সরকারি দাবি আদায় আইনের মামলায় গত রোববার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন কবি ও চলচ্চিত্র নির্মাতা টোকন ঠাকুর। গতকাল সোমবার তাঁকে জামিন দিয়েছেন আদালত। চলচ্চিত্র নির্মাণে বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া অনুদান নিয়ে অনিয়মের অভিযোগে আগে মামলা হয়েছিল। তবে এবারই প্রথমবারের মতো গ্রেপ্তার হলেন কোনো পরিচালক। তাঁর গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়লে ফেসবুক ও স্বাধীন নির্মাতাদের মধ্যে ক্ষুব্ধ ও মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকারের দেওয়া অনুদানের অঙ্কটি অপ্রতুল। সেই অর্থে চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রায় অসম্ভব। বিভিন্ন সময় অনুদানের এ অর্থের সঙ্গে বাড়তি অর্থের জন্য সহপ্রযোজক যুক্ত করে সিনেমা বানিয়েছেন অনেক নির্মাতা। অনুদান কমিটির সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছিলেন, অর্থের পরিমাণসহ সব বিষয় জেনেশুনেই নির্মাতারা এ অর্থের জন্য আবেদন করছেন। ফলে নির্মাতাদের আরও বাস্তবমুখী হতে হবে। যাঁরা অনুদান নিয়ে বছরের পর বছর ছবির কাজ শেষ করছেন না, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। কারণ, অনুদানের টাকাটা জনগণের। দিনের পর দিন এ রকম সতর্কবার্তার একপর্যায়ে ঘটল গ্রেপ্তারের ঘটনা।
অনুদানের অর্থ নিয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সিনেমা বানাতে না পারার নজির রয়েছে আরও। এমনকি কেউ কেউ টাকা ফেরত দিয়েছেন, কোনো কোনো পরিচালক মৃত্যুবরণও করেছেন। দুর্ভাগ্যজনক এ ঘটনাগুলোর বিপরীতে রয়েছে আশাব্যঞ্জক উদাহরণ। সরকারি অনুদানের টাকার সঙ্গে বাড়তি টাকা যোগ করে ছবি বানিয়েছেন কেউ কেউ। সেসবের কোনো কোনো ছবি আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে কুড়িয়েছে প্রশংসা। এমনকি কোনো কোনো চলচ্চিত্রকার নিজের প্রকল্পের জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে প্রযোজক জোগাড় করে নিজেদের সিনেমার কাজ এগিয়ে নিয়েছেন।
অনুদান নিয়ে দাতা-গ্রহীতা দুই পক্ষেরই আক্ষেপ ও পাল্টা যুক্তি রয়েছে। অনুদানের অঙ্কের চেয়ে কম-বেশি তিন-চার গুণ টাকা খরচ করেই ছবি বানাতে হয়। তবু সিনেমাকে আলু-পেঁয়াজের সিন্ডিকেটের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা ঠিক হবে না। চলচ্চিত্রের মতো একটি শিল্পমাধ্যমে কয়েক লাখ টাকার জন্য কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়াটা অস্বস্তিকর।
বাংলাদেশের জনপ্রিয় ও প্রশংসিত দুই সিনেমা ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ ও ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ নির্মিত হয়েছিল বাংলাদেশ সরকারের অনুদানে। এমনকি অনুদান পাওয়া ‘দেবী’ সিনেমাটি পেয়েছিল সুপারহিট তকমা ও বাণিজ্যিক সাফল্য। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের অনুদানে নির্মিতব্য চলচ্চিত্র ‘শিকলবাহা’ বার্লিন থেকে ডব্লিউসিএফ জয়ের পর যৌথ প্রযোজক হিসেবে পেয়েছে ইউরোপের প্রযোজনা সংস্থা ওয়াইডাম্যান ব্রসকে। এ ছবি প্রসঙ্গে পরিচালক কামার আহমাদ সাইমন জানান, ছবির সম্পাদনা প্রায় শেষ। তথ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি সাপেক্ষে চলতি বছর ছবিটি জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। অনুদানের জন্য আবেদনের সময়ই ছবির বাজেট ছিল ১ কোটি ৮৯ লাখ টাকা, কাজ করতে গিয়ে যা বেড়েছে। কামার বলেন, ‘অনুদান নিয়ে দাতা-গ্রহীতা দুই পক্ষেরই আক্ষেপ ও পাল্টা যুক্তি রয়েছে। অনুদানের অঙ্কের চেয়ে কম-বেশি তিন-চার গুণ টাকা খরচ করেই ছবি বানাতে হয়। তবু সিনেমাকে আলু-পেঁয়াজের সিন্ডিকেটের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা ঠিক হবে না। চলচ্চিত্রের মতো একটি শিল্পমাধ্যমে কয়েক লাখ টাকার জন্য কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়াটা অস্বস্তিকর। আবার অনুদান নিয়েও বছরের পর বছর যদি অগ্রগতি না জানিয়ে বসে থাকি, সেটাও অন্যায়। সরকারি অনুদান আমার কাছে কেবল টাকা নয়, এটি একটি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সম্মাননাও। তাই এ ব্যাপারে দাতা-গ্রহীতা দুই পক্ষেরই আরও সংবেদনশীল হওয়া উচিত।’
অনুদান কমিটির সাবেক সদস্য নাট্যজন মামুনুর রশীদও মনে করেন, অনুদানের ছবিগুলো যথাসময়ে শেষ করা উচিত। ছবিগুলো ভালো হওয়া দরকার বটে, কিন্তু সব ছবি খুব ভালো না–ও হতে পারে। তিনি বলেন, ‘আমি সব সময়ই বলে এসেছি, অনুদানের টাকাটা জনগণের। অনুদানের ছবিগুলো খুব গ্রহণযোগ্য বাণিজ্যিক ছবি না হোক, কিন্তু ভালো ছবি হলে তারও একটা আর্কাইভাল ভ্যালু আছে। যত দূর শুনেছি টোকনের ছবিটার কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। যে অবস্থায় ছিল, সেটা মন্ত্রণালয়কে তাঁর দেখানো উচিত ছিল।’
সরকারি অনুদানের অর্থে কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহিরের ‘কাঁটা’ গল্প অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করছিলেন টোকন ঠাকুর। ২০১২-১৩ অর্থবছরে সরকারি অনুদান পায় ছবিটি। চলতি বছরের নির্মাতা প্রথম আলোকে জানিয়েছিলেন, ছবির শুটিং শেষ, সম্পাদনার কাজও শেষের পথে। শিগগিরই শুরু হবে ডাবিং ও আবহসংগীতের কাজ। তাঁর দাবি, ছবিটি নির্মাণে প্রায় ১ কোটি ১৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। ঐতিহাসিক ছবি হওয়ায় প্রস্তুতি নিতে প্রায় সাড়ে তিন বছর সময় নিয়েছেন তিনি। নতুন শিল্পী খুঁজে তাঁদের প্রশিক্ষণ ও মহড়া করাতে সময় লেগেছে আরও ছয় মাস। এই নির্মাতা বলেন, ছবিটিতে প্রায় ২০০ শিল্পী অভিনয় করেছেন। পাশাপাশি গল্পের সময়কাল ধরে লোকেশন, কস্টিউম বের করতে অনেক সময় ব্যয় হয়েছে।
১৯৭৬-৭৭ অর্থবছর থেকে দেশীয় চলচ্চিত্রে সরকারি অনুদানের প্রথা চালু হয়। সে বছর অনুদান পাওয়া মসিহ্উদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলীর ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ ও বাদল রহমানের ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ খুব আলোচিত হয়। এরপর থেকে নিয়মিত অনুদান দিয়ে আসছে সরকার। তবে প্রতিবছরই কিছু না কিছু অনুদানের ছবির নির্মাণকাজ ঝুলে গেছে।
২০০৭-০৮ অর্থবছরে ‘নমুনা’, ২০০৮-০৯-এ ‘স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের কাল’, ২০০৯-১০-এ ‘সূচনারেখার দিকে’, ২০১০-১১-তে ‘কাকতাড়ুয়া’, ২০১১-১২ অর্থবছরে ‘একা একা’, ‘নেকড়ে অরণ্যে’, ‘হাডসনের বন্দুক’, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ‘কাগজের ফুল’, ২০১৩-১৪ অর্থবছরের ‘পঞ্চসঙ্গী’, ‘কাঁসার থালায় রুপালি চাঁদ’, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’, ‘চন্দ্রাবতী কথা’, ‘বিউটি সার্কাস’, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ‘সাবিত্রী’, ‘শিকলবাহা’, ‘বৃদ্ধাশ্রম’, ২০১৬-১৭ ‘নোনাজলের কাব্য’, ‘রূপসা নদীর বাঁকে’, ‘আজব সুন্দর’, ‘প্রিয় জন্মভূমি’, ‘দায়মুক্তি’, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ‘গোর’, ‘কালবেলা’, ‘অলাতচক্র’, ‘আজব ছেলে’ ও ‘অবলম্বন’ ছবিগুলো ছিল বিলম্বের তালিকায়। এমনকি এখনো বেশ কিছু ছবি অপেক্ষমাণ। তথ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, অনুদান গ্রহীতাদের সময়মতো ছবি জমা দেওয়ার জন্য তাগাদা দিয়েই যাচ্ছেন তাঁরা।