জহির রায়হানের ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ এখন কোথায়
‘লেট দেয়ার বি লাইট’ সিনেমাকে নিজের স্বপ্নের সিনেমা বলতেন চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান। ১৯৭০ সালে সিনেমার আংশিক দৃশ্যধারণও করেছিলেন, তবে শেষ করে যেতে পারেনি। ছবির ফুটেজগুলো কোথায়?
১৯৬৯ সালে ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ নির্মাণের ঘোষণা দেন চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান। ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ছবির মহরতে তিনি বলেছিলেন, এটি তাঁর স্বপ্নের সিনেমা।
মহরতে নায়ক-নায়িকা হিসেবে ওমর চিশতি ও অলিভিয়া গোমেজকে পরিচয় করিয়ে দেন নির্মাতা। সিনেমার দৃশ্যধারণ শুরুর আগে নাটকীয়ভাবে নায়িকা বদল করেন জহির রায়হান। অলিভিয়াকে বাদ দিয়ে ববিতাকে চূড়ান্ত করেন তিনি।
ধর্ম, বর্ণ, জাতি ও সংস্কৃতির নামে বিশ্বজুড়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার মানুষের আর্তনাদ তুলে ধরতে ১৯৭০ সালের আগস্টের দিকে দৃশ্যধারণে হাত দেন নির্মাতা। সিনেমার চিত্রগ্রহণও করেছেন জহির রায়হান।
সিনেমায় ববিতার চরিত্রের নাম ছিল ইভা, ওমর চিশতির চরিত্রের নাম তপু। ওমর চিশতি বাঙালি ছিলেন না, তাঁর জন্ম ও বেড়ে উঠা লাহোরে। বাবার চাকরির সূত্রে ঢাকায় থাকতেন।
ছবিটির শুটিংয়ের মাঝে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদাররা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছে। সিনেমার কাজে বিরতি টেনে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে এপ্রিল মাসে ঢাকা ছেড়েছেন জহির রায়হান। একাত্তরের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চারটি প্রামাণ্যচিত্র প্রযোজনা করেন তিনি। এর ভেতর ‘স্টপ জেনোসাইড’ ও ‘আ স্টেট ইজ বর্ন’-এর পরিচালকও ছিলেন তিনি।
স্বাধীনতার পর ঢাকায় ফেরেন জহির রায়হান। মিরপুরে বড় ভাই শহীদুল্লা কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন এই নির্মাতা। স্বপ্নের ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ সিনেমাটি শেষ করে যেতে পারেননি জহির রায়হান।
একটা দৃশ্যে দেখা যায়, আমাদের ঘরবাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে, ঘরের গ্লাস ভেঙে যায়। আমরা প্রাণপণে দৌড়াচ্ছি।ববিতা
শুটিংয়ের স্মৃতি
এফডিসির ২ নম্বর ফ্লোরে সিনেমার সেট বানানো হয়েছিল। ভেতরে বাড়িঘর, গির্জা ছিল। ফ্লোরের পাশাপাশি এফডিসির ভেতরের বিস্তৃত মাঠেও দৃশ্য ধারণ হয়েছে।
তবে সিনেমার কত ভাগ দৃশ্যধারণ হয়েছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে সবটা এফডিসিতেই হয়েছে। ববিতা স্মৃতি হাতড়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটা দৃশ্যে দেখা যায়, আমাদের ঘরবাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে, ঘরের গ্লাস ভেঙে যায়। আমরা প্রাণপণে দৌড়াচ্ছি।’
