নকশীকাঁথার জমিন: প্রয়োজনীয় ও সময়োপযোগী সিনেমা

‘নকশী কাঁথার জমিন’ সিনেমার দৃশ্য। নির্মাতার সৌজন্যে

কাঁথায় স্বপ্ন আঁকছিল দুই বিধবা, যে কাঁথাটিই হয়ে উঠবে নকশিকাঁথা। হঠাৎ করে ঝড় এল, উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইল নকশিকাঁথা। সাদা শাড়ি পরা দুই নারী প্রাণপণে সেই ঝড় ঠেকানোর চেষ্টা করছে। জীর্ণ দরজায় খিল এঁটে দিয়ে ঝড় থেকে বাঁচানোর সে এক আপ্রাণ চেষ্টা। শেষ পর্যন্ত ঝড় থামল, নকশিকাঁথায় স্বপ্ন আঁকা হতে থাকল। রক্তাক্ত জমিনে আবার ফুটে উঠতে থাকল জীবন।

বাংলার ইতিহাসটাও তা-ই। সেই ইতিহাসের একটা বড় জায়গাজুড়ে আমাদের একাত্তর, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। অতীতের অনেক যুদ্ধ আমরা দেখিনি, কিন্তু একাত্তরে আমাদের দর্শক হওয়ার উপায় ছিল না, হয় পক্ষ হতে হয়েছে অথবা বিপক্ষ। সেই পক্ষ-বিপক্ষের যুদ্ধে ভাইয়ে-ভাইয়ে যুদ্ধ হয়েছে। কখনো দুই পক্ষই নিহত হয়েছে। কেউ পেয়েছে বীরের মর্যাদা, কেউ বিশ্বাসঘাতকের।

‘নকশী কাঁথার জমিন’ সিনেমার দৃশ্য। নির্মাতার সৌজন্যে

কিন্তু নারী বহন করে চলে সব অতীত, সব বেদনা, সব গ্লানি। নারীর সেই দুঃসহ দিনের কাহিনি নিয়েই হাসান আজিজুল হক রচনা করেছিলেন ‘বিধবাদের কাহিনি’। সেখান থেকেই চলচ্চিত্রকার আকরাম খান নির্মাণ করেছেন ‘নকশীকাঁথার জমিন’। আগেও তিনি এই কালজয়ী লেখকের গল্প নিয়ে নির্মাণ করেছিলেন ‘খাঁচা’। আকরাম চলচ্চিত্রের একটা অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে হাসান আজিজুল হককে বোঝেন। সে জন্য গল্পটা তিনি অবিকল রাখেন না। চরিত্রের সঙ্গে মেশান বাংলার প্রকৃতি, মানুষের জীবনযাপনের চিত্র। এই ছবিতে যেমন প্রকৃতিকে অনায়াসেই এনেছেন তিনি। মেঘ, বৃষ্টি, বিলে ফুটে ওঠা শাপলা, শীতের সকালের কুয়াশা, পূর্ণিমার চাঁদ আর তার সঙ্গে ফুটে উঠেছে মানুষের নৃশংসতা, হত্যা, রক্তাক্ত প্রকৃতি, নির্দয়তা এবং সবশেষে মুক্তির আকুতি।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর রাশিয়ার চলচ্চিত্রেও প্রকৃতি, প্রেম, ভালোবাসা—সবটা মিলিয়ে একটা মানবিক গল্প ফুটে উঠত। অবশ্য সেই ছবিগুলোতে যেমন সম্মুখযুদ্ধ থাকত, আকরাম এখানে তা রাখেননি। রাখা সম্ভবও নয়। এসব অসম্ভবকে রাখতে গিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলো সার্থক হতে পারেনি। কিন্তু সার্থক চলচ্চিত্রের যে চরিত্র, তা এখানে দারুণভাবেই রক্ষিত হয়েছে। যেমন সত্যজিৎ রায়ের অশনি সংকেত–এ দৃশ্যত কোনো যুদ্ধ নেই কিন্তু যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় যে মানুষের জন্ম হয়, তা ভয়ংকরভাবে উঠে এসেছে। আকরামের ছবিতেও ক্যামেরায় ধরা পড়েছে মানুষ, যে মানুষ কীভাবে পাল্টে যায়, কতটা নৃশংস, কতটা সাহসী হয়। যাঁরা অভিনয় করেছেন, তাঁদের দিয়েও আধুনিক অভিনয়টা আদায় করেছেন। দুই বিধবার চরিত্রে জয়া আহসান ও সেঁওতির বাক্হীন অভিনয় অত্যন্ত উঁচু মানের। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন বাংলাদেশের অভিনেতা–অভিনেত্রীরা গত ৫২ বছরের থিয়েটার মিডিয়া এবং স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে অনুশীলনের কারণে একটা উন্নত মাত্রায় পৌঁছে গেছেন। কিন্তু সংকটটা সুযোগের। আকরাম সে সুযোগটাই সৃষ্টি করতে পেরেছেন। তাই সবার অভিনয় অত্যন্ত সাবলীল এবং চরিত্র উপযোগী। চিত্রগ্রহণেও একটা ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। এই ছবিতে চিত্রগ্রাহক পলাশের কাজ নিঃসন্দেহে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। রঙিন ছবিতেও কখনো কখনো একধরনের সাদাকালোর এফেক্ট তৈরি করতে পেরেছেন তিনি।

