টাকা নিয়ে কাজে গড়িমসি চলছেই

১৯৭৬-৭৭ অর্থবছরে চলচ্চিত্রে সরকারি অনুদান প্রথা চালু হয়। সে বছর অনুদান পাওয়া সূর্য দীঘল বাড়ী ও এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী খুব প্রশংসিত হয়
১৯৭৬-৭৭ অর্থবছরে চলচ্চিত্রে সরকারি অনুদান প্রথা চালু হয়। সে বছর অনুদান পাওয়া সূর্য দীঘল বাড়ী ও এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী খুব প্রশংসিত হয়

চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য অনুদান নিয়ে বছরের পর বছর পার হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু অনেক ছবি শেষ হচ্ছে না। প্রতি অর্থবছরেই এমন ঘটনা ঘটছে। গত এক দশকে সরকারি অনুদান পাওয়া ২৫টি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি মুক্তি পায়নি। ফলে এসব ছবির জন্য বরাদ্দ টাকা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। চলচ্চিত্র অনুদান নীতিমালায় বলা আছে, অনুদানের প্রথম চেক প্রাপ্তির ৯ মাসের মধ্যে ছবির কাজ শেষ করতে হবে।

ছবি শেষ না করার কারণে এরই মধ্যে তথ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট পরিচালক বা প্রযোজকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা এখন কঠোর অবস্থান নিয়েছি। সরকারি টাকা অপচয়ের কোনো সুযোগ নেই। প্রথম কিস্তির টাকা নিয়ে ছবি বানাননি এমন পরিচালকদের দ্বিতীয় কিস্তি দেওয়া হয়নি। ব্যক্তি, দল বিবেচনায় না এনে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’

চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, চলচ্চিত্রশিল্প উন্নয়নে আর্থিক অনুদানের ইতিবাচক ভূমিকা আছে। ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছর থেকে দেশীয় চলচ্চিত্রে সরকারি অনুদানের প্রথা চালু হয়। সে বছর অনুদান পাওয়া মসিহ্উদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলীর সূর্য দীঘল বাড়ী ও বাদল রহমানের এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী খুব আলোচিত হয়।

২০০৭ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত নিয়মিতভাবে চলচ্চিত্রে অনুদান দেওয়া হচ্ছে। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে অনুদান পাওয়া রাবেয়া ও রূপান্তর মুক্তি পেয়েছে। তবে এনামুল করিম নির্ঝরের নমুনা ছবিটি মুক্তি পায়নি। জানা গেছে, ছবির নির্মাণ চূড়ান্ত করেছিলেন পরিচালক। তবে সেন্সর বোর্ড থেকে এই ছবির সিংহভাগ গল্প পরিবর্তন করতে বলা হয়েছিল। এখন ছবির ভাগ্য পুরোপুরিই অনিশ্চিত।

২০০৮-০৯ অর্থবছরে অনুদান পাওয়া আমার বন্ধু রাশেদ ও মধুমতি (আত্মদান) মুক্তি পেয়েছে। স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের কাল না বানানোর কারণে তথ্য মন্ত্রণালয় পরিচালক জুনায়েদ হালিমের বিরুদ্ধে মামলা করে। এই পরিচালক বলেন, ‘আমি একাধিকবার অনুদানের টাকা ফেরত দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মন্ত্রণালয় মামলা করে। আমি মামলা ফেস করব না। হয় ছবি বানিয়ে শেষ করব বা টাকা ফেরত দেব।’

২০০৯-১০ অর্থবছরে অনুদান পাওয়া গেরিলা, অনিশ্চিত যাত্রা, একই বৃত্তে, ছেলেটি (আকাশ কত দূরে) ও কাজলের দিনরাত্রি মুক্তি পেয়েছে। মুক্তি পায়নি সূচনারেখার দিকে। পরিচালক আখতারুজ্জামান মারা গেছেন ২০১১ সালের আগস্টে। ছবির অভিনেত্রী স্বাগতা বলেন, পরিচালক ছবির প্রায় সব কাজই শেষ করেছেন। পোস্ট প্রোডাকশনের কিছু কাজ বাকি ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর কেউ দায়িত্ব নিয়ে কাজটি শেষ করেনি।