এটি ইংরেজি ভাষায় শুটিং করা হয়েছে। শিল্পীরা ইংরেজিতে সংলাপ দিয়েছেন। তবে কোনো চিত্রনাট্য ছিল না। জহির রায়হান তাৎক্ষণিকভাবে সংলাপ ও দৃশ্য বুঝিয়ে দেন শিল্পীদের।
ববিতার স্বামীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন ওমর চিশতি। সিনেমার বেশির ভাগ দৃশ্যেই ববিতা ও ওমর ছিলেন।
তাঁরা ছাড়াও বনানী চৌধুরী, গোলাম মুস্তাফা আমজাদ হোসেনসহ আরও অনেকে অভিনয় করেছেন।
পরিচালনার পাশাপাশি কাহিনি, চিত্রনাট্যেও ছিলেন জহির রায়হান। ফিল্ম ইন্টারন্যাশনালের ব্যানারে নির্মিত সিনেমাটির অন্যতম প্রযোজকও ছিলেন এই নির্মাতা। সংগীত পরিচালনা করেছেন আলতাফ মাহমুদ।
ছবির ফুটেজ পড়ে ছিল এফডিসির গোডাউনে
স্বাধীনতার পর প্রায় সাড়ে তিন দশকেও সিনেমাটির খোঁজ ছিল না। অসমাপ্ত ছবিটি ৩৫ মিমিতে শুট করা হয়; অনেকটা অংশের দৃশ্যধারণ বাকি ছিল। ডাবিং, সম্পাদনা—কিছুই করা হয়নি।
‘জীবন থেকে নেয়া’সহ জহির রয়হানের বেশির ভাগ সিনেমা ও প্রামাণ্যচিত্রই বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে। তবে ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ ছিল না, ফিল্ম অফিসার ফখরুল আলম সিনেমাটির খোঁজে নামেন; খোঁজাখুঁজির পর জানতে পারেন, এফডিসির গোডাউনে ছবির ফুটেজ রয়েছে।
তখন ফিল্ম আর্কাইভের মহাপরিচালক ছিলেন জাহাঙ্গীর হোসেন, কার্যালয় ছিল শাহবাগে। এফডিসির সঙ্গে দফায় দফায় চিঠি–চালাচালির পর দেড় দশক আগে গোডাউন থেকে সিনেমার ফুটেজ উদ্ধার করে ফিল্ম আর্কাইভ। হারিয়ে যাওয়া সিনেমাটি নিয়ে আশার সঞ্চার ঘটে।
ফখরুল আলম গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে জানান, তখনো ফুটেজগুলো ভালো ছিল, নষ্ট হয়ে যাওয়ার আগেই ডিজিটালে রূপান্তরের পরিকল্পনা করে ফিল্ম আর্কাইভ। স্ক্যান করার পর সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার ফুটেজ পাওয়া যায়; সেখানে ‘ওকে’ শটের সঙ্গে ‘এনজি’ শটও ছিল।
জহির রায়হানের ‘স্টপ জেনোসাইড’-এর চিত্রসম্পাদক আবু মুসা দেবুকে দিয়ে ‘ওকে’ শটগুলো আলাদা করানো হয়। ‘এনজি’ শট বাদে লেট দেয়ার বি লাইট সিনেমার দেখানোর উপযোগী অংশের দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ৫৫ মিনিট। ডাবিং করা ছিল না, ফলে সিনেমার অংশটুকু নির্বাক ছিল।
এর পর থেকেই ফিল্ম আর্কাইভে সিনেমাটির ৫৫ মিনিট সংরক্ষিত আছে, সঙ্গে পাঁচ ঘণ্টার ফুটেজ ও ৩৫ মিমি ফুটেজও আছে। মাঝে কয়েকবার অসমাপ্ত ছবিটি শেষ করার পরিকল্পনা করা হলেও তা সম্ভবপর হয়নি।
ছবিটি ফিল্ম আর্কাইভের নয়, জহির রায়হানের উত্তরাধিকারদের। আমাদের অনুমতি না নিয়ে শো করতে চেয়েছিল ফিল্ম আর্কাইভ। ফলে আমি আপত্তি জানিয়েছিলাম।সুচন্দা
ছবিটি এখনও দর্শকের সামনে আসেনি
উদ্ধারের পর দেড় দশকেও ছবিটি দর্শকের সামনে প্রদর্শিত হয়নি। ২০১৯ সালের ১২ মে ছবিটি প্রথমবারের মতো জনসাধারণের সামনে প্রদর্শনের উদ্যোগ নিয়েছিল ফিল্ম আর্কাইভ। দিনক্ষণ চূড়ান্ত করে কার্ডও ছাপা হয়েছিল। তবে জহির রায়হানের পরিবারের আপত্তিতে শেষ মুহূর্তে সেই প্রদর্শনী বাতিল করা হয়। ফলে ছবির অংশবিশেষ এখনো দেখার সুযোগও পাননি দর্শকেরা।
পরিবারের আপত্তির বিষয়ে জহির রায়হানের স্ত্রী সুচন্দা গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছবিটি ফিল্ম আর্কাইভের নয়, জহির রায়হানের উত্তরাধিকারদের। আমাদের অনুমতি না নিয়ে শো করতে চেয়েছিল ফিল্ম আর্কাইভ। ফলে আমি আপত্তি জানিয়েছিলাম।’
সুচন্দার ভাষ্য, ‘আমরাও চাই সিনেমাটি আলোর মুখ দেখুক। তবে ছবিটির শুটিং শেষ হয়নি; এডিট, ডাবিং কিছুই হয়নি। রাশ প্রিন্ট জোড়াতালি দিয়ে ডকুমেন্টারির মতো করে তারা প্রদর্শনী করতে চেয়েছিল। এটা কীভাবে করা যায়? আমরা বিষয়টি কেউই জানতাম না।’
তবে চলচ্চিত্র বিশ্লেষকেরা বলছেন, জহির রায়হানের স্বপ্নের সিনেমাটি সমাপ্ত করে দর্শকদের দেখানোর ব্যবস্থা করা দরকার।
অসমাপ্ত ছবিটি কি শেষ করা সম্ভব
জহির রায়হান সিনেমার চিত্রনাট্য লিখতেন না, ফলে তাঁর অবর্তমানে সিনেমা শেষ করা দুরূহ। জহির রায়হানের বহু সিনেমার চিত্রগ্রাহক আফজাল চৌধুরীকে উদ্ধৃত করে খন্দকার মাহমুদুল হাসানের ‘মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র’ বইয়ে বলা হয়, ‘জহির ছবিটি শেষ করতে পারেনি। ছবির পরিকল্পনাটা ছিল ওর মাথায়, কাগজে কিছু লেখা থাকত না। তাই ছবি আর কেউ শেষ করতে পারেনি।’
চিত্রনাট্য জহির রায়হান ভাইয়ের মাথায় ছিল। শেষটা কেমন ছিল, সেটা কেউ বের করতে পারেননি। অনেকেই চেষ্টা করেছেন। তবে শেষ করা যায়নি।ববিতা
অভিনেত্রী ববিতাও প্রথম আলোকে বলেন, ‘চিত্রনাট্য জহির রায়হান ভাইয়ের মাথায় ছিল। শেষটা কেমন ছিল, সেটা কেউ বের করতে পারেননি। অনেকেই চেষ্টা করেছেন। তবে শেষ করা যায়নি।’
ফুটেজ উদ্ধারের পর পরিবারের তরফ থেকে সিনেমাটি সমাপ্ত করার পরিকল্পনা নেওয়া হলেও তা করা যায়নি বলে জানান জহির রায়হানের স্ত্রী সুচন্দা। তিনি প্রথম আলোকে জানান, সিনেমাটির কোনো চিত্রনাট্য লেখেননি জহির রায়হান। তাৎক্ষণিক চিন্তা থেকে সিনেমাটি নির্মাণ শুরু করেছিলেন। চিত্রনাট্য ছাড়া কোনো অসমাপ্ত সিনেমা সমাপ্ত করা খুব দুরূহ। তবু তাঁরা সমাপ্ত করার চেষ্টা করে গেছেন, পারেননি।
তাহলে ছবিটি কোনো দিনই দর্শকেরা দেখতে পারবেন না? এমন প্রশ্নের জবাবে সুচন্দা বলেন, ‘সিনেমাটির ডাবিং, এডিটিং করলে হয়তো দেখানো যেতে পারে। তবে এর জন্য অনেক অর্থের প্রয়োজন; সরকারিভাবে উদ্যোগ নিলে হয়তো সম্ভব হবে।’