‘বালুখেকো’ চেয়ারম্যানের টাকায় পিকনিক, চলচ্চিত্রপাড়ায় ক্ষোভ: পরিচালকদের মধ্যে বিভক্তি

‘বালুখেকো’ চেয়ারম্যান ও বিতর্কিত চলচ্চিত্র প্রযোজক সেলিম খানের টাকায় এবার পিকনিক আয়োজন করেছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি
কোলাজ : সংগৃহীত

‘বালুখেকো’ চেয়ারম্যান ও বিতর্কিত চলচ্চিত্র প্রযোজক সেলিম খানের টাকায় এবার পিকনিক আয়োজন করেছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি! গতকাল শুক্রবার ঢাকার অদূরে পুবাইলে এই পিকনিক আয়োজন করা হয়। শাপলা মিডিয়ার কর্ণধার সেলিম খানের কাছ থেকে টাকা নেওয়াকে কেন্দ্র করে চলচ্চিত্রপাড়ায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এই পিকনিক ঘিরে পরিচালক সমিতির সদস্যদের মধ্যে বিভক্তিরও সৃষ্টি হয়েছে।
সেলিম খানের টাকায় চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির পিকনিক আয়োজন, ক্ষোভে তাই অনেক পরিচালক পিকনিকে যাননি। আবার কেউ কেউ গিয়ে যখন জানতে পারেন, কিছু না খেয়েই তাঁরা ফিরে আসেন। তাঁদের একটাই কথা, সিনেমাশিল্প এমনিতে খুঁড়িয়ে চলছে, যাও একটু অবশিষ্ট আছে, তা–ও ধ্বংসের পাঁয়তারা করছেন ‘বালুখেকো’ চেয়ারম্যান ও বিতর্কিত এই প্রযোজক। এই ধরনের বিতর্কিত একজনের টাকায় পিকনিকের আয়োজন করা পরিচালক সমিতির নৈতিকতার মধ্যে পড়ে না। পরিচালক সমিতির পিকনিকে সেলিম খানের মোটা অঙ্কের টাকা দেওয়াটাকে প্রযোজক পরিবেশক সমিতির আগামী নির্বাচনকেন্দ্রিক বড় কোনো চক্রান্ত বলেও মনে করছেন কেউ কেউ। ভোটে জেতার কৌশলও তাঁর এই পিকনিক বলছেন চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পরিচালক সমিতির একজন সদস্য বলেন, সেলিম খান প্রযোজক পরিবেশক সমিতির নির্বাচন করতে চাইছেন। তাই ছবি বানানোর নামে কৌশলে কয়েক দিন আগে তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে ভোটারসংখ্যা বাড়িয়েছেন। তাই এবার টাকা দিয়ে পরিচালক সমিতির পিকনিককে নিজের নির্বাচনী মাঠ বানালেন। আর কিছু স্বার্থবাদী পরিচালক পেছন থেকে তাঁকে তোষামোদ করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছেন। এসব চলতে থাকলে একটা সময় সিনেমা শেষ হয়ে যাবে। তখন আর হাহুতাশ করেও কোনো লাভ হবে না। তাই এখনই তাঁদের বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।

‘বালুখেকো’ চেয়ারম্যান সেলিম খান

অভিযোগ আছে, ‘বালুখেকো’ চেয়ারম্যান সেলিম খানকে চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট কাজে সহযোগিতা করছেন শামীম আহমেদ রনি, চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির মহাসচিব শাহীন সুমনসহ হাতে গোনা কয়েকজন পরিচালক। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেলিম খানের টাকায় পিকনিক করতে রাজি ছিলেন না পরিচালক সমিতির অনেকেই। শুধু মহাসচিবের জোরাজুরিতে তা সম্ভব হয়েছে।

