হুমায়ূন আহমেদের নাটক-সিনেমা কেন এত জনপ্রিয়
গত ১৯ জুলাই ছিল হুমায়ূন আহমেদের প্রয়াণ দিবস। ২০১২ সালের এই দিনে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি। হুমায়ূন আহমেদের নাটক, সিনেমা এখনো সমান জনপ্রিয়। ফেসবুক বা ইনস্টা রিলে হুমায়ূনের কনটেন্টে বুঁদ হয়ে থাকেন এ প্রজন্মের অনেকে। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের নাটক, সিনেমা কেন এত জনপ্রিয়? জনপ্রিয় এ নির্মাতার নাটক, সিনেমা বিশ্লেষণ করে লিখেছেন সৌমেন্দ্র গোস্বামী
হুমায়ূন আহমেদ রচিত জনপ্রিয় নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’। ১৯৯২-৯৩ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) নাটকটি ধারাবাহিকভাবে প্রচারিত হয়। আগ্রহের সঙ্গে নাটকটি তখন দেখেননি এমন নাটক–সিনেমাপ্রেমী মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তা ছাড়া নাটকটিকে ঘিরেই অত্যাশ্চর্য ঘটনাটি ঘটেছিল। নাটকের চরিত্র ‘বাকের ভাই’–এর ফাঁসি না দেওয়ার দাবিতে মানুষ রাস্তায় নেমে মিছিল করেছিল। দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার সাঁটানো হয়েছিল। যেখানে লেখা ছিল, ‘বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’, ‘বদির দুই গালে, জুতা মারো তালে তালে’ ইত্যাদি স্লোগান।
কেবল উল্লিখিত নাটকটিই নয়, হুমায়ূন আহমেদের বেশির ভাগ নাটক-সিনেমাই নন্দিত হয়েছে, প্রশংসা কুড়িয়েছে। তরুণ থেকে কিশোর, যুবক থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ—সব বয়সী দর্শকের মন জয় করতে পেরেছিলেন তিনি। আজকের দিনে এসেও তাঁর নাটক-সিনেমা দর্শকের ভালো লাগার জোয়ারে ভাটা পড়েনি।
‘দিন কি আর এ রকম থাকবে শাহানা’, ‘এই দিন দিন নয়, আরও দিন আছে। এই দিনেরও নিয়া যাইবা সেই দিনেরও কাছে’—সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ঘাটলে ‘এই সব দিনরাত্রি’ নাটকের সংলাপের এই দৃশ্যের ভিডিও ক্লিপসহ অনেক নাটক-সিনেমার বিভিন্ন দৃশ্যের ভিডিও ক্লিপ খুঁজে পেতে কষ্ট হবে না। এই যে এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মের হুমায়ূন আহমেদের নাটক-সিনেমা একই রকম ভালো লাগে—এর পেছনের জাদুটা কী? আর কেনই–বা তাঁর নাটক-সিনেমা আমাদের ভালো লাগে?
