‘রঙ্গিন রূপবান’-এর রাজকুমারকে কেউ মনে রাখেনি

চিত্রনায়ক আবদুস সাত্তার
সংগৃহীত

পরিবার নিয়ে সিনেমা হলে সিনেমা দেখার সেই সোনালি দিনে রাজকুমার রহিম হয়ে বড় পর্দায় আবির্ভূত হয়েছিলেন তরুণ চিত্রনায়ক আবদুস সাত্তার; আলোচিত সিনেমা ‘রঙ্গিন রূপবান’–এ অনবদ্য অভিনয়ের সুবাদে দেশজুড়ে তাঁর পরিচিত ছড়িয়ে পড়েছিল। রহিম চরিত্রে লাল রঙের জ্যাকেটের সঙ্গে ঝলমলে পাগড়ি আর মুকুটে দ্যুতি ছড়িয়েছিলেন সাত্তার, দর্শকদের কাছে রাজকুমারের প্রতিমূর্তি হয়ে উঠেছিলেন তিনি। দর্শকদের আগ্রহের জন্য ফোক–ফ্যান্টাসিনির্ভর চলচ্চিত্রে সাত্তারের ব্যস্ততা বাড়তে থাকে, হয়ে ওঠেন পোশাকি সিনেমার ‘পোস্টার বয়’।

আশির দশকে ঢাকাই সিনেমায় রাজ্জাক, বুলবুল, উজ্জ্বল, ফারুকের রাজত্বে লোক ঘরানার সিনেমায় আলাদা পরিচয় তৈরি হয়েছিল সাত্তারের। মান্নাসহ সমসাময়িক শিল্পীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি। তাঁর দেড় শতাধিক সিনেমার মধ্যে বেশির ভাগ সিনেমাই ছিল হিট। ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘মধুমালা মদন কুমার’, ‘অরুণ বরুণ কিরণ মালা’, ‘সাগরকন্যা’, ‘শিশমহল’, ‘জেলের মেয়ে রোশনী’সহ বেশ কয়েকটি সিনেমায় তাঁকে রাজকুমারেরর বেশে পেয়েছেন দর্শকেরা।

বাংলাদেশের দর্শকদের কাছে ফোক–ফ্যান্টাসি ঘরানার ছবির জনপ্রিয়তা অনেক আগে থেকেই; বিশেষ করে ষাটের দশকে একের পর এক পোশাকি সিনেমা দিয়ে দর্শকদের মাঝে আলোড়ন তুলেছিলেন অভিনয়শল্পী, নির্মাতা, প্রযোজকেরা। লোক সিনেমার সেই ধারা আশির দশকে আরও জোরালো হয়েছে বলে মনে করেন চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াৎ; তাতে মূল পাত্রের ভূমিকায় ছিলেন সাত্তার।

তাঁর দেড় শতাধিক সিনেমার মধ্যে বেশির ভাগ সিনেমাই ছিল হিট
সংগৃহীত

অনুপম হায়াৎ প্রথম আলোকে বলেন, ‘লোক ঘরানার সিনেমার কারণেই সমসাময়িক অন্যান্য নায়কদের থেকে সাত্তার নিজেকে স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন।’
সাত্তারকে নিয়ে ‘আলোমতি প্রেমকুমার’, ‘মধুমালা মদন কুমার’, ‘বেদকন্যা’ নামে তিনটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন পরিচালক সাঈদুর রহমান, ফোক–ফ্যান্টাসিনির্ভর সেই তিন সিনেমায় রাজকুমারের চরিত্র নির্বাচন করেছিলেন পরিচালক।
সাঈদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘লোকগাঁথানির্ভর সিনেমায় সাত্তার ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। রাজকুমারের চরিত্রের সঙ্গে মিশে যেতেন তিনি, দর্শকদের ভালো লাগত। ফলে পরিচালকেরা সেই ধরনের চরিত্রেই বেশি নিতেন তাঁকে। লোকগাঁথানির্ভর সিনেমায় নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল ছিলেন তিনি।’

বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাস লেখা হলে সেখানে অবধারিতভাবেই সাত্তারের নাম আসার কথা, তবে ঢাকাই সিনেমার রাজকুমার প্রায় বিস্মৃতির অতলে হারাতে বসেছেন চলচ্চিত্র অঙ্গন থেকে। চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি কিংবা শিল্পী সমিতির কেউই তাঁকে আর মনে রাখেনি, গত ৪ আগস্ট অনেকটা নীরবেই কেটে গেল এই নায়কের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁকে নিয়ে এফডিসি বা শিল্পী সমিতিতে কোনো আয়োজন হয়নি। স্মরণ করেননি শিল্পী সমাজের কেউই। ২০২০ সালে মৃত্যুর আগে কয়েক বছর শয্যাশায়ী ছিলেন দাপুটে এ নায়ক, অভিনয়ে অনিয়মিত হওয়ার পর দীর্ঘদিনের সহশিল্পীদরও কেউ খোঁজ নেননি। মৃত্যুর আগে সাংবাদিকদের সেই আক্ষেপের কথা বলে গেছেন এ অভিনেতা।

চিত্রনায়ক আবদুস সাত্তার
সংগৃহীত

দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ইবনে মিজান, চাষী নজরুল ইসলাম, আজিজুর রহমানের মতো পরিচালকের সঙ্গে তিনি যেমন কাজ করেছেন, তেমনি কাজ করেছেন শাবানা, রোজিনা, অঞ্জু, জিনাত, কবিতা, অলিভিয়া, রানীর মতো নায়িকাদের সঙ্গে। নায়কদের মধ্যে রাজ্জাকসহ সমসাময়িক নায়কদের প্রায় সবার সঙ্গেই পর্দা ভাগাভাগি করেছেন নারায়ণগঞ্জের ছেলে সাত্তার।

নাম লিখিয়েছিলেন ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ সিনেমায়
আশির দশকের শেষ ভাগে মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ব্যবসাসফল সিনেমা ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ সিনেমায় ইলিয়াস কাঞ্চনের আগে সাত্তারকে চূড়ান্ত করা হয়েছিল। জীবদ্দশায় বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে সাত্তার বলেছেন, পরিচালক তাঁকে চরিত্রটি করার জন্য ১০ হাজার টাকা সাইনিং মানিও দিয়েছিলেন। তবে হঠাৎ পরিচালক তাঁর জায়গায় ইলিয়াস কাঞ্চনকে নিয়ে শুটিং শুরু করেন। বিষয়টি নিয়ে তিনি অবাক হলেও ঘটনা আর বাড়াননি। সিনেমাটি ১৯৮৯ সালে মুক্তির পর তুমুল দর্শকপ্রিয় হয়েছিল, কলকাতায়ও ছবিটির রিমেক হয়েছিল।

বেশ কয়েকটি সিনেমায় তাঁকে রাজকুমারেরর বেশে পেয়েছেন দর্শকেরা
সংগৃহীত

রাজ্জাকের সঙ্গে চেহারার মিল ছিল
আশির দশকের মাঝামাঝির দিকে নায়ক হিসেবে সাত্তারের অভিষেকের পর সেই সময়ের শীর্ষ চিত্রনায়ক রাজ্জাকের সঙ্গে তাঁর চেহারা ও গড়নের মিল খুঁজেছিলেন দর্শকেরা। পরিচালক সাঈদুর রহমান ও গবেষক অনুপম হায়াৎও বলেছেন, তাঁদের চেহারায় বেশ সাদৃশ্য ছিল।

চেহারা মিল থাকলেও দুজনের মতের অমিল ছিল বিস্তর। সাত্তারের অভিযোগ ছিল, ‘চন্দ্রলতা’ নামে একটি ছবিতে সাইনিংয়ের পর রাজ্জাকের পরোক্ষ প্রভাবে ছবি থেকে তাঁকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। মাঝে চাষী নজরুল ইসলামের ‘শুভ দা’ সিনেমায় রাজ্জাকের সঙ্গে কাজ করেছেন সাত্তার। পরে আরও তিনটি সিনেমায় একসঙ্গে কাজের সুযোগ হলেও রাজ্জাক শিডিউল না দেওয়ায় সিনেমাগুলো আর আলোর মুখ দেখেনি বলে অভিযোগ ছিল সাত্তারের।

পার্শ্ব নায়ক থেকে মূল নায়ক
নায়ক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে আশির দশকের গোড়ার দিকে ঢাকায় এসেছিলেন সাত্তার, নায়ক হিসেবে বড় পর্দায় আসার আগে পার্শ্ব নায়ক হিসেবে ‘তীর ভাঙা ঢেউ’, ‘আওয়ারা’ সিনেমায় কাজ করেন। সিনেমায় কাজ করতে গিয়েই নির্মাতা আলমগীর কবীরের সঙ্গে পরিচয় হয়। কিছুদিন তাঁর সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন।

রঙিন রুপবান ছবিতে চিত্রনায়িকা রোজিনার সঙ্গে
সংগৃহীত

মাঝে হোন্ডা, তিব্বতের বিজ্ঞাপনে মডেলিং করে পরিচিত পান। এর মাঝে ১৯৮৪ সালে এফডিসিতে নতুন মুখের সন্ধানে প্রতিযোগিতায় আবেদন করেন। সেখানে নির্বাচিত হওয়ার পর রাতারাতি বদলে যায় সাত্তারের জীবন। প্রযোজক শাহাদত হোসেনের ‘পাগলী’ চলিচ্চত্রে নাম লেখান। নায়িকা ছিল ফারজানা ববি। রাতে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পরদিনই শুটিং হয়েছিল। আলমগীর পিকচার্সের মালিক জাহাঙ্গীর খান ‘রঙ্গিন রূপবান’ সিনেমায় রহিমের চরিত্রে নেন সাত্তারকে, শুটিং শুরুর আগেই পরিচালক সফদর আলী ভুঁইয়া মারা গেলে পরিচালকের দায়িত্ব পান আজিজুর রহমান ছবির শুরু করলেন। একই সময়ে পরিচালক ইবনে মিজানের ‘পাতাল বিজয়’ সিনেমায় লক্ষ্মণের চরিত্রেও চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন। ‘রঙ্গিন রূপবান’ মুক্তির পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি সাত্তারকে। একের পর এক সিনেমার প্রস্তাব পেতে থাকেন তিনি। দর্শকদের উপহার দিয়েছেন ‘ঘর ভাঙা সংসার’, ‘দুশমনি’, ‘বেদকন্যা’, ‘পঙ্খিরানী’, জেলের মেয়ে রোশনী’, ‘বনবাসে বেদের মেয়ে জোছনা’, ‘ভালোবাসার যুদ্ধ’ ও ‘চাচ্চু আমার চাচ্চু’র মতো আলোচিত সিনেমা।

(লেখাটি পুনঃপ্রকাশিত)