পরিচালকদের অনেকে বলেছেন, সেলিম খান এর আগে চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির নির্বাচনে শাহীন সুমনের পক্ষকে সমর্থন দেন। কৌশলে তখন ভোটার বাড়ান। সে সময় একেকটি ছবির জন্য ২০ লাখ টাকা বাজেট ধরে ১০০ পরিচালকের জন্য ১০০ ছবির নাম ঘোষণা দেন। ১০০ ছবি না হলেও নির্বাচনী কৌশলে সফল হন। নির্বাচনে জিতে আসেন তাঁর অনুসারীরা। পরিচালক সমিতির সেই নেতারাই এখন সেলিম খানকে প্রযোজক সমিতিতে জেতাতে উঠেপড়ে লেগেছেন। তাই তো বেশির ভাগ চলচ্চিত্র পরিচালকই বলছেন, এই পিকনিক চলচ্চিত্র প্রযোজক পরিবেশক সমিতির নির্বাচনী অ্যাজেন্ডা।
রাগে–দুঃখে–ক্ষোভে চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির পিকনিকে যাননি গুণী নির্মাতা কাজী হায়াৎ। তিনি বলেন, পরিচালক সমিতির গতবারের নির্বাচনের আগে সেলিম খান ১০–১৫–২০ লাখ টাকা বাজেটের কয়েকটা ছবি বানান। এসব বানিয়ে তাঁর পক্ষের ভোটারসংখ্যা বাড়ান। সেই চক্রান্তে তিনি সফল হন। এখন হয়তো ভাবছেন, একই ফর্মুলায় প্রযোজক পরিবেশক সমিতির নির্বাচনেও সফল হবেন! তাই প্রযোজক পরিবেশক সমিতির চেয়ারে বসতে চান তিনি। আর এ কারণে পরিচালকদের নিয়ে অসময়ে পিকনিকের উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি নাটকের বাজেটে সিনেমা বানাচ্ছেন। এতে তো সিনেমার সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে।

কাজী হায়াৎ বলেন, ‘আমি অবাক হচ্ছি, সেলিম খানের মতো মানুষের পেছনে ছুটছেন আমাদের কিছু শিক্ষিত আর মেধাবী পরিচালকও

কাজী হায়াৎ আরও বলেন, ‘আমি অবাক হচ্ছি, সেলিম খানের মতো মানুষের পেছনে ছুটছেন আমাদের কিছু শিক্ষিত আর মেধাবী পরিচালকও! কেন ভাই? আপনারা কি বুঝতে পারছেন না, এই মানুষটি আমাদের সিনেমা ধ্বংস করে দিচ্ছেন। আমাদের বর্তমান সিনেমা এমনিতে অক্সিজেন দিয়ে চলছে। এই বিতর্কিত অসৎ প্রযোজক এসব করে, জাস্ট অক্সিজেনের লাইনটা খুলে দিচ্ছেন। তাঁদের মতো মানুষের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে না পারলে অচিরেই সিনেমাকে মৃত ঘোষণা করতে হবে।’

এদিকে চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কেউ কেউ বলছেন, একের পর এক ছবি নির্মাণ করছেন সেলিম খান। তবে সেসব ছবির বেশির ভাগই আলোর মুখ দেখছে না। প্রচার–প্রচারণা ছাড়াই দু-একটা গোপনে সিনেমা হলে মুক্তি পেলেও নিম্নমানের কারণে প্রথম দিনই মুখ থুবড়ে পড়ে এসব সিনেমা। এসব মানহীন চলচ্চিত্র দর্শকদের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করছে। তারপরও এই প্রযোজক এখানে টাকা ঢালছেন কেন? নিশ্চয়ই কোনো চক্রান্ত আছে এখানে তাঁর।

পরিচালক ওয়াজেদ আলী সুমন, জাফর আল মামুন, শফিক হাসান, মুস্তাফিজুর রহমান মানিকসহ অনেক পরিচালকই পিকনিকে যাননি। সুমনের মতে, অবশ্যই চক্রান্ত আছে এই অসৎ ব্যবসায়ীর। তিনি বলেন, ‘চলচ্চিত্রের সব সংগঠনের পরিবার–পরিজন মিলিয়ে আনন্দ আয়োজন করা হয় পিকনিকে। কিন্তু এবারের আয়োজন তো সেলিম খানের অবৈধ টাকায়। শুনলাম, পিকনিকে টাকা দিয়ে তিনি একাই ২০০ দাওয়াত কার্ডও নিয়ে গেছেন। প্রযোজক সমিতির আগামী নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে তাঁর প্রযোজক ভোটারদের দাওয়াত দিয়েছেন। এটি ছিল তাঁর নির্বাচনী মিলনমেলা। এই অবৈধ ব্যবসায়ীর টাকার পিকনিক দেখে, যাইনি আমি।’ তিনি এ–ও বলেন, এই বিতর্কিত প্রযোজকের কোনো শিক্ষা–দীক্ষা নেই। অবৈধ টাকার জোরে সিনেমার মানুষকে জিম্মি করতে চান। এর আগেও দু-একজন অবৈধ ব্যবসায়ী সিনেমায় এসেছিলেন। সিনেমার বারোটা বাজিয়ে আবার চলেও গেছেন। এবার এসেছেন সেলিম খান। তবে তারা বেশি দিন টিকতে পারেননি কোনো দিন, সেলিম খানরাও পারবেন না।

চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির পিকনিক কমিটির আহ্বায়ক ও পরিচালক সমিতির সহসাধারণ সম্পাদক অপূর্ব রানা পরিষ্কার করে কথা বলতে চাননি। তিনি বলেন, ‘পিকনিকের আগে থেকে এসব নিয়ে অনেক ঝামেলা হয়েছে। সেলিম খানের অনুদান নিয়ে পিকনিক করা নিয়ে মতভেদ ছিল। কিন্তু সে–ও তো পরিচালক সমিতির সদস্য। এর বেশি আর কোনো কিছু বলতে চাচ্ছি না। বলতে ভালোও লাগছে না।’

বেশ কিছুদিন ধরেই সেলিম খানের বিরুদ্ধে তাঁর নিজ এলাকায় অবৈধ বালু ব্যবসাসহ নানা ধরনের অনিয়ম–দুর্নীতি করে হাজার হাজার কোটি টাকা আয়ের অভিযোগ উঠেছে। বেশ কিছু গণমাধ্যমে ফলাও করে তা প্রচারও হয়েছে।

চেয়ারম্যান সেলিম খান
ছবি:সংগৃহীত

কে এই সেলিম খান

এক দশকের বেশি সময় ধরে চাঁদপুর সদর উপজেলার ১০ নম্বর লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেলিম খান। বর্তমানে তিনি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগেরও সভাপতি। সর্বশেষ গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে ৯ জন সদস্যসহ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন তিনি। ওই ইউনিয়নের কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, সেলিমের পারিবারিক অবস্থাও তেমন সচ্ছল ছিল না। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে জেলা বিএনপির প্রভাবশালীদের সঙ্গে ওঠাবসা করতেন তিনি। এর আগে জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে সখ্য তৈরি করেন সেলিম খান। এর পর থেকেই ধীরে ধীরে বালু তোলার একচ্ছত্র সম্রাট বনে যান সেলিম।

উল্লেখ্য, শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি চাঁদপুর–৩ (সদর–হাইমচর) আসনের সাংসদ।
সম্প্রতি লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমি অধিগ্রহণে সেলিম খানের নাম নতুন করে আলোচনায় আসে। অভিযোগ উঠেছে, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রস্তাব করা জায়গার বড় অংশটি নামে-বেনামে কিনে নেন তিনি। এসব জমির দলিল করতে গিয়ে মৌজা দরের চেয়ে ২০ গুণ বেশি মূল্য দেখানো হয়েছে। সরকারের কাছ থেকে কৌশলে বিপুল টাকা হাতিয়ে নেওয়াই এর কারণ। যাঁদের কাছ থেকে জমি নেওয়া হয়েছে, তাঁরা নামমাত্র টাকা পেয়েছেন বলে অভিযোগ। বালুর ব্যবসায় নামার পর সেলিম খানের বিপুল সহায়-সম্পত্তি নিয়ে এলাকায় নানা কথা প্রচার আছে। বালুমহালের টাকা দিয়ে সিনেমায় লগ্নি করেছেন তিনি। এরই মধ্যে তাঁর প্রযোজিত একাধিক সিনেমা মুক্তিও পেয়েছে।

২০১৯ সালে দেশব্যাপী ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানকালে সেলিমের নাম আলোচনায় আসে। যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাটের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত সেলিম কিছুদিন আত্মগোপনে ছিলেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়।