নির্মাতাদের ফিল্ম আর্কাইভে যেতে হবে

পুরোনো ফিল্ম পরখ করে দেখছেন আর্কাইভের একজন কর্মী।প্রথম আলো

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘সুতরাং’ ছবির প্রিন্ট কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না। স্বয়ং পরিচালক সুভাষ দত্তও বলতে পারছিলেন না, কোথায় পাওয়া যাবে সেটি। দীর্ঘদিন পর জানা গেল, পুরান ঢাকার বংশালের একজনের কাছে একটি ডিউপ নেগেটিভ আছে। বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের এক কর্মকর্তা সেটি সংগ্রহের চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে ফিল্ম আর্কাইভের হাতে আসে সেটি আর সঙ্গে সঙ্গে প্রিন্ট করা হয়। সংরক্ষণ করা হয় আর্কাইভের সিন্দুকে। এভাবেই সংরক্ষিত হয় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা।

বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ পেরিয়েছে ৪২ বছর।

বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ পেরিয়েছে ৪২ বছর। ধানমন্ডি, কলেজগেট হয়ে রাজধানীর শাহবাগে বাংলাদেশ বেতার ভবনে কিছুদিন থিতু হয়েছিল ফিল্ম আর্কাইভের কার্যালয়। এখন সেটি আগারগাঁওয়ের প্রশাসনিক এলাকায়, একেবারে ঝাঁ-চকচকে সাততলা ভবনজুড়ে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে কথার ফাঁকে ফিল্ম আর্কাইভের ফিল্ম অফিসার ফখরুল আলম স্মৃতিচারণা করে বললেন, ‘আমি সম্ভবত নেগেটিভের ১৩টি ক্যান পেয়েছিলাম। সেগুলো নিয়ে আসি আর্কাইভে। স্যাররা দেখে পরদিনই এফডিসিতে পাঠিয়ে দেন প্রিন্ট করার জন্য। আমরা সবাই উচ্ছ্বসিত। ফিল্ম আর্কাইভের ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ সংরক্ষণ করছে। প্রিন্ট করে আনার পর ঘোষণা দিলাম, “সুতরাং” ছবির প্রিন্ট উদ্ধার করা হয়েছে। একটা ছোট্ট প্রদর্শনীরও আয়োজন করা হলো। প্রদর্শনীতে কবরী, সুভাষ দত্তরা সবাই এলেন। দত্তদা আমাকে ধরে আনন্দে সে কী কান্না।’

‘সুতরাং’ ছবিতে প্রথম নায়ক সুভাষ দত্ত ও নায়িকা কবরী

‘সুতরাং’ ছবিটি নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এই ছবির মাধ্যমে পরিচালক ও অভিনেতা হিসেবে অভিষেক হয় সুভাষ দত্তের। প্রয়াত অভিনেত্রী কবরীরও প্রথম সিনেমা এটি। সুরকার ও সংগীত পরিচালক সত্য সাহার সংগীত পরিচালনায় প্রথম ছবি এটি। এই ছবি দিয়ে চলচ্চিত্রের প্লেব্যাকে বেশ আলোচিত হয়েছিলেন ফেরদৌসী রহমান ও মুস্তাফা জামান আব্বাসী।

শুধু ‘সুতরাং’ নয়, ফিল্ম আর্কাইভের আধুনিক সিন্দুকে থরে থরে সাজানো ধ্রুপদি সব সিনেমা। ফিল্ম আর্কাইভ সূত্র জানিয়েছে, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত সেই সিন্দুকে আছে দেশ–বিদেশের তিন হাজারের বেশি চলচ্চিত্র। আছে পূর্ণদৈর্ঘ্য, স্বল্পদৈর্ঘ্য, প্রামাণ্যচিত্র ও সংবাদচিত্রের প্রিন্ট, ডিউপ নেগেটিভ ও নেগেটিভ। আছে ‘স্টপ জেনোসাইড’, ‘নদী ও নারী’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’সহ প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’, কাজী নজরুল ইসলাম অভিনীত সিনেমা ‘ধ্রুব’। এ ছাড়া প্রমথেশ বড়ুয়ার ‘দেবদাস’, রাশিয়ার সের্গেই আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটেলশিপ পটেমকিন’, জাপানের আকিরা কুরোসাওয়ার ‘রশোমন’-এর মতো ধ্রুপদি ছবিও রয়েছে এখানে। অনুমতি নিয়ে এসব ছবি উপভোগ করার সুযোগ আছে।

