যেখানে আটকে আছে যৌথ প্রযোজনার সিনেমা

যাঁরা একসময় নীতিমালায় পরিবর্তন চেয়েছিলেন, তাঁরাই এখন বলছেন, সংশোধনের পর নীতিমালা কঠিন হয়ে গেছেছবি:কোলাজ

‘দূর দেশ’, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, ‘মিস লঙ্কা’, ‘মনের মাঝে তুমি’র মতো বেশ কিছু বাংলা সিনেমা নির্মিত হয়েছিল বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনায়। সেই সময়ে হয়তো যৌথ প্রযোজনায় সিনেমা নির্মাণে শক্ত সব নীতিমালা ছিল না। নীতিমালা প্রণয়ন এবং সেটি সংশোধনের পর থেকে আটকে আছে যৌথ প্রযোজনায় সিনেমা নির্মাণ।

গত তিন বছর যৌথ প্রযোজনায় ছবি নির্মাণের তেমন কোনো খবর নেই। অথচ পাঁচ বছর আগেও যৌথ প্রযোজনায় ছবি তৈরির জোয়ার এসেছিল। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে যৌথ প্রযোজনার সংশোধিত নীতিমালা হওয়ার পর থেকেই ছবি নির্মাণ আটকে আছে। নতুন নীতিমালা মেনে এখন পর্যন্ত একটি ছবিও নির্মিত বা মুক্ত হয়নি। এ সময়ের মধ্যে ঢাকা-কলকাতার যৌথ প্রযোজনায় ‘স্বপ্নজাল’, ‘নূরজাহান’ ও ‘তুই আমার রানী’ নামে তিনটি ছবি মুক্তি পেয়েছিল। তবে ছবি তিনটি যৌথ প্রযোজনার পুরোনো (২০১২ সাল) নীতিমালায় তৈরি।

যৌথ প্রযোজনার জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ‘মনের মাঝে তুমি’তে অভিনয় করেন রিয়াজ ও পূর্ণিমা

২০১৮ সালে ‘বালিঘর, ‘প্রেম আমার টু’ ও ‘সুলতান: দ্য সেভিয়ার’ নামে যৌথ প্রযোজনার তিনটি ছবির চিত্রনাট্য অনুমোদন পায়। পরে ‘প্রেম আমার টু’ ও ‘সুলতান: দ্য সেভিয়ার’ ছবি দুটি নতুন নীতিমালায় নির্মাণে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত কলকাতার একক ছবি হিসেবে তৈরি হয়। আর ‘বালিঘর’–এর কাজ বাতিল হয়। ছবিটির পরিচালক অরিন্দম শীল সে সময় জানিয়েছিলেন, নতুন নীতিমালার জটিল প্রক্রিয়ার কারণে ‘বালিঘর’ নির্মাণ সম্ভব হচ্ছে না।

২০১৯ সালে ‘দিন: দ্য ডে’ ও ‘ফুড়ুৎ’ নামে আরও দুটি ছবির চিত্রনাট্য পাস করে যৌথ প্রযোজনার যাচাই–বাছাই কমিটি। ‘দিন: দ্য ডে’ ছবির শুটিং শেষ।‘ফুড়ুৎ’–এর শুটিং প্রক্রিয়াধীন। আর চলতি বছর কোনো চিত্রনাট্য জমা পড়েনি বলে নিশ্চিত করেছেন যৌথ প্রযোজনার যাচাই-বাছাই কমিটির প্রধান ও বিএফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুজহাত ইয়াসমিন।

তবে প্রযোজকেরা বলছেন, সংশোধিত নীতিমালা সূক্ষ্মভাবে মেনে যৌথ প্রযোজনায় ছবি নির্মাণ কঠিন। অনুসরণীয় শর্তের ঙ.–এর ০২–এ বলা হয়েছে, ‘সাধারণভাবে যৌথ চলচ্চিত্র প্রযোজনার ক্ষেত্রে প্রধান চরিত্রের অভিনয়শিল্পী এবং মুখ্য কারিগরি কর্মীসহ শিল্পী ও কলাকুশলী সমানুপাতিক হারে নিয়োগের বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে।’

যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ পেয়েছিল দারুণ প্রশংসা

প্রযোজকদের অনেকে মনে করেন, শুটিং চলাকালে গল্পের প্রয়োজনে লোকেশন থেকে শুরু করে অনেক কিছুই পরিবর্তন করতে হতে পারে। ফলে এ রকম কঠোর নিয়ম মেনে সৃজনশীল কাজ করা প্রায় অসম্ভব। ‘নিয়তি’, ‘নবাব’, ‘বাদশা’, ‘বস টু’, ‘নূরজাহান’, ‘রোমিও ভার্সেস জুলিয়েট’, ‘আশিকী’, ‘শিকারি’সহ অনেকগুলো যৌথ প্রযোজনা ছবির বাংলাদেশ অংশের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়ার প্রধান নির্বাহী আলিমুল্লাহ খোকন বলেন, ‘গত কয়েক বছরে আমরা ১৩টি যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণ করেছি। প্রায় সব ছবি সফলও হয়েছে।

নীতিমালা সংশোধনের পর গত তিন বছর যৌথ প্রযোজনায় আর কাজ করিনি। এই নীতিমালা সূক্ষ্মভাবে মেনে ছবি নির্মাণ সম্ভব নয়। কাজ করলেও সময় লাগবে। সে ক্ষেত্রে ছবির বাজেট কয়েক গুণ বেড়ে যাবে।’ তিনি জানান, সংশোধিত নীতিমালা অনুসারে ২০১৮ সালে ‘প্রেম আমার টু, ‘সুলতান: দ্য সেভিয়ার’ ছবি দুটির কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু মাঝপথে গিয়ে দেখা যায়, নীতিমালা মেনে কাজ এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত কলকাতার একক ছবি হিসেবে শুটিং করা হয়েছে। পরে সেগুলো বাংলাদেশে আমদানি করে প্রদর্শন করা হয়েছে।

গত এক বছর এফডিসিতে জমা পড়েনি যৌথ প্রযোজনার ছবির চিত্রনাট্য

চলচ্চিত্র–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের যাঁরা একসময় নীতিমালায় পরিবর্তন চেয়েছিলেন, তাঁরাই এখন বলছেন, সংশোধনের পর নীতিমালা কঠিন হয়ে গেছে। চলচ্চিত্রের এই দুঃসময়ে সেটা পুনরায় সংশোধন করে আরেকটু সহজ করা দরকার। তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সভায় নীতিমালাকে কিছুটা নমনীয় করার প্রস্তাব দিয়েছেন বলে জানান বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি ও প্রযোজক সমিতির নেতারা।

প্রযোজক সমিতির সভাপতি খোরশেদ আলম বলেন, ‘আমরা এক মিটিংয়ে তথ্যমন্ত্রীকে বিষয়টি নতুন করে বিবেচনার অনুরোধ করেছি। তিনি কথা দিয়েছেন, একটি কমিটি গঠন করে যাচাই–বাচাই করে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবেন।’ তিনি জানান, সংশোধিত এই নীতিমালা মেনে দুই দেশের কোনো প্রযোজকই কাজ করতে আগ্রহী নন। অথচ কয়েক বছর আগে যৌথ প্রযোজনার ছবির কারণে বেশ চাঙা হয়ে উঠেছিল চলচ্চিত্রাঙ্গন। নীতিমালা একটু নমনীয় হলে আবার হয়তো যৌথ প্রযোজনায় সিনেমা নির্মাণ বাড়বে। তিনি বলেন, ‘যৌথ প্রযোজনার নামে প্রতারণা যেন না হয়, সেই বিষয়ও খেয়াল রাখতে হবে।’