তরুণ সিনেমাপ্রেমীদের নিয়ে অন্য রকম আয়োজন
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাজুল মারুফ অভিনয় করেন। তিনি এসেছিলেন সিনেমা নির্মাণের নানা বিষয় জানার জন্য। ভবিষ্যতে সিনেমাও নির্মাণ করতে চান তিনি। অন্যদিকে ঢাকা কলেজের তরুণ শিক্ষার্থী খাইরুল ইসলামের ধ্যানজ্ঞান সিনেমা। কিন্তু এ সম্পর্কে সরাসরি জানার তেমন সুযোগ পাচ্ছিলেন না। ভেবেছেন, চলচ্চিত্র অঙ্গনের গুণী ব্যক্তিদের ‘মাস্টারক্লাস’ তাঁর জীবনে অন্য রকম প্রাপ্তি হয়ে থাকবে। শুধু এ দুজনই নন, সিনেমা নির্মাণ সম্পর্কে জানার জন্য অনেক তরুণের কাছেই ইউরোপিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ছিল মনে রাখার মতো আয়োজন। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও প্রথম আলোর উদ্যোগে এই আয়োজন শুরু হয়েছে গতকাল থেকে। আয়োজনটি হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুলার রোডের ব্রিটিশ কাউন্সিলে।
সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে ইউরোপ ও বাংলাদেশের সংস্কৃতির নানা বৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধ করার জন্যই তরুণ নির্মাতাদের জন্য এই আয়োজন। উদ্দেশ্য, উদীয়মান প্রতিভাকে তুলে ধরা, সাংস্কৃতিক বিনিময় ও পারস্পরিক বোঝাপড়া তৈরি করা। অনুষ্ঠানে ঢাকা, জগন্নাথ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সিনেমাপ্রেমীরা অংশ নিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সিনেমার কলাকুশলীরাও বেলা তিনটা থেকেই ফুলার রোডে ভিড় করতে থাকেন। রেজিস্ট্রেশন করে অংশ নেন মাস্টারক্লাসে। বেলা ৩টা ৪৫ মিনিট থেকে শুরু হয় মূল আলোচনা।
প্রথমেই তরুণদের ইউরোপিয়ান সিনেমা সম্পর্কে ধারণা দেন ভালেরিয়ো কারোসো। তিনি সিনেমা ইউরোপার পরিচালক। এই আয়োজনে ভার্চ্যুয়ালি অংশ নেন তিনি। ভালেরিয়ো তুলে ধরেন, ইউরোপিয়ান সিনেমার ইতিহাস, বিপ্লব, সিনেমার কান্ডারি, সিনেমার আয়, নারী নির্মাতাদের সংখ্যা, অর্থায়নের উৎস—এমন নানা প্রসঙ্গ। টেলিভিশন অনুষ্ঠানে বিনিয়োগ হচ্ছে কীভাবে, এগিয়ে যাচ্ছে—সেগুলো বাদ যায় না তাঁর আলোচনা থেকে। এসবের সঙ্গে তিনি যোগসূত্র টানেন বাংলাদেশের সিনেমার। তিনি আলোচনায় জানান, ইউরোপের সিনেমা বাজার ১২০ বিলিয়ন ইউরোর বেশি। যদিও ২০২২ সাল থেকে সিনেমার বক্স অফিস আয় কমছে। ওটিটিগুলো বাজার দখল করছে। আলোচনা শেষ পর্যায়ে তিনি বাংলাদেশি নির্মাতাদের ইউরোপের বাজারে অর্থায়নের জন্য চিত্রনাট্য উপস্থাপন ও যৌথ প্রযোজনায় কাজ করার পরামর্শ দেন। নিজের আলোচনা শেষে পরবর্তী সময়ে তিনি নানা প্রশ্নের উত্তর দেন। মাস্টারক্লাসে অংশ নেওয়া একজন প্রশ্ন করেন, ইউরোপের সিনেমা বাজারে বাংলাদেশের কোনো ধরনের গল্প জমা দিলে অর্থায়ন পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে? আলোচক বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভালো গল্প জমা দেওয়ার পরামর্শ দেন।
