একঝাঁক তরুণকে জাগিয়েছিল ‘আগামী’
৪০ বছর পর একে অন্যকে পেয়ে আবেগে আপ্লুত! যেন ফিরে এসেছিল আগের দিনগুলো। শুটিংয়ের সেই দিনে তাঁরা কেউ ছিলেন শিশু, কেউ কিশোর। কেউবা প্রতিষ্ঠিত শিল্পী, টেলিভিশনের জনপ্রিয় মুখ। গতকাল বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির চিত্রশালায় এই অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলীদের এক হওয়ার উপলক্ষ ‘আগামী’ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ৪০ বছর পূর্তি। ১৯৮৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি, যেদিন সিনেমাটি প্রথম দর্শকদের সামনে আসে।
আগামী শুধুই একটি সিনেমা নয়, এই সিনেমার পেছনে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস, নান্দনিক ঐতিহ্যও, যা দেশের চলচ্চিত্রে পরবর্তী সময়ে নান্দনিক প্রভাব ফেলেছে। এমনটাই বলেছেন অতিথিরা। আগামী সিনেমার আলোচনায় আরও উঠে আসে, আশির দশকে মানসম্পন্ন শৈল্পিক সিনেমা দেখানোর তেমন সুযোগ ছিল না। যে কারণে সূর্য দীঘল বাড়ী, মেঘের অনেক রংসহ অনেক সিনেমা হলে খুব বেশি দিন চালানো যায়নি। অন্যদিকে দেশে একের পর এক বিদেশি সিনেমা-গল্পের নকল ও অনুকরণ করে সিনেমা নির্মিত হচ্ছিল। শৈল্পিক সিনেমা বানাতে লগ্নি পাওয়া কঠিন ছিল। সেই সময় সিনেমায় দেশের নান্দনিক গল্প ও দেশকে তুলে ধরতে রীতিমতো আন্দোলন করেন গুটিকয় তরুণ। মোরশেদুল ইসলাম, তানভীর মোকাম্মেল, তারেক মাসুদসহ আরও অনেকে এক চিন্তায় ঐক্যবদ্ধ হন। তাঁরা মিটিং করেন, মানববন্ধন করেন, দেশ-বিদেশের শৈল্পিক সিনেমার প্রদর্শনী চলমান রাখেন।
এর মধ্যেই তরুণেরা বিকল্প ভাবনা নিয়ে বিকল্পধারা সিনেমা নির্মাণের পথ বেছে নেন। বিকল্পধারা প্রথম সিনেমা আগামীর কাজ শুরু হয় ১৯৮২ সালে। দীর্ঘদিন সিনেমাটির সেন্সরে আটকে থাকে। নানা বাধা পেরিয়ে সিনেমাটি দুই বছর পর মুক্তি পায়। সেই সিনেমার ৪০ বছর পূর্তি অনেক কিছুই মনে করিয়ে দেয়।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, আগামী সিনেমা দিয়েই শুরু হয় দেশে বিকল্পধারার সিনেমার আন্দোলনের সূচনা। পরবর্তী সময়ে এর প্রভাবে একজন সাইদুল আনাম টুটুল, অমিতাভ রেজা চৌধুরী, নূরুল আলম আতিক, মেজবাউর রহমান সুমনসহ অনেক নির্মাতা স্বাধীনভাবে গল্প বলার সাহস পেয়েছেন।
মাত্র ৪০ হাজার টাকা নিয়ে সিনেমাটির শুটিং শুরু হয়। প্রায় দুই মাস চলে শুটিং। একঝাঁক তরুণ সিনেমাটির সঙ্গে নিজেদের জড়ান। যাঁরা কেউ কোনো পারিশ্রমিক পাননি। বলা ভালো, পারিশ্রমিকের জন্য কেউ কাজটি করেননি। এ ছাড়া পারিশ্রমিক দেওয়ার মতো অর্থ পরিচালকের ছিল না। তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন মোরশেদুল ইসলাম।