শুধু ‘সুতরাং’ নয়, ফিল্ম আর্কাইভের আধুনিক সিন্দুকে থরে থরে সাজানো ধ্রুপদি সব সিনেমা। ফিল্ম আর্কাইভ সূত্র জানিয়েছে, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত সেই সিন্দুকে আছে দেশ–বিদেশের তিন হাজারের বেশি চলচ্চিত্র। আছে পূর্ণদৈর্ঘ্য, স্বল্পদৈর্ঘ্য, প্রামাণ্যচিত্র ও সংবাদচিত্রের প্রিন্ট, ডিউপ নেগেটিভ ও নেগেটিভ।

শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের বিখ্যাত সব চলচ্চিত্রের মাস্টার স্ক্রিপ্ট বা চিত্রনাট্যের মূল কপি সংরক্ষিত আছে আর্কাইভে। চিত্রনাট্যগুলো দেখার অভিজ্ঞতা বলে দেবে বিখ্যাত চলচ্চিত্রকারদের শট ডিভিশন, ফুটনোট ও কাজের ধরন। আর্কাইভ সূত্র জানিয়েছে, ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘সারেং বউ’, ‘সুপ্রভাত’, ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’, ‘সুজন সখী’, ‘নদী ও নারী’সহ প্রায় দুই হাজারের বেশি চিত্রনাট্য ও মাস্টার স্ক্রিপ্ট পাওয়া যাবে আর্কাইভে। কিন্তু আক্ষেপ নিয়ে সেখানকার এক কর্মকর্তা জানান, তরুণ চলচ্চিত্রকার থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এসব চিত্রনাট্য নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি।

আর্কাইভে আছে ৫০ হাজার ৪৩টি দেশি-বিদেশি চলচ্চিত্রের বই।
প্রথম আলো

আর্কাইভ সূত্র জানিয়েছে, সেখানে আছে চলচ্চিত্রের বই ও নথিতে সমৃদ্ধ একটি ডুপ্লেক্স লাইব্রেরি। সব মিলিয়ে এখন ৬৫ হাজারের বেশি ডকুমেন্ট রয়েছে সেখানে। এর মধ্যে ৫০ হাজার ৪৩টি দেশি-বিদেশি চলচ্চিত্রের বই। আছে চলচ্চিত্রের পোস্টারের বই। এ ছাড়া আর্কাইভে করা হয়েছে একটি ফিল্ম মিউজিয়ামও।

ফিল্ম আর্কাইভের মহাপরিচালক নিজামুল কবীর

ফিল্ম আর্কাইভের মহাপরিচালক নিজামুল কবীর বলেন, ‘এর আগে চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট মানুষদের আসার, পাঠ করার বা এখন থেকে কিছু নেওয়ার মতো অবকাঠামোগত সুযোগ ছিল না। ছোট ছোট বাড়িতে আর্কাইভ ছিল। সেখানে লাইব্রেরিও ছিল না। এই মুহূর্তে আমাদের সুপরিসর লাইব্রেরি আছে। চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট মানুষের যাতায়াত এখন অন্য সময়ের তুলনায় বেড়েছে। একই সঙ্গে বলতে চাই, আমাদের সমগ্র চলচ্চিত্রের অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। মেধাবী চলচ্চিত্রকাররা চলে যাচ্ছেন, সিনেমা হলের সংখ্যা কমে গেছে। চলচ্চিত্র তৈরির আগ্রহ ও বিনোয়োগও কমে গেছে।

করোনার একটা প্রভাব তো আছেই। তারপরও আমি বলব, আমরা যখন চলচ্চিত্র নিয়ে সেমিনার করি, তখন আমাদের এখানে পরিচালকেরা আসেন। হয়তো অনেকে ফিল্ম আর্কাইভ সম্পর্কে জানেন না কিংবা অবস্থানের কারণেও হয়তো কম আসছেন।

তবে আমি আশাবাদী। আমি চেষ্টা করব, চলচ্চিত্রকারদের আগ্রহ বাড়ানোর জন্য কাজ করতে। আশা করি, এই মুহূর্তে যে অবস্থায় আছে, সেখান থেকে আস্তে আস্তে উন্নতি হবে। আমরা ফিল্ম আর্কাইভ নিয়ে যে স্বপ্ন দেখি, তা বাস্তবায়িত হবে।’

মতিন রহমান
প্রথম আলো

চলচ্চিত্র পরিচালক মতিন রহমান বলেন, ‘তরুণ চলচ্চিত্রকারেরা প্রয়োজন মনে করেনি, তাই সেখানে যায় না! কিন্তু তরুণ নির্মাতাদের ফিল্ম আর্কাইভে যেতে হবে। একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, ইতিহাস থেকেও অনেক কিছু শেখার আছে। আমজাদ হোসেন তাঁর চিত্রনাট্য কীভাবে করেছেন, সেটাও জানার বিষয়।’