গল্পের নিজস্বতা ও মৌলিকত্ব
হুমায়ূন আহমেদের রচনার অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে গল্পে তাঁর নিজস্বতা ও মৌলিকত্ব। এ ছাড়া তাঁর গল্পের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো—গল্পগুলো সহজ, সরল, প্রাঞ্জল ও জীবনঘনিষ্ঠ। যে কারণে তাঁর বেশির ভাগ রচনায় পাঠক আপন করে নিয়েছে।
নাটক-সিনেমার ক্ষেত্রেও বিষয়টা সত্য। যে গল্পের মধ্যে নিত্যদিন মানুষের বসবাস নাটক-সিনেমাতেও তিনি সেই গল্পই বলার চেষ্টা করেছেন। বোধ করি, এ কারণেই ‘বহুব্রীহি’ নাটকের একটি দৃশ্যে বাচ্চা ছেলেটি যখন বিছানায় শুয়ে বাবার কাছে জিজ্ঞাসা করে, ‘আমাদের সঙ্গে কী আমাদের মা আছেন?’ তখন আমাদের মন কেমন করে ওঠে। ‘আমার আছে জল’ সিনেমায় ‘যদি ডেকে বলি, এসো হাত ধরো/ চলো ভিজি আজ বৃষ্টিতে/ এসো গান করি মেঘ মল্লারে,/ করুণাধারা দৃষ্টিতে...’ গানের দৃশ্য দেখে আমরা মুগ্ধ হই।
চরিত্র রূপায়ণে অনন্যতা
গল্প-উপন্যাস থেকে নাটক-সিনেমা প্রতিটি ধারাতেই ‘চরিত্র’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কখনো কখনো চরিত্রের সঙ্গে আমরা নিজেদের মেলাতে চেষ্টা করি। এ কারণেই উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ‘ওথেলো’, ‘ডেসডিমোনা’, ‘ম্যাকবেথ’; জোনাথন সুইফটের ‘গালিভার’; রবীন্দ্রনাথের ‘অমিত’, ‘লাবণ্য’; সত্যজিৎ রায়ের ‘ফেলুদা’; শরদিন্দুর ‘ব্যোমকেশ’ আমাদের মুগ্ধ করে। হুমায়ূন আহমেদও চরিত্র রূপায়ণে মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। অক্ষরে অক্ষরে শব্দে শব্দে সৃষ্টি করেছেন নতুন নতুন চরিত্র।
বোধ করি, এ কথা বলা মোটেও অত্ত্যুক্তি হবে না যে হিমু সিরিজের বইগুলো পড়ার পর মনে মনে গোপনে কিংবা ঘোষণা দিয়ে অনেকেরই ‘হিমু’ হতে ইচ্ছা করে। কেউ কেউ এই প্রচেষ্টা করেছেন বলেও আমরা শুনে থাকি। একইভাবে বাকের ভাই, মিসির আলী, শুভ্র, রূপা চরিত্রগুলোও পাঠককে, দর্শককে ভাবায়, আকর্ষণ করে।
চরিত্র সৃষ্টিতে তাঁর অনন্যতা হচ্ছে, কাহিনিবিন্যাসের সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি চরিত্রকে অর্থবহ ও স্বতন্ত্র করে তুলতে পারা। বাসার কাজের লোক থেকে দারোয়ান—প্রত্যেকেই কোনো না কোনো নিজস্বতা বহন করে। যা দর্শককে মুগ্ধ করতে ভূমিকা রাখে। যে কারণে ‘হাবলংগের বাজারে’, ‘গৃহসুখ প্রাইভেট লিমিটেড’, ‘ওপেনটি বায়োস্কোপ’–এর মতো নাটকগুলো দেখে আমরা আনন্দ পাই, হই-হই করে হেসে উঠি।
সহজবোধ্য ও হৃদয়গ্রাহী সংলাপ
বাকের ভাই: তুমি কেমন আছ?
মুনা: ভালো আছি।
বাকের ভাই: মামুন সাহেব কেমন আছে?
মুনা: বাকের ভাই, একটু ভিতরে আসেন। মামুন সাহেব কেমন আছে আমি তা জানি না। সম্ভবত ভালোই আছে। তার এখন ভালোই থাকার কথা।
বাকের ভাই: তোমাদের মধ্যে বুঝি ঝগড়া হয়েছে। কেন ঝগড়া করতে যাও। নিজেই কষ্ট পাও।
মুনা: ঝগড়া–টগড়া কিছু হয়নি বাকের ভাই। মামুন বিয়ে করেছে। আপনার কাছে একটা ছোট্ট অনুরোধ করছি, আপনি আর কখনো আমাকে মামুন সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। ও, আপনাকে তো আসল খবরটাই দেওয়া হয়নি। আমাদের বকুলের বিয়ে। এগারো তারিখে গায়েহলুদ।
বাকের ভাই: মুনা যাই।
মুনা: না, বসেন বাকের ভাই। চা খেয়ে যাবেন।
বাকের ভাই: মুনা আমি চা খাব না। আমার মনটা খুব খারাপ হইছে।
মুনা: জানেন বাকের ভাই, এই পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ শুধু কষ্ট পাওয়ার জন্যই জন্মায়। এই আমার কথা দেখুন, আপনি বিশ্বাস করবেন কি না জানি না; আমি জ্ঞানত কখনো কোনো অন্যায় করিনি। কাউকে কখনো কোনো রকম কষ্ট দিইনি। অথচ অথচ দেখেন, আমি কেবলই কষ্ট পাচ্ছি। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার বাকি জীবনটা শুধু কষ্টেই কাটবে। আপনি কাঁদছেন নাকি বাকের ভাই?