কিন্তু মোরশেদুল ইসলাম কেন বিকল্পধারার সিনেমা নির্মাণে আগ্রহী হলেন, এমন প্রশ্নে এই পরিচালক বলেন, ‘আমরা চেয়েছি, চলচ্চিত্রের মতো মাধ্যমকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করতে। তখন আমাদের কিছু বলার ছিল। সেটা সিনেমার মধ্য দিয়ে বলেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে, মুক্তির কথা বলব। তখন মুক্তিযুদ্ধের সবকিছু ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছিল। আমাদের মধ্যে ভয় ছিল, ১৬ মিলিমিটারে গ্রহণ করবে কি না। আমরা বিকল্পভাবে যাত্রা শুরু করতে চেয়েছিলাম। আমরা নিজেরাই দর্শকদের দেখাব, যেকোনো জায়গায় প্রদর্শনী করা যাবে, এমন সিনেমা বানাতে চেয়েছিলাম। পরে সিনেমাটির প্রথম প্রদর্শনীতে দর্শকদের জায়গা দিতে পারিনি। একটির বদলে তিনটি শো করে হয়েছিল। পরে সারা দেশে আগামী দেখিয়েছি। সিনেমাটি দর্শক গ্রহণ করেছিলেন। এটাই ছিল বড় সফলতা।’
সিনেমাটিতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সময়ে সিনেমার জন্য অনেক প্রস্তাব পেলেও নাম লেখাননি। এর মধ্যে আগামীর গল্প শুনে রাজি হয়ে যান। তিনি মনে করেন, সেই সময়ে স্বাধীনতাবিরোধীরা এক হওয়ার সুযোগ খুঁজছিল। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল। তখন দেশের হয়ে কথা বলার উপযুক্ত গল্প মনে হয় আগামীকে। তিনি বলেন, ‘দায়বদ্ধতার জন্য সিনেমায় অভিনয় করেছি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি ভালোবাসা থাকায় অভিনয় করেছি। অনেক সিনেমার প্রস্তাব পেয়েছি। কিন্তু আগামীতে অভিনয় করে নিজেকে ধন্য মনে করি। কারণ, এটা নতুন ধারার চলচ্চিত্রের পথিকৃৎ।’
সিনেমাটি নিয়ে কথা বলতে অতীতে ফিরে যান এর অন্য সব অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলী। তাঁদের মধ্যে সিনেমাটির সংগীত পরিচালক শিমূল ইউসুফ, অভিনয়শিল্পী শারমিন খান, রোখসানা ফেরদৌস ও অন্যরা। সেই সময়ে মঞ্চনাটকে নিয়মিত সংগীতায়োজন করলেও এর বাইরে পর্দায় আগামী সিনেমাটিই ছিল শিমূল ইউসুফের প্রথম কাজ। তিনি ৪০ বছর পূর্তিতে সেই দিনের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘আমাদের কাছে টাকা নেই, যাওয়ার ভাড়া নেই, তবু স্টুডিওতে গিয়ে মিউজিক করতে হবে। চাঁদা তুলে আমরা কাজ করেছি। ৪০ বছর আগে নির্মল আনন্দে কাজটি করেছিলাম। আজ করলে হয়তো সেই সরলতা থাকত না। মোরশেদ তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ওকে না করতে পারিনি। তার জন্যই গেরিলা মতো সিনেমা করার সাহস পেয়েছি।’
৪০ বছর পূর্তির আয়োজনে আরও বক্তব্য দেন অমিতাভ রেজা চৌধুরী, নূরুল আলম আতিক, মোবাশ্বেরা খাতুনসহ আরও অনেকে। স্মরণ করা হয় প্রয়াত অভিনেতা আলী যাকের, রওশন জামিলসহ অন্যদের।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও চলচ্চিত্রম ফিল্ম সোসাইটির যৌথ আয়োজনে আগামী সিনেমা দেখানোর পর পরিচালক মোরশেদুল ইসলামের জীবন ও সৃজনশীল কর্ম নিয়ে তাঁর ওপর নির্মিত ‘অ্যান্ড দেয়ার ওয়াজ লাইট’ তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়। তথ্যচিত্রটি পরিচালনা করেছেন নূরুল আলম আতিক।