২০১০-১১ অর্থবছরে অনুদানপ্রাপ্ত পাঁচটি ছবি মুক্তি পেয়েছে-শোভনের স্বাধীনতা, বৃহন্নলা, নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ, মুক্তি ও ধোঁকা (হরিজন)। এখনো আলোর মুখ দেখেনি ফারুক হোসেনের কাকতাড়ুয়া। পরিচালকের দাবি, ছবির কাজ পুরোপুরি শেষ। আগামী দু-এক মাসের ভেতর সেন্সর বোর্ডে জমা দেবেন।

২০১১-১২ অর্থবছরে অনুদান পাওয়া জীবনঢুলি, মৃত্তিকা মায়া ও হেডমাস্টার মুক্তি পেয়েছে। একা একার পরিচালক সৈয়দ সালাউদ্দীন জাকী বলেন, অসুস্থতার কারণে তিনি ছবিটি বানাতে পারবেন না। তথ্য মন্ত্রণালয় তাঁকে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের পরামর্শ দিয়েছে। এখন সেই প্রস্তুতিই তিনি নিচ্ছেন। মারুফ হাসানের নেকড়ে অরণ্যেও মুক্তি পায়নি। হডসনের বন্দুক-এর পরিচালক প্রশান্ত অধিকারী দাবি করেন, ছবির আবহসংগীতের প্রস্তুতি চলছে। বলেন, অনুদানের বরাদ্দের অর্থে ছবির কাজ শেষ করা কঠিন। তিনি নিজের চিত্রকর্ম বিক্রি করে ছবির কাজ শেষ করেছেন।

২০১২-১৩ অর্থবছরে অনুদানের ছবি একাত্তরের মা জননী, মান্নান হীরার একাত্তরের ক্ষুদিরাম, মেঘমল্লার ও খাঁচা মুক্তি পেয়েছে। নির্মাতা তারেক মাসুদের মৃত্যুর পর কাগজের ফুল ছবির ভবিষ্যৎ পুরোপুরি অনিশ্চিত হয়ে গেছে। অনুদানের টাকা ফেরত দিতে চাইছেন ক্যাথরিন মাসুদ। বাকি দুজন পরিচালকের বিরুদ্ধে তথ্য মন্ত্রণালয় মামলা করেছে। কাঁটার পরিচালক টোকন ঠাকুরকে বেশ কিছুদিন অর্থায়নের জন্য সহপ্রযোজক খুঁজতে দেখা গেছে। এখনো চিত্র ধারণের কাজ চলছে। যৈবতী কন্যার মন-এর পরিচালক নারগিস আক্তার বলেছেন, তাঁর ছবির চিত্র ধারণ শেষ। কালার কারেকশন, আবহসংগীতের কাজ বাকি। এ বছরের শেষে ছবিটি মুক্তি দেওয়া যাবে।

২০১৩-১৪ অর্থবছরের পাঁচটি অনুদানের ছবি মুক্তি পেয়েছে-সুতপার ঠিকানা, লাল চর, মহুয়া সুন্দরী, লাল সবুজের সুর, ছিটকিনি। জাঁনেসার ওসমানের পঞ্চসঙ্গীর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। কাঁসার থালায় রুপালি চাঁদ ছবির কাজ শেষ হয়েছে বলে দাবি করেছেন পরিচালক ড্যানি সিডাক। তবে মুক্তি কবে, তা জানাতে পারেননি।

২০১৪-১৫ অর্থবছরে অনুদানপ্রাপ্ত ভুবন মাঝি ও রীনা ব্রাউন মুক্তি পেয়েছে। আগামী ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে লাল মোরগের ঝুঁটির শুটিংয়ের কাজ শেষ হবে বলে জানিয়েছেন পরিচালক নূরুল আলম আতিক। চন্দ্রাবতী কথার পরিচালক এন রাশেদ চৌধুরী জানালেন, ছবির কাজ শেষ, বাইরে বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। শিগগিরই সেন্সর বোর্ডে জমা দেওয়া হবে। বিউটি সার্কাস-এর পরিচালক মাহমুদ দিদার বলেন, ছবির কাজ শেষ পর্যায়ে। সম্পাদনা ও ডাবিং বাকি। মায়া: দ্য লস্ট মাদার-এর পরিচালক মাসুদ পথিকও দাবি করেন, কাজ শেষ পর্যায়ে, কিছুটা সম্পাদনা বাকি। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে সেন্সরের জন্য জমা দেওয়া হবে।

