ভালোবাসা, জ্ঞান, পৃষ্ঠপোষকতার অভাব

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছু সিনেমা তৈরি হয়েছে তবে সেসব যথেষ্ট মানসম্পন্ন নয়কোলাজ: আমিনুল ইসলাম

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নানা ঘটনা নিয়ে নির্মিত হয়েছিল আ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস, দ্য রোড টু গ্লোরি, ১৯১৭–এর মতো বেশ কিছু সিনেমা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে স্তালিনগ্রাদ, দ্য ক্রেনস আর ফ্লাইং, জো জো র‍্যাবিট–এর মতো অনেক সিনেমা। এগুলো যুদ্ধের নৃশংসতা তুলে রেখেছে, নতুন প্রজন্মকে যুদ্ধের ইতিহাস আর শান্তির প্রয়োজনীয়তা জানানোর জন্য। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও কিছু সিনেমা তৈরি হয়েছে। তবে সেই পরিমাণ অপ্রতুল আর যথেষ্ট মানসম্পন্ন নয় বলে মনে করেন খোদ চলচ্চিত্র অঙ্গনের মানুষেরাই। তাঁরা মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ভালোবাসা, জ্ঞান, নির্মাণের পৃষ্ঠপোষকতা নেই বলেই মানসম্পন্ন সিনেমা তৈরি করা হয়ে ওঠেনি। এমনকি এখনো হচ্ছে না।

মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ছবি ওরা ১১ জন–এর দৃশ্য
সংগৃহীত

মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ছবি ওরা ১১ জন–এর প্রযোজক ও অভিনেতা সোহেল রানা মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধ ও দেশের প্রতি ভালোবাসা থাকলে যুদ্ধের ছবি বানানো সম্ভব হতো। ১৯৭১ সালের পর থেকে যতগুলো সিনেমা তৈরি হয়েছে, সেগুলোর প্রযোজক–পরিচালকেরা হয় মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, নয়তো দেখেছেন। সে কারণে তাঁরা কিছু ছবি নির্মাণের চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘ওই সময়ের প্রযোজক–পরিচালকদের হয়তো টেকনিক্যাল জ্ঞান তেমন ছিল না, কিন্তু হৃদয় দিয়ে তাঁরা সেদিন সিনেমাগুলো বানিয়েছিলেন।’ আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তেমন কোনো ভালো ছবি গত ৪৯ বছরে হয়নি, এ জন্য অনেকটাই দায়ী আমাদের লেখকেরাও। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সে রকম গল্প–উপন্যাস লেখেননি, যা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ছবি তুলে ধরতে পারে। লিখলে সেসবের ওপর ভিত্তি করে ছবি বানানো যেত।’

একসময় হারুনর রশীদ বানিয়েছিলেন মেঘের অনেক রং। আমরা এখন সে রকমও বানাতে পারি না, কারণ, আমাদের ইচ্ছাও নেই। চলচ্চিত্র একটি শক্তিশালী মাধ্যম, সামাজিক আন্দোলনের একটা হাতিয়ার। সেই বিবেচনায় মুক্তিযুদ্ধ সামনে রেখে সরকারকে কিছু কিছু জায়গায় ভূমিকা রাখতে হবে।
নাসির উদ্দীন ইউসুফ, চলচ্চিত্র নির্মাতা
সারাহ বেগম কবরী
প্রথম আলো

অভিনেত্রী ও পরিচালক সারাহ বেগম কবরী মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধের আবেগকে কাজে লাগিয়ে বেশ কিছু ছবি নির্মাণের চেষ্টা করেছেন বেশ কয়েকজন পরিচালক। কিন্তু সেসব তেমন ভালো ছবি হয়নি। যে দু–একটা হয়েছে, সেগুলো তেমন অর্থসহায়তা পায়নি, এমনকি পায়নি প্রদর্শনের জায়গাও। তিনি বলেন, ‘সিনেমা মানেই বিনোদন। সিনেমাকে আমি সর্বজনীনভাবে দেখি। সিনেমায় জীবন আসবে, যুদ্ধ সেই জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে আসবে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ভালো সিনেমা নেই। এখন অনুদান নিয়ে যারা সিনেমা বানাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে এদের কেউ সারা জীবন অভিনয় করে হঠাৎ নির্মাণে এসেছে, অনেকে প্রথম সিনেমা বানাচ্ছে। এই পরিচালকদের অনেকেরই নেই প্রশিক্ষণ, পড়াশোনা বা সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা।’

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
প্রথম আলো

গেরিলা ছবির পরিচালক নাসির উদ্দীন ইউসুফ মনে করেন, যুদ্ধের সিনেমা নির্মাণে আমাদের নির্মাতাদের জ্ঞানের ঘাটতি রয়েছে। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে। একসময় হারুনর রশীদ বানিয়েছিলেন মেঘের অনেক রং। আমরা এখন সে রকমও বানাতে পারি না, কারণ আমাদের ইচ্ছাও নেই। চলচ্চিত্র একটি শক্তিশালী মাধ্যম, সামাজিক আন্দোলনের একটা হাতিয়ার। সেই বিবেচনায় মুক্তিযুদ্ধ সামনে রেখে সরকারকে কিছু কিছু জায়গায় ভূমিকা রাখতে হবে।’
অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের ছবি তেমন নির্মিত হয়নি বলে নিরাশ হতে চাননি জয়যাত্রা ছবির পরিচালক তৌকীর আহমেদ। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের পিরিয়ডিক কাজ সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ। তবে বিশ্বযুদ্ধের শতবর্ষ পরও তা নিয়ে ছবি নির্মিত হয়েছে। আমি আশাবাদী, তরুণ প্রজন্ম আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও অনেক কাজ করবে, ভিন্ন প্রেক্ষাপটে, ভিন্ন আঙ্গিকে মুক্তিযুদ্ধকে দেখবে।’

এখনকার তরুণেরা আমাদের চেয়ে জ্ঞানী, প্রযুক্তিগত দিক থেকে অনেক এগিয়ে। কেবল সিনেমা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হলেই তারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভালো ছবি বানাতে পারবে।
সোহেল রানা
তৌকীর আহমেদ

মুক্তিযুদ্ধের ভালো ছবি নির্মাণ প্রসঙ্গে কবরী বলেন, ‘যথাযথ গবেষণার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের তথ্যচিত্র নির্মাণ করতে হবে। এ ছাড়া সিনেমাকে বিনোদনের মাধ্যম বিবেচনা করেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ডকু-ফিকশন তৈরি করা যেতে পারে। সেখানে কেবল গোলাগুলি নয়, মুক্তিযুদ্ধকালীন ছোট ছোট ঘটনা, অনুভূতি যুদ্ধের সময়ের মানুষের জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে আসতে পারে।’ অন্যদিকে সোহেল রানা মনে করেন, এখনকার প্রজন্মের পক্ষেই ভালো সিনেমা তৈরি করা সম্ভব। তিনি বলেন, ‘এখনকার তরুণেরা আমাদের চেয়ে জ্ঞানী, প্রযুক্তিগত দিক থেকে অনেক এগিয়ে। কেবল সিনেমা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হলেই তারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভালো ছবি বানাতে পারবে।’

নাসির উদ্দীন ইউসুফ মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা বানাতে এগিয়ে আসতে হবে প্রযোজকদের, হলমালিকদেরও এসব ছবি চালানোর মানসিকতা তৈরি করতে হবে। এ ধরনের ছবিতে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে, অন্তত ছাত্রদের দেখার সুযোগ করে দিতে হবে। তাহলেই মুক্তিযুদ্ধের ছবির আগের তুলনায় বাড়বে।