'লালু ভুলু' দিয়ে শুরু 'নোলকে' শেষ রাজমণির যাত্রা
একে একে নিভেছে দেশের সিনেমা হলগুলোর বাতি। সে তালিকার সর্বশেষ যোগ হলো ‘ফিল্মপাড়া’খ্যাত কাকরাইলের রাজমণি সিনেমা হলটি। শেষ হলো রাজমণির যাত্রা। ১২ অক্টোবর শাকিব–ববির জুটির ‘নোলক’ ছবির প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে থেমে গেল রাজমণির কার্যক্রম। এখানে ২২তলা বাণিজ্যিক ভবন হবে। মালিক সেখানে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের কোনো জায়গা রাখবেন না।
গতকাল রোববার বিকেলে মন ভার করে হলের গেটে দাঁড়িয়ে ছিলেন সাত্তার কাজী। তরুণ বয়সে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন রাজমণি সিনেমা হলের চাকরি দিয়ে। ৬০ পেরোনো জীবনের ৩৭টি বছর কাটিয়েছেন এখানে, কাকরাইলের রাজমণি সিনেমা হলে। এত বছরে অন্য কোথাও যাননি, কোনো কাজ শেখেননি। সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাওয়াতে বিষণ্নতা তাঁর চোখেমুখে। কী করবেন ভবিষ্যতে, জানা নেই। মনকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বললেন, ‘আসলে মালিকের কিছু করার নেই। বছরের পর বছর লস দিয়া হল চালাইতাছেন। আর কত!’
ভেতরে ঢুকে দেখা গেল মিলনায়তন অন্ধকার। বারান্দায় জ্বালানো বাতির আলোতে জীর্ণ আসনগুলোর অসহায় অবস্থান। এক দিনেই যেন ময়লা জমে গেছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে কোনো দিন এমন ঘটনা ঘটেনি। ওপরে প্রজেকশন রুমের যন্ত্রপাতিগুলো খুলে নেওয়া হয়েছে। কয়েকজন শ্রমিক কাঁধে করে সার্ভার, সাউন্ড বক্সসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নামিয়ে রাস্তায় নিচ্ছেন। সেখানে ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে ওই মাল বহনের জন্য।
রাজমণি হলের বাইরের একটি অংশে প্রতিষ্ঠানের একটি অফিস কক্ষ। সেখানে দেখা হলো উদ্যোক্তা, চলচ্চিত্র নির্মাতা আহসান উল্লাহ মণির সঙ্গে। প্রস্তাবিত ভবনের নকশা সেখানে রাখা। আহসান উল্লাহ মণি জানান, রাজমণি হল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৩ সালের ৩ মার্চ। কামাল আহমেদ পরিচালিত ‘লালু ভুলু’ ছবির প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে চালু হয়েছিল এই হল। শেষ হলো শাকিব খানের নোলক দিয়ে। শুরু হয়েছিল রমরমা বাজার দিয়ে। শেষ হলো চরম মন্দায়। আহসান উল্লাহ মণি বললেন, ‘আমরা ঢাকার এমন একটি ব্যস্ত এলাকায় ব্যবসা চালাতে পারিনি শুধু ছবির অভাবে। দেশের ছবি নেই, কলকাতা থেকে যেসব ছবি আসে, সেগুলোও চলেনি। ভাষা, সংস্কৃতি ও পোশাকে মিল না থাকার কারণে এখানে অন্য দেশের ছবি বাজার পাবে না।’ তাঁর আশঙ্কা, আগামী এক বছরে দেশের সব সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাবে।
ছবির ব্যবসায় প্রায় ৫০ বছর ধরে যুক্ত আহসান উল্লাহ। বাবা সরাফত উল্লাহ ভূঁইয়া ছিলেন সোনারগাঁ এলাকার স্কুলশিক্ষক। চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও পরিচালনা করেছেন সত্তরের দশক থেকে। ভাবলেন এমন এক জায়গায় প্রেক্ষাগৃহ বানাবেন, যেটা হবে রাজধানীর কেন্দ্রে। তখন কাকরাইল ছিল এ রকম একটি জায়গা। স্ত্রী রাজিয়া এবং নিজের নামের অংশ যুক্ত করে ‘রাজমণি’ হলের নামকরণ করা হয়। পরে রাজিয়া নামে আরেকটি ছোট প্রেক্ষাগৃহ চালু হয় একই ভবনে।
২৪ কাঠা জায়গার ওপর তৈরি ভবনের কয়েকটি তলায় গড়ে ওঠে বিভিন্ন চলচ্চিত্র প্রযোজক, পরিবেশক প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়। ১৯৮৪ সালে রাজমণি ভবনে এ রকম ৪০টি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় ছিল। তখন থেকেই এলাকাটি ‘ফিল্মপাড়া’ হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করে। স্বাধীনতার আগে ঢাকাই ছবির ব্যবসা মূলত ছিল ইসলামপুর, ওয়াইজঘাট ও নবাবপুরকে ঘিরে। একসময় ছবি ব্যবসার যাবতীয় কার্যক্রম চলে আসে গুলিস্তানে। আশির দশকের আগেও ঢাকার ‘ফিল্মপাড়া’ ছিল গুলিস্তানকেন্দ্রিক। এরপর তা কাকরাইলে সরে আসে, রাজমণি হলের ভবনটি হয় ফিল্মপাড়ার কেন্দ্র। আশপাশের ভবনগুলোতেও চলচ্চিত্রবিষয়ক নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।
কয়েক বছর আগেও রাজমণি সিনেমা হল শুধু একটি সিনেমা হলই ছিল না, ছিল ছোটখাটো একটি চলচ্চিত্র নগরীর মতো। ভবনের ভেতরে ছিল রেকর্ডিং স্টুডিও, চিত্র ধারণের স্থান (শুটিং স্পট), ডাবিং স্টুডিও, এডিটিং প্যানেল থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র নির্মাণের নানান কারিগরি প্রতিষ্ঠান। এখন সবই ইতিহাস। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির উপদেষ্টা মিঞা আলাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সারা দেশে সিনেমা হল ছিল ১ হাজার ৪৩৫টি। কমতে কমতে গত ঈদে আড়াই শর কম সিনেমা হলে ছবি চলেছে। পাশাপাশি বন্ধ হচ্ছে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানও।
প্রস্তাবিত ভবনে কোনো রকমের সিনেপ্লেক্স বা চলচ্চিত্র প্রদর্শনের কোনো ব্যবস্থা থাকবে না, থাকবে শুধু বাণিজ্যিক বিতান, অফিস। কেন? এবারও হতাশা আহসান উল্লাহর কথায়, ‘ঢাকা শহরের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বছরের পর বছর শুধু লোকসানই গুনেছি। আর না। এখন রাজমণি চলে যাবে আমার গ্রামে, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে রাজমণি ফিল্ম সিটিতে। সেখানেই থাকবে একাধিক সিনেপ্লেক্স।’
রাজমণির অন্ধকার মিলনায়তন আর ১ হাজার ১৫০টি শূন্য আসন দেখে ভবন থেকে বের হওয়ার সময় আবার দেখা সাত্তার কাজীর সঙ্গে। তিনি জানতে চাইলেন, ‘স্যারের সঙ্গে কী কথা হইছে, আমাদের কি চাকরিতে রাখবেন?’ জবাব দিতে না পেরে স্মিত হেসে বললাম, ‘এ বিষয়ে তো কথা হয়নি। রাজমণি থাকবে না, এটাই বললেন মণি সাহেব।’