‘র্যাবের সহযোগিতা ছাড়া সুন্দরবন থেকে জীবন নিয়ে ফিরে আসা অসম্ভব ছিল’
বিশ্বের দীর্ঘতম কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে গতকাল শুক্রবার রাতে উন্মোচিত হয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনভূমি সুন্দরবনের অপরাধ, অভিযান, সাফল্য, রোমাঞ্চকর উপাখ্যান নিয়ে তৈরি দেশের প্রথম ওয়াইল্ড লাইফ অ্যাকশন থ্রিলার চলচ্চিত্র ‘অপারেশন সুন্দরবন’।
রাত সাড়ে ৯টায় সৈকতের লাবণী পয়েন্টে চলচ্চিত্রের শিল্পী-কলাকুশলীদের নিয়ে ‘অপারেশন সুন্দরবন’-এর ট্রেলার উন্মোচন করেন বাংলাদেশ পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ। চলচ্চিত্র পরিচালক দীপংকর দীপনের পরিচালনায় এবং র্যাব ওয়েলফেয়ার কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের প্রযোজনায় নির্মিত হয় সিনেমাটি। স্থানীয় লোকজনের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক পর্যটক ‘অপারেশন সুন্দরবন’ সিনেমার ট্রেলার, সুন্দরবনের ওপর নির্মিত একাধিক প্রামাণ্যচিত্র ও নাচগান উপভোগ করেন। রাত পৌনে আটটায় ‘ও পৃথিবী এবার এসে বাংলাদেশ যাও চিনে..’ নৃত্যগান দিয়েই শুরু হয় আনুষ্ঠানিকতা। এরপর সুন্দরবন নিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন এবং প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার প্রতিফলন তুলে ধরে পৃথক দুটি ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়। বলা হয়, সুন্দরবনে এখন বাঘ আছে ১১৪টি, হরিণ ১ লাখ ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার। মধু সংগ্রহ হচ্ছে দুই হাজার কুইন্টাল। পর্যটক বেড়ে আড়াই লাখে পৌঁছেছে। পদ্মা সেতু চালুর পর সুন্দরবনে পর্যটকের যাতায়াত বেড়েছে। নিরাপত্তা দিচ্ছে র্যাব। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনভূমি খুলনার সুন্দরবন। মৎস্য ও বনজ সম্পদে ভরপুর সুন্দরবন ঘিরে জেলেসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের জীবন-জীবিকা সেই আদিকাল থেকেই। কিন্তু অস্ত্রধারী জলদস্যুদের উৎপাত ও লুণ্ঠনে শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকা হুমকিতে পড়েছিল।
সুন্দরবনের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন রক্ষা, মৎস্য ও বনজ সম্পদ সংরক্ষণ, সর্বোপরি সুন্দরবনকে বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ২০১২ সালে র্যাব ফোর্সেসকে লিড এজেন্সি ও র্যাব মহাপরিচালককে প্রধান সমন্বয়কারী করে তৈরি হয় টাস্কফোর্স। জলদস্যুদের উৎপাত বন্ধ, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে মাঠে নামে র্যাব-টাস্কফোর্স। ২০১৬ সালের ৩১ মে থেকে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় দুই বছরে সুন্দরবনে সাঁড়াশি অভিযান চালায় র্যাব। এ সময় ৪৬২টি অস্ত্র, বিপুল গোলাবারুদসহ ৩২টি জলদস্যু বাহিনীর ৩২৮ জন সদস্য (জলদস্যু) আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
‘অপারেশন সুন্দরবন’ সিনেমার ট্রেলার উন্মোচন করে আইজিপি বেনজীর আহমেদ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করা হয়েছে। এটি ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। দস্যুমুক্ত সুন্দরবান বিশাল অর্জন দাবি করে আইজিপি বলেন, সুন্দরবনকে বিশ্বব্যাপী তুলে ধরার জন্য ‘অপারেশন সুন্দরবন’-এর ইংরেজি ভার্সনও হয়েছে। আগামী ২৩ সেপ্টেম্বর সারা দেশে সব কটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে ‘অপারেশন সুন্দরবন’। সবাইকে সপরিবার হলে গিয়ে সিনেমাটি দেখার অনুরোধ জানিয়ে বেনজীর আহমেদ বলেন, ৪০০ বছর দস্যুরা রাজত্ব করেছে সুন্দরবনে। জেলেদের অপহরণ, বনজীবী, মধু ও গোলপাতা সংগ্রহকারীদের লুণ্ঠন ও চাঁদা আদায় হতো। সুন্দরবন ছিল আতঙ্কের নাম। র্যাব অপারেশন করল, সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হলো, এমনটা নয়। এর পেছনে অনেক ঘাম ঝরাতে হয়েছে, রক্ত দিতে হয়েছে। ৩০ জন র্যাব সদস্যকে আত্মাহুতি দিতে হয়েছে। শত শত র্যাব সদস্যকে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে। যে কারণে সুন্দরবন আজ দস্যুমুক্ত। চার বছর ধরে সুন্দরবনে লুটপাট, অপহরণ চাঁদাবাজি নেই। এর সুফল ভোগ করছে ২৫ লাখ মানুষ।
সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হওয়ার কারণে পর্যটনের সুযোগ বেড়েছে, কোটি কোটি টাকা আয়ের পথ সৃষ্টি হয়েছে জানিয়ে আইজিপি বলেন, দস্যু না থাকায় সুন্দরবনে বাঘ ও হরিণের সংখ্যা বাড়ছে। সুন্দরবন পুরোনো রূপে ফিরে আসছে।
অপারেশন সুন্দরবনের শিল্পীদের ভূয়সী প্রশংসা করে পুলিশের মহাপরিদর্শক বলেন, সিনেমার আগে শিল্পী-কলাকুশলীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল, র্যাব সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়েছে। ‘অপারেশন সুন্দরবন’ অন্য কেউ করলে ৫০ কোটি টাকা খরচ হতো, আমাদের এত পয়সা খরচ হয়নি। সিনেমার ব্যবহৃত হেলিকপ্টার, ভারী অস্ত্রশস্ত্রের সরঞ্জাম, যানবাহন—সবকিছু র্যাব থেকে সরবরাহ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশের ফোর্স কতটা অ্যাডভান্স, তা জানতে পারবে বিশ্বের মানুষ। এর আগে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে র্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন জানান, সিনেমা থেকে প্রাপ্ত অর্থ আত্মসমর্পণ করা দস্যুদের জীবনমান উন্নয়নে ব্যয় করা হবে।
‘অপারেশন সুন্দরবন’ সিনেমার বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন সিয়াম আহমেদ (মেজর সায়েম সাদাত), নুসরাত ফারিয়া (তানিয়া কবির, একজন বাঘ গবেষক), জিয়াউল রোশান (লেফটেন্যান্ট কমান্ডার রিশান রায়হান), রিয়াজ (ইশতিয়াক আহমেদ, ব্যাটালিয়ন কমান্ডার), মনোজ প্রামাণিক (সাজু), সামিনা বাশার (পাখি), তাসকিন রহমানসহ (রকিব) অনেকে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রিয়াজ, সিয়াম, নুসরাত ফারিয়া, রোশান, দর্শনা, মনোজ প্রামাণিক, মুরাদ পারভেজসহ অনেকে।
মঞ্চে সিনেমার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন শিল্পীরা। সিয়াম বলেন, র্যাবের সহযোগিতা ছাড়া ‘অপারেশন সুন্দরবন’-এ অভিনয় করা মোটেও সম্ভব ছিল না। সুন্দরবন থেকে জীবন নিয়ে ফিরে আসা সম্ভব হতো না। তিনি সপরিবার হলে গিয়ে সিনেমাটি দেখার অনুরোধ জানান।
নায়িকা নুসরাত ফারিয়া বলেন, অপারেশন সুন্দরবন করতে তিন বছর সময় লেগেছে। ভালো সিনেমা হয়েছে। হলে গিয়ে সিনেমা দেখার সুযোগ করে দেবে ‘অপারেশন সুন্দরবন’।
মুরাদ পারভেজ বলেন, ‘সুন্দরবনে গিয়ে পড়েছিলাম অনেক দিন। বাঘের গর্জনও শুনেছি কাছ থেকে। সিনেমাতে দর্শকেরা দেখতে পারেন র্যাব কীভাবে সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করল।’
কক্সবাজারের আঞ্চলিক ভাষায় ‘ বদ্দা গম আছেন নি’ জিজ্ঞাসা করে নায়ক রিয়াজ বলেন, ‘অপারেশন সুন্দরবন’ দারুণ একটা সিনেমা হয়েছে, যদিও তাঁর দেখা হয়নি!
সিনেমার পরিচালক দীপংকর দীপন বলেন, ‘অপারেশন সুন্দরবন’ সিনেমার পুরো টিম নিয়ে বিশ্বের দীর্ঘতম কক্সবাজার সৈকতে নেমেছিল বিকেলে। মানুষের উৎসাহ-আগ্রহ দেখে মন ভরে গেল। ‘ঢাকা অ্যাটাক’ সিনেমা বানিয়ে সফল হয়েছি। আশা করছি ‘অপারেশন সুন্দরবন’ও দর্শকপ্রিয়তা পাবে।