আকরাম আর পলাশ মিলে ছোট জায়গায়ও বাংলাদেশের বিশাল দিগন্ত, মানুষগুলোকে বিশাল করে দেখাতে পেরেছেন। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কম্পোজিশনে একটা ঐক্য সৃষ্টি করতে পেরেছেন। মুক্তিযুদ্ধের ছবির বড় সমস্যা হচ্ছে এই গল্পগুলো আমরা বছরের পর বছর দেখে এসেছি। যদি নতুন কোনো মাত্রা যুক্ত না হয়, তাহলে তা ক্লিশে দেখায় এবং পুনরাবৃত্তির সংকট পড়ে যায়। আকরাম তাই খুঁজে বের করেছেন দুই বিধবাকে যারা অসংখ্য বিধবার প্রতিনিধি। কোনো চিৎকার বা সংলাপের বাহুল্যে বিধবাদের উপস্থাপন করেননি বরং যুগ–যুগান্তরের বেদনাকে নিয়ে বহন করা রক্ত–মাংসের দুটি মানবীকেই ধরেছেন তাঁর ক্যামেরায়। উচ্চারণে যাঁরা প্রবল নন কিন্তু অভিব্যক্তিতে অসাধারণ। হাসপাতাল দৃশ্যে মৃত পুত্রের সামনে সেওঁতির অভিনয় ভুলবার নয়। এই ছবিতে জয়া আহসানের নির্বাক ও সবাক দৃশ্যের অভিনয় তরুণতর অভিনেত্রীদের কাছেও দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এই ছবির প্রত্যেক অভিনেতা ও অভিনেত্রী নির্দেশনা মেনে প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশে, যেমন বৃষ্টির দৃশ্যগুলোতে অসাধারণ অভিনয় করেছেন। সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করেছেন তাঁদের আন্তরিক প্রচেষ্টায়।

আরও পড়ুন
‘নকশী কাঁথার জমিন’ সিনেমার দৃশ্য। নির্মাতার সৌজন্যে

আকরাম এ দেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন থেকে আসা। পৃথিবীর চলচ্চিত্র আন্দোলনের ফলাফল তিনি জানেন। তাতেই আমরা একটি চলচ্চিত্র পেলাম, যা আজকের দিনে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং সময়োপযোগী। যে প্রজন্ম আমাদের মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, তাদের অবশ্যই এই ছবিটি দেখা প্রয়োজন।