এদিনের আয়োজনে ছিলেন খুলনার মেয়ে সৈয়দা নিগার বানু। নারী নির্মাতা হিসেবে ক্যামেরার পেছনে কীভাবে কাজ শুরু করলেন, সেই প্রতিবন্ধকতার গল্প সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করেন তিনি। নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে নিগার বলেন, সিনেমা বানাবেন শুনে শুরুতে পরিবারের কেউ তাঁকে তেমন সহযোগিতা করেননি। এমনকি সিনেমা নিয়ে পড়াশোনার জন্য বৃত্তির ফরম পূরণ করলেও পরিবার থেকে সেটা জমা দেওয়া হয়নি। এটা দীর্ঘদিন পর্যন্ত তিনি জানতেন না। পরে একদিন দেখলেন, তাঁর পূরণ করা ফরম বাড়িতেই রয়ে গেছে। সেদিনই তিনি পণ করেছিলেন, সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা করার জন্য দেশের বাইরে যাবেনই। একসময় বিদেশ থেকে সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে দেশে আসেন। কিন্তু কাজ করতে এসে নানা বাধার মুখে পড়েন। নারী হিসেবে পদে পদে বাধা পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি বাধা মুখ বুজে সহ্য করেছি। কারণ, আমি যেখানে আছি, সেই জায়গাটা হারাতে চাইনি। পরবর্তী সময়ে সবার সহযোগিতা পেয়েছি।’ বর্তমানে সিনেমা নিয়েই ব্যস্ত। খুলনা উপকূলের মানুষের কাহিনি নিয়ে তিনি নির্মাণ করেছেন চলচ্চিত্র নোনা পানি। এ ছাড়া গণ–অর্থায়নে সিনেমা নির্মাণ করেছেন।
সিনেমা নির্মাণের জন্য কারিগরি নানা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এর মধ্য অন্যতম ক্যামেরা সম্পর্কে জানা। এ বিষয়টির গুরুত্ব তুলে ধরেন চিত্রগ্রাহক অপু রোজারিও। পেইন্টিং থেকে কীভাবে স্থিরচিত্র এল, কীভাবে পেইন্টিংয়ের আলোর উৎস, চরিত্রদের পজিশন থেকে ধার করে আজকের ভিডিও চিত্র বিকশিত হয়েছে—সেগুলো নিয়ে ধারণা দেন। এই সময় তিনি চিত্রকর রাফায়েলের বিখ্যাত চিত্র ‘দ্য স্কুল অব এথেন্স’সহ বেশ কিছু চিত্রকর্ম দেখিয়ে আলোর উৎস হাতে–কলমে বোঝান। তুলে ধরেন ক্যামেরায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। সবশেষে সিনেমার বিপণন নিয়ে অনলাইন আলোচনায় অংশ নেন চলচ্চিত্র প্রযোজক কার্লোস ইয়েন্তেরো।
দুই দিনের এই মাস্টারক্লাস শেষ হবে আজ ১৬ সেপ্টেম্বর। শেষ দিনে অংশ নেবেন চলচ্চিত্র ও বিজ্ঞাপন নির্মাতা পিপলু আর খান, অমিতাভ রেজা চৌধুরী। এ ছাড়া ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হবেন পরিচালক ও সাউন্ড ডিজাইনার নিকোলাস ব্লাসব্যান্ড। দুই দিনের মাস্টারক্লাস সঞ্চালনা করছেন তাহমিনা সুলতানা। এ ছাড়া আগামীকাল বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে শুরু হবে ‘ইউরোপিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল-২০২৩’। এই আয়োজনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকসহ ৩০০ অতিথি। উৎসবের চলচ্চিত্রগুলোর প্রদর্শনী হবে আলিয়ঁস ফ্রঁসেস, ডাচ ক্লাব ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে। উৎসব শেষ হবে ২৩ সেপ্টেম্বর।