২০১৫-১৬ অর্থবছরে অনুদান পাওয়া আঁখি ও তার বন্ধুরা ও গহিন বালুচর মুক্তি পেয়েছে। মাকসুদ হোসাইন ও জয়া আহসানের দেবীর প্রচারের কাজ চলছে, এটি এখন মুক্তির অপেক্ষায়। সাবিত্রীর পরিচালক পান্থ প্রসাদ কাঙ্ক্ষিত চরিত্রের শিল্পী না পাওয়া, অর্থস্বল্পতাসহ বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করে বলেন, শুটিং এখনো শুরু হয়নি। কামার আহমাদ সাইমনের শঙ্খধ্বনি (শিকলবাহা) এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। জানুয়ারির দিকে এই ছবির শুটিং শুরু হবে বলে জানিয়েছেন নির্মাতা। বৃদ্ধাশ্রম ছবির পরিচালক স্বপন সাহা বর্তমানে দেশের বাইরে আছেন। ছবিটির অভিনয়শিল্পী এস ডি রুবেল দাবি করেন, ছবিটি এখন তিনি পরিচালনা করছেন। ছবির ৫০-৬০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আগামী মাসে বাকি শুটিং শুরু হবে।

২০১৬-১৭ অর্থবছরে অনুদানের জন্য নির্বাচিত ছবিগুলোর মধ্যে শাহরিয়ার সুমিতের নোনাজলের কাব্য, তানভীর মোকাম্মেলের রূপসা নদীর বাঁকের শুটিং চলছে। শবনম ফেরদৌসীর আজব সুন্দর-এর কাজ শুরু হয়নি, প্রি-প্রোডাকশন চলছে। সোহানুর রহমান সোহানের প্রিয় জন্মভূমির কাজও প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। গান রেকর্ডিং হয়েছে। অভিনয়ের জন্য শিশুশিল্পী খুঁজছেন পরিচালক। দায়মুক্তির পরিচালক কমল সরকার জানালেন, প্রযোজকের উদাসীনতায় ছবির কাজই শুরু করতে পারেননি তিনি।

সর্বশেষ গত জুনে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য সরকারি অনুদানপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করেছে তথ্য মন্ত্রণালয়। এবার অনুদান পেয়েছে গাজী রাকায়েতের গোর, সাইদুল আনাম টুটুলের কালবেলা, হাবিবুর রহমানের পরিচালনায় অলাতচক্র, মানিক মানবিকের শিশুতোষ ছবি আজব ছেলে ও আবিদ হোসেন খানের প্রামাণ্যচিত্র অবলম্বন। প্রামাণ্যচিত্রটি অনুদান হিসেবে পাবে ৪০ লাখ টাকা। আর কাহিনিচিত্রগুলো পাবে ৬০ লাখ টাকা করে।

পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র অনুদান কমিটির সদস্য নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, ‘অর্থের পরিমাণসহ সব বিষয়ে জেনেশুনেই সবাই আবেদন করছেন। সে ক্ষেত্রে নির্মাণের ব্যাপারে নির্মাতাদের আরও বাস্তবমুখী হতে হবে। যাঁরা অনুদান নিয়ে বছরের পর বছর ছবির কাজ শেষ করছেন না, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। টাকাটা কিন্তু জনগণের।’

অনুদান কমিটির সদস্য ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন ও চলচ্চিত্র) আজহারুল হক বলেন, বগত বছরগুলোতে অনুদান নিয়ে যাঁরা ছবির কাজ শেষ করেননি, পর্যায়ক্রমে সবার কাছে চিঠি পাঠানো হচ্ছে।