বাকের ভাই: নাহ, চোখে কী জানি পড়ছে।
মুনা: আপনি একজন চমৎকার মানুষ। আমার এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার বোধ হয় আপনাকেই ভালোবাসা উচিত ছিল। আমরা সব সময় ভুল মানুষকে ভালোবাসি।’
‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের এই সংলাপে মুগ্ধ হয়েছেন অগণিত দর্শক। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই মুগ্ধতা কেন? সংলাপের শরীরে নজর দিলে প্রতিদিনের ব্যবহারের সহজ শব্দের সমাহার চোখে পড়ে। খুব সহজেই যা আপন হয়ে ওঠে। নির্দ্বিধায় যে কেউ দাবি করতে পারে, এ তো আমার কথা। ভালোবাসা, অপ্রাপ্তি, জীবন নিয়ে আমিও তো এভাবেই বলতে চাই।
কেবল এই একটি দৃশ্য বা একটি নাটকই নয়, বেশির ভাগ নাটক ও চলচ্চিত্রে সবার নান্দনিক উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে দৈনন্দিন জীবনের গল্প বলতে চেয়েছেন তিনি। তাই তো অবসরে, মন খারাপে তাঁর নাটক-সিনেমা দেখতে আমাদের ভালো লাগে।
গ্রামীণ জীবন, লোকসংস্কৃতি ও উদ্যাপন
হুমায়ূন আহমেদের নাটক-সিনেমার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হচ্ছে গ্রামীণ জীবন, লোকসংস্কৃতি ও উদ্যাপন। ‘ঘেটু পুত্র কমলা’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’সহ বেশির ভাগ নাটক সিনেমাতেই লোকসংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সহজ সাবলীল উপস্থাপন চোখে পড়ে। এ ছাড়া বিয়ে, জন্মদিন, বর্ষাসহ প্রচলিত বিভিন্ন অনুষ্ঠান থেকে ঋতুভিত্তিক বিষয়গুলোর নান্দনিক উদ্যাপন উপস্থাপন করেছেন তিনি।
গানের ছবি, ছবির গান
সিনেমার ক্ষেত্রে গান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কথায় আছে, গান হিট তো সিনেমা হিট। সিনেমার ইতিহাসে উদাহরণও আছে প্রচুর। এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটিও সিনেমায় ব্যবহারের ক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদ যথেষ্ট সচেতনতা অবলম্বন করেছেন। দৃশ্যের প্রয়োজনে কখনো নিজে গান লিখেছেন। আবার কখনো রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, হাসন রাজার গানসহ অনেক লোকগানও ব্যবহার করেছেন। তাঁর লেখা ‘যদি মন কাঁদে’, ‘একটা ছিল সোনার কন্যা’, ‘চাঁদনী পসরে কে আমায় স্মরণ করে’, ‘আমার আছে জল’, ‘বাজে বংশী’, ‘ও আমার উড়ালপঙ্খিরে’ বহুল শ্রুত ও জনপ্রিয় গান।
ট্র্যাজেডি ও কমেডির সমন্বয়
হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ নাটক-সিনেমায় এ দুইয়ের সফল সমন্বয় অনুভব করা যায়। ফলে আনন্দ, হিল্লোল ও বেদনায় হৃদয় সহসা পূর্ণ হয়ে যায়।
যাপিত জীবনের টানাপোড়েন
যাপিত জীবনের সঙ্গে ভালোবাসা, প্রেম, বিরহ, একাকিত্ব, জন্ম-মৃত্যু, অভাব-অনটন, দুঃখকষ্ট বিষয়গুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রতিটি পদক্ষেপে আমরা জীবনের টানাপোড়েনগুলো নিয়ে ভাবি। প্রতিটি বিষয়কে নিজের মতো করে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি।
