ব্যবসায় প্রশাসনের ছাত্র যেভাবে চিত্রনাট্যকার হয়ে উঠলেন

‘সুড়ঙ্গ’-এর শুটিংয়ে আহত হন চিত্রনাট্যকার নাজিম উদ দৌলা
লেখকের সৌজন্যে

শুটিংয়ে অভিনয়শিল্পী, পরিচালক, চিত্রগ্রাহক বা স্টান্টম্যানের আহত হওয়ার খবর প্রায়ই শোনা যায়। কিন্তু শুটিংয়ে লেখকের চোট পাওয়ার কথা খুব বেশি শোনা যায়নি। তবে ‘সুড়ঙ্গ’-এর চিত্রনাট্যকার নাজিম উদ দৌলার ক্ষেত্রে তা–ই ঘটেছে! সিনেমার দ্বিতীয় কিস্তির শুটিংয়ের সময় নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ছবিটি পোস্ট করেছিলেন তিনি—শুটিং চলছে, একটি চেয়ারে পা রেখে ল্যাপটপে কাজ করছেন। পায়ে ব্যান্ডেজ। গত শনিবার আলাপে আলাপে জানালেন, চট্টগ্রামে শুটিংয়ের সময় ঘটেছিল ঘটনাটি।

আরও পড়ুন

‘সুড়ঙ্গ’-তে মাসুদের যে বাড়িটা দেখানো হয়, সেখানে ওঠার জায়গাটা বেশ উঁচু। প্রথম দিন সেখানে গিয়েই নাজিম উদ দৌলা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন—কেউ না কেউ পড়ে গিয়ে ঠিক ব্যথা পাবে। দিন কয়েক পর সেই কেউ যে তিনি নিজেই হবেন, তা কি আর জানতেন! পরে ব্যান্ডেজ-ট্যান্ডেজ করে যখন শুটিংয়ে বসে ছিলেন, তখন ছবির অভিনেতা আফরান নিশো তাঁকে বলেছিলেন কথাটা—‘শুটিংয়ে যে লেখক আহত হয়, এই প্রথম দেখলাম।’

গত শনিবার সকালে তাঁর সঙ্গে যখন কথা হয়, নাজিম উদ দৌলা তাঁর শুটিংয়ে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করছিলেন, ‘সিনেমায় সুড়ঙ্গের ব্যাপারটা আমি যেভাবে লিখেছিলাম শুটিং করতে গিয়ে দেখলাম জায়গাটা ও রকম না। তাই পরিচালক দ্বিতীয় কিস্তির শুটিংয়ের পুরোটা সময় আমাকে রাখেন। সিনেমায় সুড়ঙ্গের ভেতরের যেসব দৃশ্য আছে, সেগুলোর বেশির ভাগই তাৎক্ষণিকভাবে সেটে বসে পরিকল্পনা করে লেখা।’

চিত্রনাট্যকার নাজিম উদ দৌলা
লেখকের সৌজন্যে

সুড়ঙ্গ মুক্তির পর পরিচালক, অভিনয়শিল্পী, চিত্রগ্রাহকসহ অন্য কলাকুশলীদের সঙ্গে প্রশংসিত হচ্ছেন চিত্রনাট্যকারও। নাজিম উদ দৌলা জানালেন, এটি তাঁর মুক্তি পাওয়া চতুর্থ চলচ্চিত্র। এর আগে ‘শান’, ‘দামাল’, ‘অপারেশন সুন্দরবন’-এ কাজ করেছেন। কোনোটির একক কোনোটার যৌথ চিত্রনাট্যকার তিনি। নাজিম উদ দৌলা এখন পেশাদার চিত্রনাট্যকার। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ, এমবিএ করা তরুণ সিনেমায় এসেছেন কয়েকবার চাকরি বদল করে।

পড়াশোনা শেষ করে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষকের চাকরি নিয়েছিলেন নাজিম। কিন্তু ক্যাম্পাস থেকেই যে লেখালেখিতে ডুবে ছিল, তাঁর শিক্ষকতা ভালো লাগছিল না। ছাত্র অবস্থাতেই প্রকাশিত হয় তাঁর দুই থ্রিলার ইনকারনেশন ও ব্লাডস্টোন। সৃজনশীল কিছু করতে চাইছিল মন। শিক্ষকতা ছেড়ে এরপর অনেক দিন বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করেছেন। কিন্তু বিজ্ঞাপনের ধরাবাঁধা কাজও ভালো লাগছিল না। এ সময় একটা ফোন কল বদলে দেয় তাঁর ক্যারিয়ারের গতিপথ।

চিত্রনাট্যকার নাজিম উদ দৌলা
লেখকের সৌজন্যে

‘২০১৮ সালে জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আবদুল আজিজ ভাই আমাকে ফোন করেন। তাঁর অফিসে গিয়ে দেখা করতে বলেন। তাঁরা তখন মাসুদ রানাকে নিয়ে এমআর৯ সিনেমা করবেন, তাঁরা চাইছিলেন থ্রিলার বোঝে এমন নতুন কাউকে দিয়ে লেখাবেন,’ বলছিলেন নাজিম উদ দৌলা। তবে তাঁর তো চিত্রনাট্য লেখার অভ্যাস নেই। ছবির পরিচালক হলিউডের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁকে যোগাযোগ করিয়ে দেন। দুই মাসের ভার্চ্যুয়াল কোর্স করে লিখতে বসে যান নাজিম।  

সিনেমার চিত্রনাট্য ছাড়াও ‘দ্য ডার্ক সাইড অব ঢাকা’, ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি’, ‘বুকের মধ্যে আগুন’ ইত্যাদি ওয়েব ফিল্ম ও সিরিজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন নাজিম উদ দৌলা। নিজের কাজের মধ্যে বাণিজ্যিক ও শৈল্পিক ঘরানার মিশ্রণ ঘটাতে চান তিনি।

সামনে অনেক কনটেন্ট তৈরি হবে। এই পেশার ভবিষ্যৎ খুব ভালো দেখতে পাচ্ছি। এখন বা আর দুই-তিন বছর পরেই এটিকে পূর্ণকালীন পেশা হিসেবে নেওয়ার মতো অবস্থায় যাব আমরা

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে নাজিম উদ দৌলা বলছিলেন, ‘আমি এমন সিনেমার চিত্রনাট্য লিখতে চাই, যা দর্শক হিসেবে আমার পছন্দ হবে। আমার মনে হয়, সিনেমার পুরোপুরি আর্ট ফিল্ম হয়ে যাওয়ার প্রয়োজন নেই আবার গতানুগতিক বাণিজ্যিক সিনেমাও ভালো লাগে না। দুটোর মিশ্রণ ঘটাতে চাই যেন দর্শকের বিনোদনের জন্য কিছু থাকে। দিন শেষে সিনেমা একটা ব্যবসা। দর্শক পুরো একটা দিন ব্যয় করে, যানজট ঠেলে, অর্থ খরচ করে সিনেমা দেখতে আসেন, তাঁদের বিনোদনের উপাদান তো থাকতে হবে।’

গল্প লিখতে গেলে তো সেন্সর বোর্ড, বিতর্কিত বিষয় বা রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা মাথায় রাখতে হয়। এসব কি তাঁর লেখা বাধাগ্রস্ত করে? প্রশ্ন শুনে নাজিম জানালেন, তিনি যে গল্পটা বলতে চান, শুরুতে সেটা হুবহু লিখে ফেলেন। পরে পরিচালক, প্রযোজকদের সঙ্গে বসে প্রয়োজন হলে ঘষামাজা করেন। তাঁর ভাষ্যে, ‘শুরুতেই যদি অনেক কিছু মাথায় রাখি তাহলে তো লিখতেই পারব না। তাই নিজের গল্পটা আগে লিখে নিই।’ চিত্রনাট্য লেখাটাকে পেশা হিসেবে নেওয়া যায় কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে নাজিম বলেন, ‘সামনে অনেক কনটেন্ট তৈরি হবে। এই পেশার ভবিষ্যৎ খুব ভালো দেখতে পাচ্ছি। এখন বা আর দুই-তিন বছর পরেই এটিকে পূর্ণকালীন পেশা হিসেবে নেওয়ার মতো অবস্থায় যাব আমরা।’

চিত্রনাট্যকার নাজিম উদ দৌলা
লেখকের সৌজন্যে

‘সুড়ঙ্গ’-এর জন্য অনেক দিন লেখালেখিতে বিরতি ছিল। বিরতি কাটিয়ে নতুন কাজ নিয়ে ফেরার অপেক্ষায় আছেন নাজিম উদ দৌলা। সামনে পরিচালক তানিম রহমান অংশু, অভিনেতা আরেফিন শুভসহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে নতুন কাজের পরিকল্পনা চলছে।