কেমন আছে অভিনেতা নাসির খানের পরিবার
‘মুরব্বিরা যা বলে বুদ্ধিমানরা সেই মতোই চলে’, ‘মামা বলত ভাগনে বেশি লোভ করিসনে’, ‘আমার দুঃখ আছে কিন্তু কষ্ট নাই’; জনপ্রিয় এই সংলাপগুলো নব্বইয়ের দশক ও পরবর্তী সময়ের ঢালিউড দর্শকদের মনে আছে হয়তো। সংলাপগুলো শোনেননি এমন দর্শক কম মিলবে। এই সংলাপগুলো শোভা পেয়েছিল খল অভিনেতা নাসির খানের মুখে। প্রয়াত এই অভিনেতার আজ জন্মদিন। ২০০৭ সালে তিনি মারা যান। প্রিয় মানুষটিকে ছাড়া ১৫ বছর কেমন আছে তার পরিবার?
পুরান ঢাকার বাংলাদেশ ব্যাংক কলোনির ঠিক পাশের গলি। এই এলাকায় ছিলেন নাসির খান। এলাকার সবার কাছে তিনি ছিলেন প্রিয়, পছন্দের মানুষ। অনেকেই তাঁর বাড়ি দেখতে আসতেন। সেই বাড়ির বারান্দায় দাঁড়ালে এখনো শোনা যায় রিকশা থেকে কেউ বলছেন, ওই দেখ নাসির খানের বাড়ি, এই বাড়ি নাসির খানের। এই অভিনেতার মৃত্যুর পর সেই বাড়িতেই তিন মেয়েকে বড় করেছেন অভিনেতা নাসির খানের স্ত্রী মেহেরুন্নেসা স্বপ্না।
পরিবারের গুরুত্বপূর্ন সদস্য ছাড়া কেমন কাটছে দিনগুলো? এমন প্রশ্নে কিছুটা নীরবতা।
পরে মেহেরুন্নেসা বলতে থাকেন, ‘তিন মেয়েকে বড় করা খুবই কঠিন ছিল। একাই তাঁদের মা–বাবার স্নেহ দিয়ে মানুষ করেছি। যখন যেভাবে পেরেছি, তাদের সেভাবে সবটা দিয়ে মানুষ করেছি, এখনো করছি। ওদের বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো মেয়েগুলোর শৈশব, বেড়ে ওঠা, জীবনযাপন, পড়াশোনাও হয়তো অন্য রকম হতে পারত। তবে আমি মেয়েদের তাদের বাবার আদর্শেই মানুষ করেছি। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। ছোট মেয়ে ও–লেভেলে পড়ছে। যতটা পেরেছি, তাদের সামনে এগোনোর স্বপ্ন দেখিয়েছি। আমরা ভালো আছি। তারপরও তাঁর অভাব আমাদের বিশাল অংশজুড়ে সব সময়ই আছে।’
নাসির খানের তিন মেয়ের বড় দুজন—নাছিমা খানম মমতা ও ফাহিমা খানম শর্মিতা বাবাকে পেয়েছেন। তবে এই অভিনেতা মারা যাওয়ার সময় তাঁর ছোট মেয়ে মহিমা খানম নিশিতা তখন এক বছরের শিশু। বাবার কোনো স্মৃতিই তার কাছে নেই। বাবার গল্প শুনেছে অন্যদের কাছে। তাই বাবাকে টেলিভিশনে দেখলে মন খারাপ হয় তার। এই কষ্ট বাবা ডাকতে না পারার। তবে বাবা যে এখনো ভক্তদের অন্তরে আছেন, সেটা বাইরে গেলে বুঝতে পারেন নিশিতা। ভক্তদের এই ভালোবাসায় তাঁরা কৃতজ্ঞ।
ছোট মেয়ে বলে, ‘আমি অভিনেতা নাসির খানের মেয়ে এই পরিচয়ে গর্বিত। বাবাকে মিস করি। হয়তো আজ বাবা বেঁচে থাকলে আমাদের জীবন অন্য রকম হতে পারত। বাবা আমাদের নিয়ে ঘুরতে যেতেন, বাবার আদর পেতাম।’
