বয়স্করা কেন নায়ক হবেন না
কেন্দ্রীয় চরিত্র বা নায়ক হিসেবে কোনো বয়স্ক অভিনেতার কথা কখনো কি ভেবেছেন ঢাকার কোনো পরিচালক? সিনেমা বা টিভি নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রে বেশির ভাগ সময়ই দেখা যায় তরুণ মুখ। অন্যদিকে অভিজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠ অভিনেতারা পার্শ্বচরিত্রে অংশ নিতে নিতে একসময় হারিয়ে যান। তাঁদের বহু বছরের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা একসময় আর কোনো কাজে লাগাতে পারেন না এদেশের পরিচালকেরা। প্রযোজকেরাও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অর্থ লগ্নি করতে অনীহা প্রকাশ করেন!
৫২ বছর বয়সে ‘ড্রাইভিং মিস ডেইজি’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন হলিউডের তারকা অভিনেতা মরগান ফ্রিম্যান। বলিউডে অমিতাভ বচ্চনকে নিয়ে প্রায়ই গুরুত্বপূর্ণ সব চরিত্র লেখা হয়। এই তো কদিন আগের ‘গুলাবো সিতাবো’তে তাঁর চরিত্র প্রশংসিত হয়। এমনকি যে সিনেমাগুলোর কেন্দ্রীয় চরিত্রে থাকেন কোনো তরুণ অভিনেতা, সেখানেও অমিতাভকে দেখা যায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়। আর টালিউডের সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্য আমৃত্যু গুরুত্বপূর্ণ সব চরিত্র লিখেছেন সেখানকার পরিচালকেরা। আমরা কেন পিছিয়ে? আমাদের আছেন মামুনুর রশীদ, রাইসুল ইসলাম আসাদ, আবুল হায়াত, তারিক আনাম খান ও আফজাল হোসেন। আরও আছেন আফসানা মিমি, শমী কায়সার, বিপাশা হায়াতসহ অনেকে।
এ প্রসঙ্গে তরুণ প্রজন্মের পরিচালক মাসুদ হাসান উজ্জল বলেন, ‘এই ইন্ডাস্ট্রি লগ্নিকারীকেন্দ্রিক। তাঁরা মনে করেন, গল্প সব সময় হতে হবে তরুণ নায়ক–নায়িকাকেন্দ্রিক, তাহলেই তাঁরা সফল হবেন। আমাদের দেশে শিল্পীর চেয়ে পরিচালক বেশি। টিকে থাকার জন্য তাঁরা কোনো ঝুঁকির মধ্যে যেতে চান না। এখন ফেসবুকের যুগ, পরীক্ষামূলক সব ছবি সেনসেটিভ অডিয়েন্স যেভাবে গ্রহণ করে, আমজনতা সেভাবে করে না। আমজনতা কোনো দায়বদ্ধতা থেকে মতামত দেয় না। তাই সবার কথা ভেবে ওই ধরনের ছবি করা হয় না।’
জ্যেষ্ঠ পরিচালক কাজী হায়াত বলেন, ‘আমার একটি স্ক্রিপ্ট পড়ে আছে। আলমগীরকে কেন্দ্রীয় চরিত্র ভেবে সেটি লিখেছিলাম। এখন তো সিনেমাই হয় না। এখনকার তরুণ পরিচালকেরা আলমগীর, ইলিয়াস কাঞ্চন বা ববিতাদের কাছে যান না। কারণ, নতুন ছেলেমেয়েদের মূলধারার অভিনয়শিল্পীদের প্রতি এক ধরনের অনাগ্রহ, একটি অচ্ছুত ভাব আছে। আর পুরোনো পরিচালকেরা কেউ মাঠে নেই। সিনেমা যা হচ্ছে, বাজেট এত কম যে বড়দের কাছে যেতেও পারছেন না কেউ। একজন পরিচালক তো সিনেমা বানালেন ২০ লাখ টাকায়! তিনি কীভাবে বড় শিল্পীদের কাছে যাবেন? তাঁরা তো যেনতেন করে সিনেমা গুলিয়ে ফেলেন। সিনিয়র শিল্পীরা তাঁদের সঙ্গে কাজ করতে চাইবেন কেন?’
চলচ্চিত্র গবেষক মতিন রহমান মনে করেন, বাজারের চাহিদা এবং জ্যেষ্ঠ শিল্পীদের অবমূল্যায়নের কারণে এসব হয়। তিনি বলেন, ‘এ কাজে প্রযোজক ও পরিচালকের চাহিদা থাকতে হবে। তারপরই চিত্রনাট্যকার লিখবেন। ইন্ডাস্ট্রির পারিপার্শ্বিক অনেক কিছু একজন পরিচালককে দুর্বল করে রাখে। তাঁকেও ভাবতে হয় দর্শক চাহিদার কথা। দর্শকও চান, একজন তরুণ নায়ক-নায়িকা। আর সিনিয়রদের সেভাবে মূল্যায়ন করা হয় না বলেই তরুণ নির্মাতাদের মাথায় মাসুদ পারভেজ বা আলমগীরদের কথা আসে না।’ ভারতের প্রয়াত অভিনেতা সৌমিত্রের উদাহরণ সামনে তুলে আনলে তিনি বলেন, ‘সৌমিত্র নিজেকে সেই জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর দর্শক আলাদা। এই দর্শকেরা হারায় না। অপুর সংসার থেকে ওই দর্শকেরা তাঁর সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু আমাদের দেশের দর্শকেরা আজ আছে কাল নেই।’
বয়স্ক শিল্পীকে প্রধান চরিত্র করে বাংলাদেশে মূলধারার সিনেমা খুব কমই হয়েছে। ‘বাবা কেন চাকর’ ছবির চিত্রনাট্য ও পরিচালনা রাজ্জাক করেছিলেন নিজের জন্য। ছবি মুক্তির সময় তাঁর বয়স ছিল ৫৫ বছর। এ ছাড়া ‘আবার বসন্ত’ ছবিতে তারিক আনাম খান, ‘গণ্ডি’ ছবিতে দেখা গেছে সব্যসাচী ও সুবর্ণা মুস্তাফাকে। ছবিগুলো প্রমাণ করে, কেন্দ্রীয় চরিত্রে তারুণ্য নয়, গল্প আর অভিজ্ঞতাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।