসিনা। আগেও নাটক নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। সর্বশেষ ২০১৪ সালে নির্দেশনা দেন শহীদুল জহিরের ‘ইন্দুর-বিলাই খেল’।
ছয় বছরের পথচলায় স্পর্ধার নাটকের ধারায় দৃশ্যত পরিবর্তন ঘটেছে। বিষয়টি নিয়ে মহসিনার ভাষ্যে, ‘জীবন পরিবর্তনশীল। সামনে এগিয়ে যেতে চাইলে পথ বদলাতে হয়। সময়ের প্রয়োজনে বদলানো দরকার। কোথাও স্থির থাকলে নতুন পথ পাওয়া যায় না। নাট্যকর্মী হিসেবে কত দূর ঝাঁপ দেব, সেটা সময়ই বলে দেয়। আমি শুধু সেই ঝাঁপটা দিতে প্রস্তুত থাকি।’
স্পর্ধা নিয়েই কাজ করব
অভিনয়, নির্দেশনা, মঞ্চ পরিকল্পনা, পোশাক পরিকল্পনা থেকে আলোক পরিকল্পনা—সবখানেই রয়েছেন মহসিনা। কোন পরিচয়টাকে সামনে রাখতে চান, এমন প্রশ্নের জবাবে বললেন, ‘আমার প্রথম প্রায়োরিটি থিয়েটার। মঞ্চের বাইরে হোক কিংবা সামনে, দুই মাধ্যমেই কাজ করতে চাই। স্পর্ধা নিয়েই এখন বেশি কাজ করব। যা যা নিজে জেনেছি, নাটক বিষয়ে আমার দেশে–বিদেশে ট্রেনিংয়ের যে অভিজ্ঞতা, নতুন নাট্যকর্মীদের মধ্যে তা ছড়িয়ে দেব। নতুন বাংলাদেশে এটাই ছিল জীবন নিয়ে আমার প্রথম সিদ্ধান্ত। স্পর্ধা থেকে একাডেমি করতে চাই। কয়েক মাসের ভেতরেই এর যাত্রা শুরু করছি।’
‘তবুও জেগে উঠি’ নাটকে অভিনয় করেছেন শারমিন আক্তার শর্মী, সিফাত নওরীণ বহ্নি, ফারিহা জান্নাত মিম, মরিয়ম রূপা, নাইমা তাসনিম, রিয়াসাত সালেকিন ঋত্বিক, সাইফুল ইসলাম, রবি প্রারম্ভ, সালাউদ্দিন ইভান, মেহেদী হাসান সোহান।
নির্দেশনা সহযোগী হিসেবে আছেন শাহানাজ পারভীন জোনাকি। শব্দ পরিকল্পনা করেছেন অনিরুদ্ধ অনু ও মৈনাক কানুনগো।
মিউজিশিয়ান হিসেবে থাকছেন আশফাকুর রহমান চমক, ব্যাকস্টেজে তানভীর আহমেদ, ইরফান উদ্দিন। আলোকচিত্রী হিসেবে আছেন সাদিয়া আফরিন অরণি, পূজন চন্দ্র বিশ্বাস।