শৈশবে অভিনেতা বাবার হাত ধরে স্কুলে গিয়েছেন বড় দুই মেয়ে। মেজ মেয়ে ফাহিমা খানম শর্মিতার মনে সেই স্মৃতিগুলো এখনো ভেসে ওঠে। বিশেষ দিনগুলোতে বাবা না থাকার কষ্ট আরও বাড়িয়ে দেয়। শর্মিতা বলেন, ‘বাবা অনেক ব্যস্ত থাকতেন। তারপরও আমাদের দুই বোনকে হাত ধরে স্কুলে নিয়ে যেতেন, পরীক্ষার হলে দিয়ে আসতেন। কখনো নিয়ে আসতেন। প্রতি শুক্রবার ঘুরতে নিয়ে যেতেন। কখনো দেশের বাইরে নিয়ে যেতেন। বাবার সঙ্গে আমাদের সময়গুলো অন্য রকম ছিল। আজ বাবা থাকলে হয়তো বাবার জন্মদিন নিয়ে মেতে থাকতাম। বাবাকে বলতাম শুটিংয়ে যেতে পারবে না।’
বাবা মারা যাওয়ার পর ১৫ বছর বাবার ছবি দেখেন না শর্মিতা। বাবাকে পর্দায় দেখলে তাঁর কষ্ট হয়। তবে এখনো পরিবারের অন্যদের নিয়ে বাংলা সিনেমা দেখেন। বুঝতে পারেন বাংলা সিনেমায় খল অভিনেতার সংকট। তখন বাবার কথা মনে পড়ে। শর্মিতা বলেন, ‘বাবা খলচরিত্রে অভিনয় করলেও বাস্তবে সহজ–সরল জীবন যাপন করতেন। শুটিং বলেন, আর এলাকার আত্মীয়স্বজনই বলেন, সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন। গত ১৫ বছরে কখনোই বাবাকে নিয়ে কারও মুখে খারাপ কথা শুনিনি। আজ বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো অন্য উচ্চতায় থাকতেন। সংকটের দিনগুলো দেখতে হতো না।’
দীর্ঘ ২৭ বছরের ক্যারিয়ারে নাসির খান ‘এই ঘর এই সংসার’, ‘মায়ের অধিকার’, ‘সাক্ষাৎ’, ‘বিক্ষোভ’, ‘অন্তরে অন্তরে’, ‘দেনমোহর’, ‘স্বপ্নের নায়ক’, ‘গরিবের রাণী’সহ পাঁচ শতাধিক সিনেমায় অভিনয় করেছেন। খলচরিত্রে অভিনয় করেই তিনি জনপ্রিয়তা পান। নাসির খানের জন্ম ১৯৫৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর, পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায়। ২০০৭ সালের ১২ জানুয়ারি মাত্র ৪৭ বছর বয়সে মারা যান নাসির খান। এক–এগারোর পরের দিন তাঁর মৃত্যু হওয়ার খবরটা সেভাবে মিডিয়ার প্রচার হয়নি। এখনো তাঁর ভক্তরা অনেকে মনে করেন এই অভিনেতা বেঁচে আছেন। নাসির খানের স্ত্রী জানালেন, পরিবার ছাড়া চলচ্চিত্র অঙ্গনে সেভাবে তাঁকে স্মরণ করা হয় না। আজ জন্মদিনে পরিবার থেকে দোয়া ও এতিমদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
(লেখাটি ২০২২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর বিনোদনে প্রকাশিত হয়েছিল। আজ প্রয়াত অভিনেতা নাসির খানের জন্মদিনে আবার প্রকাশ করা হলো)