যেন কাঁধে শ্বাস ফেলেছেন ডা. রেহানা
স্নায়ুর ওপর প্রচণ্ড একটা চাপ তৈরি হলো। চৌকাঠে রাখা ছোট্ট হাতটার ওপর এই বুঝি দরজা তুলে দেন জেদি মহিলা। যেমন মা, তেমনি তার মেয়ে। আপস করতে পারেন না! নিজে আপস করতে শেখেননি, বাচ্চাটাকেও শেখাননি। ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ ছবিটা যেন দুই ঘণ্টার মনস্তাত্ত্বিক চাপের একটা প্যাকেজ। একটা দীর্ঘশ্বাস, একগাদা প্রশ্ন নিয়ে প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে এলাম।
শনিবার সকাল থেকেই বৃষ্টি, নভেম্বর রেইন। এমন আবহাওয়া দাবি করে খিচুড়ি, একটা রোমান্টিক সিনেমা তারপর ভাতঘুম। খুঁজলে খিচুড়ি পাওয়া যেত, কিন্তু পান্থপথের স্টার সিনেপ্লেক্সে রোমান্টিক ছবি নেই। ‘ভেনম’, ‘ডুন’, ‘এটারনালস’–এর সঙ্গে চলছে ‘রেহানা মরিয়ম নূর’! বেলা একটায় তিন নম্বর হলের টিকিট কিনলেও গিয়ে বসতে হলো এক নম্বরে। ৬০ শতাংশ আসন দর্শকপূর্ণ। পর্দা থেকে একটা বিষণ্ন–বিমর্ষ স্পন্দন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল দর্শকদের ভেতর।
রেহানা জেদি। রুল টানার স্কেলের ওপর কয়েকটা সমীকরণ টুকে আনায় পরীক্ষার হল থেকে বের করে দিলেন ছাত্রীকে। বেসরকারি মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপককে এতটা রূঢ় হতে হয়? ডা. রেহানা মরিয়ম নূরের উপায় থাকে না। একটা অস্থির রোলার কোস্টারের গতিতে ছুটছে তাঁর জীবন। বেকার ভাই, অবসরপ্রাপ্ত বাবা, প্রথম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েকে স্কুল থেকে আনা–নেওয়া, চাকরি—সব সামাল দেওয়া সিঙ্গেল মা রেহানাকে করে তুলছিল আরও অস্থির। পর্দার সেই অস্থিরতা দর্শকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে নির্মাতার কুশলতায়। ক্যামেরাটা কাঁপছিল সারাক্ষণ, যেন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রেহানার দিনযাপন দেখছি। ফ্রেমের ফোকাস তাক করা রেহানায়, পর্দায়, বাদবাকি যা কিছু—ঝাপসা হয়ে থাকে, যেন রেহানা ছাড়া অন্য সব মিথ্যা। এক ফোঁটা জলপতনের শব্দও দর্শকের স্নায়ুতে আঘাত করছিল। রেহানা যেন খুব কাছ থেকে শ্বাস ফেলছেন দর্শকের কাঁধে!
অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধনকে এ ছবিতে বাঁধন মনে হয়নি। মনে হয়েছে জীবনযাতনায় এলোমেলো রেহানাই। সামান্য আপস করলেই যখন সবকিছু জলের মতো সহজ হয়ে যায়, তখন এত রূঢ় কেন হতে হলো তাঁকে? ডাক্তার আরেফিনের মতো দর্শকেরও হয়তো মনে হতে পারে, ‘সব মেয়ে ধর্ষিত হয় না। তোমার মতো মেয়েরাই হয়।’ কিন্তু ছাত্রীর সঙ্গে অন্যায়ে বুক পেতে দিতে দেখে মনে হয়, রেহানা আপনি এগিয়ে যান।
‘রেহানা মরিয়ম নূর’ ছবির নির্মাণ সাধারণ নয়। এটা কোনো তরুণ নির্মাতার বানানো দ্বিতীয় ছবি, সেটা মেনে নেওয়া মুশকিল। মনে হবে, কোনো হাতপাকা ভিনদেশি নির্মাতা, অন্তত বাংলাদেশি নয়। রেহানার বোরকা, ওড়নায় ঢাকা মাথা, আবহে আজানের ধ্বনি, রেহানার নামাজ পড়ার দৃশ্যে হঠাৎ হঠাৎ মনে হচ্ছিল, ইরান নয়তো তুরস্কের ছবি দেখছি। একটা নীলাভ অন্ধকার পুরো গল্পটাকে বাস্তবতা থেকে যতবারই দূরে সরিয়ে দিচ্ছিল, রেহানার ভাষাভঙ্গি ততবারই টেনে নিয়ে আসছিল ঘরের পরিবেশে, যেন প্রতিবেশী মেয়েটা। গল্পের আরেফিন, অ্যানি, প্রিন্সিপাল, ইমু—কাউকেই একমুহূর্তের জন্যও অচেনা বলে মনে হয়নি। গল্পটি শেষতক আমাদেরই ছিল।
ছবি শেষে মাহবুব নামের এক দর্শকের কাছে জানতে চাই, কেমন লাগল? তিনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। ফেসবুক মারফত ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ সম্পর্কে জেনে শনিবারের ছুটিতে দেখতে এসেছেন সিনেমাটি। তিনি বললেন, পুরোপুরি ঘরের ভেতর ছবি শেষ হয়ে গেল। একটু বাইরে বের হলে ভালো হতো। সাদা অ্যাপ্রন পরা মেডিকেলের দুই ছাত্রীর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে পোস্টারের সঙ্গে সেলফি তুলতে তুলতে তাঁরা কেবলই বলেন, ভালো লেগেছে, বেশ ভালো।
নাচ, গান, কুস্তি, খিস্তির সিনেমায় অভ্যস্ত দর্শকের ছবি নয় ‘রেহানা মরিয়ম নূর’। খুব বিনোদন যে পাওয়া যাবে, তা–ও নয়। কিছু ঘুমন্ত প্রশ্নের ঘুম ভেঙে দেবে। প্রতিবাদ ও এর মাত্রার শেষ যাত্রা দেখিয়ে দেবে। ছবিজুড়েই যেন ছড়িয়ে রয়েছে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বার্তা। এক ঘটনার দৃষ্টিভঙ্গিগত ব্যাখ্যা যেন পাওয়া যাবে আরেক ঘটনায়। মেডিকেলের শিক্ষক মায়ের একগুয়েমি আর স্কুলপড়ুয়া মেয়ের একগুয়েমি মিলেমিশে একটা বড় প্রশ্নবোধ তৈরি করবে, তাহলে কী করবে ওরা? সংলাপের কয়েকটি প্রশ্নে বিদ্ধ হবেন দর্শকও, ‘কেউ দেখেনি বলে কি ঘটনাটি ঘটেনি?’ বা প্রতিবাদী রেহানাকে ডাক্তার আরেফিন বলেছিলেন, ‘ভুল আপনি কোনোদিন করেননি?’ আর জল যেন নিজেই ছবির একটি স্বতন্ত্র চরিত্র।
১২ নভেম্বর দেশের ১০টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে ‘রেহানা মরিয়ম নূর’। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দেশকে এ রকম একটি সিনেমা উপহার দেওয়ার জন্য পরিচালক আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদকে অভিনন্দন। তাঁর চলচ্চিত্রযাত্রা শুভ হোক।