হুমায়ূন আহমেদের নাটক-সিনেমায় উল্লেখিত বিষয়গুলোর সফল চিত্রায়ণ দেখা যায়। সে কারণেই ‘নক্ষত্রের রাত’ নাটকে আসাদুজ্জামান নূরের মুখে, ‘মানুষ যখন একা থাকে তখন কিন্তু আসলে সে একা থাকে না। তার মনের ভেতরের মানুষগুলো তাকে ঘিরে থাকে। একা থাকার একমাত্র উপায় হলো অনেক মানুষের সঙ্গে থাকা। কারণ জনতার মধ্যেই আছে নির্জনতা।’ কথাটা শুনে আমরা মুগ্ধ হই। এক বিষম ভালো লাগায় হৃদয় শান্ত হয়ে যায়।
‘তোমার অর্থের এতই প্রয়োজন যে তুমি কিডনি বিক্রি করে দেবে?’
‘আমার টাকার তেমন কোনো প্রয়োজন নাই। আমি একা মানুষ লাখ টাকা দিয়ে করবটা কী! একটা শখ।’
‘আমি তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারতেছি না। তুমি তোমার শখের জন্য কিডনি বিক্রি করে দেবে।’
‘কিডনি বিক্রির শখ না স্যার। আমার দেশ বিদেশ ঘোরার খুব শখ।’
‘নক্ষত্রের রাত’ নাটকের এই সংলাপের মতো সংলাপগুলো বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় না। আমরা সংলাপের যৌক্তিকতা বিচার করার চেষ্টা করি না।
পাঠকের মন থেকে দর্শকের মন
‘নক্ষত্রের রাত’, ‘উড়ে যায় বকপক্ষী’, ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারী, ‘চন্দ্রকথা, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’, ‘আমার আছে জল’, ‘ঘেটুপুত্র কমলা’র মতো নাটক ও সিনেমা নির্মাণ হুমায়ূন আহমেদের জন্য কঠিন ছিল। কারণ, উপন্যাস বা গল্প পাঠের পর সহজাতভাবেই পাঠকের চোখে একটি ছবি তৈরি হয়ে যায়। ফলে ওই উপন্যাস বা গল্প অবলম্বনে নাটক বা সিনেমা করা হলে, যদি সামান্যও এদিক-সেদিক হয়, তাহলে দর্শকরূপী পাঠককে তা আর আনন্দ দিতে পারে না। আর এখানেই হুমায়ূন আহমেদ সার্থক। তিনি পাঠকের মন ও দর্শকের মন—দুটোই অনুভব করতে পেরেছিলেন। কল্পনা, অনুমান ও অনুধাবন শক্তি দিয়ে আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন, পাঠক কী চায়? তাই তো নাটক-সিনেমা দিয়ে দর্শকের মনেও তিনি স্থান করে নিয়েছেন।
সহজাত অভিনয় ও অভিনবত্ব
হুমায়ূন আহমেদের নাটক-সিনেমায় সহজ, নির্মল, স্নিগ্ধ অভিনয়ের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। আদতে যা শেষ পর্যন্ত দর্শকের চোখে অভিনয় হিসেবে পরিগণিত হয় না, সত্যি হয়ে ওঠে। যা সম্ভব হয়েছে হুমায়ূন আহমেদের অভিনবভাবে গল্প বলা ও চিত্রনাট্য নির্মাণের জন্য। প্রচলিত ধারা থেকে বেরিয়ে নিজস্ব কৌশলে নাটক-সিনেমার চিত্রায়ণ করেছেন তিনি। পাশাপাশি কিংবদন্তি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সাহচর্য পেয়েছিলেন। ফলে গল্পগুলো খুব সহজেই প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে।